এইসব বুকনি সয়ে গিয়ে হাসি মুখে তার অঙ্গ সংবাহন করে যেতাম আমার পালা এলেই। নিশিযাপনও করতাম একই শয্যায়। কুমারী থাকতে পেরেছি কেন, তা আগেই বলেছি।
আমার পালা পড়ত বেশি। আমার এই হিলহিলে বিউটির জন্যে। আমাকে বলতেন, তুই একটা পাহাড়ি সাপ। জাপটে থাক। টের পাই শিরশির করে বিদ্যুৎ ঢুকছে ভেতরে।
কিন্তু বুড়ো বড় খলিফা। কখনও আমার চোখে চোখে তাকাতেন না। পাছে ঘোর সৃষ্টি করে পেট থেকে কথা বের করে নিই। তবে, আমার শরীরের বিদ্যুতেও বোধহয় সম্মোহন আছে। বোধহয় কেন, নিশ্চয় আছে। আপনি বড় হুঁশিয়ার, ইন্দ্রদা, তাই আমাকে টাচ করেন না। চান্স দেওয়া সত্ত্বেও।
জহুরি দণ্ডপথ আমার এই বডি-কারেন্টে এক-একদিন বেহুশ হয়ে যেতেন। প্রলাপ বকুনির মতো ছাড়া-ছাড়া কয়েকটা কথা বলতেন। যেমন, মন্ত্রগুপ্তি… মন্ত্রগুপ্তি… নয় হিরে তো নয়, ওরা নবগ্রহ… অসাধ্য সাধন করতে পারে… ছয়। হিরে দিয়েও নয়ছয় করা যায়…
ঘোর কেটে গেলে, ভোর হয়ে গেলে, আমার চোখে চোখ রেখে বলতেন—কিছু বলেছি নাকি? শুনে যদি থাকিস, চেপে থাকিস। তোর সঙ্গে ভাল ছেলের বিয়ে দেব। এমন বাচ্ছা তোর পেটে আসবে যে অসম্ভবকে সম্ভব করবে।
এইভাবেই রাসলীলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বুড়ো। দোষ কী। শ্রীকৃষ্ণ যদি ষোল হাজার গোপিনীর দৃষ্টান্ত রেখে যান, আমাদের মতো বিনা মাইনের মেয়েদেরকে দিয়ে বডি ম্যাসাজ তো করাবেনই—শুধু বিয়ের লোভ দেখিয়ে।
যাকগে, যাকগে, যথা সময়ে পেলাম আপনার বন্ধু রবিকে! সোজাসাপটা মানুষ। আঁচ করলাম, ওকেই মন্ত্রগুপ্তি দিয়ে গেছেন গুরু দন্ডপথ। যেহেতু আমি কিছুটা জেনে ফেলেছি, তাই আমাদের যুগলবন্দি করে রাখলে ঘরানা হয়ে গুপ্ত থেকে যাবে মন্ত্রগুপ্তি।
হিরে নিয়ে সেঁটে ঘেঁটে আমি নিজেও কিন্তু জেনে ফেলেছিলাম আর একটা ব্যাপার। হিরে শোধনের এক অক্ষরের মন্ত্র। একটা ওঁ-কারের ছ’টা পয়েন্টে ছ’টা হিরে বসিয়ে ওঁ জপ করে গেলে বিশ্বশক্তি চলে আসে হিরের মধ্যে দিয়ে শরীরের মধ্যে। হিরে শোধন হয় কিনা বলতে পারব না। তবে, শরীর-মন অন্যরকম হয়ে যায়। প্রাঞ্জল করতে হবে? এই দেখুন, এঁকে দেখাচ্ছি—
ছ’টা পয়েন্টে ছ’টা হিরে বসালে হিরের শক্তি আর ওঁ-কারের শক্তি এক হয়ে গিয়ে অন্য একটা শক্তি এনে দেয় ভেতরে। হিরে নিয়ে কাজ করার সময়ে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে এই কাণ্ড করতাম। তাই আপনার বন্ধুকে চট করে কজা করতে পেরেছিলাম। জহুরি দণ্ডপথও তো ঘোরের মধ্যে বলেছিলেন, ছয় হিরে দিয়ে নয়ছয় করা যায়।
তারপর কত চেষ্টা করলাম। ভবি ভোলবার নয়। তাই একদিন একটু চান্স পেয়েই ওরই বুড়ো আঙুল দিয়ে সিন্দুকের পাল্লা খুলিয়ে লোপাট করলাম ছ’খানা ডিম। বাকিগুলো হাতানোর আগেই ওর ঘোর কেটে আসছে দেখে আর এগোইনি। আর একবার চান্স নেব, ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু বড় হুঁশিয়ার মাল আপনার এই বন্ধুটি। আমাকেই নাি চার্জ করে বসল। সোজা বললে, হয় ডিম দাও, নয় ভাগো।
তাই ভেগেছি, ছেলেকে নিয়ে। আপনাকে পকেটে এনে ওকেও প্যাচে ফেলবার প্ল্যান যখন কষছি, ছেলে গেল চলে…
কে নিয়েছে তাকে? ডিম যার, নিশ্চয় সে। ছেলের বাপ।
আপনি তাকে ফিরিয়ে আনুন। আপনার বন্ধুকে খবর দিন। সে যা চায়, তাই পাবে, তাই পাবে—ফিরিয়ে দিক আমার ছেলেকে।
২৫. কিডন্যাপার যখন ইন্দ্রনাথ
টেলিফোনে কিডন্যাপার চেয়েছে শুধু ডিম। ডিম রয়েছে দুজনের কাছে। একদা যারা স্বামী-স্ত্রী ছিল, তাদের কাছে। তার আগে তো তদন্ত দরকার। পুলিশকে ইনফর্ম করা দরকার। নইলে আমি যে ফেঁসে যাব। ফেঁসেও গেছিলাম। কীভাবে, সে প্রসঙ্গে আসছি পরে। তার আগে বলি।
রুটিন ইনভেসটিগেশনের কথা।
পুলিশ এল সেই রাতেই, আটটা বেজে কুড়ি মিনিটে।
কথার শুরুতেই কল্পনা বলে ফেলেছিল ভুটিয়া গুণ্ডা দোঙ্গা জংয়ের কথা। যে কি না খুনের ফিকিরে ছিল মা-ছেলে দু’জনকেই। যে টেনশন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অছিলায় কল্পনা টেনে এনেছে আমাকে এই তুহিন অঞ্চলে। কিন্তু ঘটনাটার বিন্দু বিসর্গ জানিয়ে রাখেনি স্থানীয় আরক্ষা দফতরকে।
সেই পয়েণ্টেই পুলিশ চলে এল প্রথমেই, কিডন্যাপিংয়ের হুমকি-টুমকি আগে এসেছিল কি?
আমতা আমতা করে কল্পনা আমার চোখে চোখ রেখেই সরিয়ে নিয়ে বলেছিল, কিডন্যাপিংয়ের হুমকি না থাকলেও খুনের হুমকি ছিল।
কে দিয়েছিল? প্রশ্ন তোে নয়, যেন পাথর বর্ষণ। কড়া গলা। শক্ত চোখ। এই দুইয়ের অধিকারিণী যে মহিলা অফিসার, তিনি চোর-ডাকাতের পিছন নিতে নিতে দুর্গেশনন্দিনী টাইপের মহিলা হয়ে গেছেন। পরনে টাইট জিনস শার্ট আর ট্রাউজার্স। চুল শক্ত বিনুনির দৌলতে টিকটিকি আকৃতি নিয়েছে। খরখরে দুই চোখে বিশ্ব-বিশ্বাস পুঞ্জ পুঞ্জ আকারে বিস্তৃত।
মিনমিন করে ভুটিয়া খুনে দোঙ্গা জংয়ের নাম করেছিল কল্পনা। ধমক খেয়েছিল তৎক্ষণাৎ। পুলিশকে তা জানানো হয়নি কেন? ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কেস যে লিকুইড হয়ে গেল, বোঝা হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।
দোঙ্গা জংয়ের কেসটা যে কল্পনার কপোল-কল্পিত, এই সন্দেহ গোড়া থেকে দানা বেঁধেছিল আমার মনেও। কিছু মেয়ে চমৎকার মিথ্যে বলতে পারে। কল্পনার মোদ্দা মতলবটা ছিল তো আমাকে কাছে আনা। দোসরের দরকার সব কন্যারই।
আমি তা বুঝেও চুপ করেছিলাম। এসেছিলাম তো রবি রে-র আত্মকাহিনি শোনবার পর। পাঠক এবং পাঠিকা অশেষ ধৈর্যপূর্বক সেই কাহিনির সুদীর্ঘ পঠনের মধ্যে দিয়ে এতক্ষণ গেছেন।