বিবাহ-বিচ্ছেদের মূলে পাথরের ডিম। হিরে ভরা ডিম। টেলেফোনেও এখন এল সেই ডিম্যাণ্ড—মুক্তিপণ কী? না, ডিম।
পুলিশ পুঙ্গবীর প্রশ্নের প্যাটার্ন প্রশংসনীয়। পুঙ্গবী’ শব্দটা বাংলা অভিধানে কিন্তু নেই। আমি বানিয়েছিলাম। পুঙ্গব মানেই যদি হয় যাড়, ওইরকম মেয়েদের পুঙ্গবী বলে ডাকতে বাধা কোথায়? যে মহিলা অফিসারটি এসেছেন, তিনি তো মর্দা সেজেই এসেছেন। নারীত্বের লক্ষণ আবিষ্কার করে নিতে হয়।
যাক গে, যাক গে, বাজে বুকনি বেরিয়ে আসছে কলম দিয়ে। আমি তো ঝানু লেখক নই। পাঠক (এবং পাঠিকা) ক্ষমাঘেন্না করে নেবেন।
খুনে গুণ্ডার দোহাই যে ধোপে টিকল না, তা মহিলা পুলিশের মুখ দেখেই বোঝা গেল। পোড় খাওয়া স্ত্রীলোক। শানানো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে ফট করে জিজ্ঞেস করলেন-আপনি?
একটুও রাঙা না হয়ে টুকটুকে ফর্সা কল্পনা বললে, মাই ফ্রেণ্ড।
অনিমেয়ে তাকিয়ে থেকে পুলিশ পুঙ্গবী বললেন, এই বাড়িতেই থাকেন?
বড় সাংঘাতিক প্রশ্ন। লাইনে চলে এসেছেন প্রশ্নকর্তী।
জবাবটা দিলাম আমি—অন্য বাড়িতে থাকি। কাছেই।
অ। খুনের হুমকি যখন এসেছিল, তখন ছিলেন?
তারপরে এসেছিলাম। টু গিভ প্রোটেকশন টু আ লোনলি লেডি।
অ। আপনার প্রফেশন?
প্রাইভেট ডিটেকশন।
নাম?
ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
এইবার কিন্তু চোখের পাতা কাঁপিয়ে ফেললেন পুলিশ পুঙ্গবী। সেকেণ্ড কয়েক আমাকে দেখলেন। এই দেখাটা অন্য রকমের মনে হল। চোখের তারায় সেই আভাস লক্ষ্য করলাম। বললেন, আপনার তো ভারতজোড়া নাম। প্রাইভেট ডিটেকটিভরা কি এদেশে কি বিদেশে ডিভোর্সের কেস নিয়েই মেতে থাকে। আপনি তার ব্যতিক্রম। ঠিক বলছি?
হান্ড্রেড পারসেণ্ট।
খরখরে চাহনি লাবণী চাহনি হয়ে গেল। পুঙ্গবী বললেন, তাহলে আপনার মুখেই শোনা যাক। ছেলে নিখোঁজ হল কখন থেকে?
সব বললাম। গেমস ফ্রিকের আওয়াজ শুনে গিয়ে দেখলাম, যন্ত্র আছে, ছেলে নেই। শুধু বললাম না একটা কথা। মুক্তিপণ যে শুধু ডিম, সেই কথাটা। বললেই তো হাজারও কথার ঝাপি খুলতে হবে। তাই চেপে গেলাম। কল্পনাব নরুন চোখে দেখলাম নিপুণ কৃতজ্ঞতা।
মিসিং ডায়েরির পাট চুকোতে চুকোতে ঘড়িতে বাজল রাত সাড়ে আটটা। পাহাড়ি রাত সাড়ে আটটা কম নয়। খাদ-খন্দে নজর চালিয়ে মিসিং মানুষটার পায়ের ছাপ খুঁজতে গেলে নিজেদের জীবনের ছাপ মর্ত্য থেকে মুছে যেতে পারে। সে ঝুঁকির মধ্যে গেলেন না পুলিশ পুঙ্গবী, তবে আমার দিকে নজরপাতটা যে একটু অস্বাভাবিক রকমের হয়ে চলেছে, তা লক্ষ্য করে মনে মনে মজা পেলাম।
মজা মিলিয়ে গেল, যখন কল্পনার সামনেই তেড়া চোখে তাকিয়ে সোজা বললেন, কিছু মনে করবেন না, মিঃ রুদ্র। অন ডিউটি পুলিশকে অনেক অপ্রিয় কথা বলতে হয়।
আমিও চোখের পাতা না কঁপিয়ে পুলিশ পুঙ্গবীর চোখে চোখে চেয়ে বললাম, এবং সেই অপ্রিয় কথাটা কী, ম্যাডাম?
আগে মোটিভ, তারপরে ক্রিমিন্যাল অন্বেষণের গবেষণা, অ্যাম আই কারেক্ট?
হান্ড্রেড পারসেণ্ট। নাউ, হোয়াট ইজ ইওর অপ্রিয় কথা?
মোটিভ ওয়ান, র্যানশম আদায়। ভুটিয়া দোঙ্গা জং কালপ্রিট। যদিও সে ব্যাপারটা যথাসময়ে, রেকর্ড করানো হয়নি।
সুতরাং মোটিভ ওয়ান লিকুইড হয়ে গেল, এই তো?
ঝুলিয়ে রাখা হলো, হ্যাঙ্গিং। দোঙ্গা জংয়ের প্যাটার্ন অব ক্রাইম তো এরকম নয়। সেই লাইটনিং স্পীডে কাজ করে। আগেভাগে জানায় না। তাছাড়া, একবার। খুনের হুমকি, তারপর গায়েব-দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। শুধুমুও খুনের ভয় দেখাবে কেন? মুক্তিপণ চাইলেই তো পারত? না দিলে তখন
চুপ করে রইলাম। কল্পনা চিটনিসের এই কাল্পনিক মজুহাত আমিও বিশ্বাস করিনি। মিথ্যে কথা বলা একটা আর্ট। কোর্টে যারা মিথ্যে সাক্ষী দেয়, তারা এই আর্টে আর্টিস্ট।
পুলিশ পুঙ্গবী খরখরে চোখে আমার আর কল্পনার চোখের দিকে চেয়েছিলেন। চোখের আয়নায় মনের কথা গোপন থাকে না, ছায়া পড়বেই। কী ছায়া। তিনি দেখলেন, তা তিনিই জানেন, ফট করে বললেন, কিছু মনে করবেন না, মিস্টার… মিস্টার রুদ্র, আপনি মিসেস… মিসেস…
কল্পনা আস্তে বললে, আমার এক্স হাজব্যাণ্ডের পদবী রে। কিন্তু আমি তা ভুলে যেতে চাই।
ফাইন। ফরগেটফুলনেস ইজ ডিভাইন, অ্যাট টাইমস।
সার্টেনলি। টু ক্লোজ আ চ্যাপ্টার ফর এভার।
ফাইন, ফাইন ফাইন। তাহলে মিসেস চিটনিস…
বলুন, ম্যাডাম চিটনিস।
ওকে, ওকে, ম্যাডাম চিটনিস, মিস্টার ইন্দ্রনাথ রুদ্র এখন আপনার ফ্রেণ্ড, ফিলজফার অ্যাণ্ড গাইড?
অফকোর্স।
মিস্টার রুদ্র, ডোন্ট মাইণ্ড, সেকেণ্ড সাসপেক্ট কিন্তু আপনি হয়ে যাচ্ছেন। তাই না? পথের কাঁটা ছেলেটাকে সরাতে পারলে…..
সহজ যুক্তি তাই বটে। বিশেষ করে আমিই যখন তাকে শেষ দেখেছিলাম।
অসহজ যুক্তি কিছু আছে নাকি? পুলিশ পুঙ্গবীর নয়ন তারকার তীক্ষ্ণতার প্রশংসা না করে পারলাম না। যেন একজোড়া নেপালি কুকরি।
ঠোঁটের কোণে কোণে আমার পেটেন্ট হাসি টেনে এনে বললাম, সেটা তো এত ঢাকঢোল পিটিয়ে করার দরকার ছিল না। পয়সা ছড়ালে ভাড়াটে কিডন্যাপারের অভাব হয় না। কল্পনা চিটনিস বাড়িতে থাকতে থাকতেই তা করানো যেত।
গুড আরগুমেন্ট।
লক্ষ্য করলাম, আমার মার্কামারা হাসিটার দিকে পলকহীন নয়নে তাকিয়ে আছেন পুলিশ পুঙ্গবী। নিগূঢ় এই হাসির অর্থ বিবিধ প্রকার হতে পারে। বন্ধুবর মৃগাঙ্ক রায়ের লেখনীতে তার ব্যাখ্যা মেলে। আমি বচনদক্ষ হতে পারি, কিন্তু কলমদক্ষ নই। তাই সামান্য হাসির একশো আট রকম ব্যাখ্যায় আর গেলাম না।