তাই আমি ভেবেছিলাম, কিডন্যাপার কোটি কয়েক মুদ্রা চেযে বসবে সোমনাথ-মূল্য বাবদ। হিরে বণিকদের পুত্রের দাম হিরে দিয়েই হয়। কোহিনুর-টোহিনুর টাইপের হিরেও চেয়ে বসতে পারত।
কিন্তু সে চাইল কী?
ডিম! চেয়েই, টেলিফোন নামিয়ে রাখল।
অগত্যা আমাকে ফ্ল্যাশব্যাকের পর ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে আগের কাহিনী পিণ্ডদের টেনেমেনে আনতে হয়েছে সময়ের এই আক্রাগণ্ডার বাজারে। মিনি গল্পের যুগে এই ম্যাক্সি ফ্ল্যাশব্যাক আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল কি না, সমঝদার পাঠক (এবং পাঠিকা) নিশ্চয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছেন।
ডিম। যে ডিম নিয়ে তুফান রচনা করেছে কল্পনা সুন্দরী, যে ডিম পাচারে অংশ নিয়ে ছোটখাটো যক্ষরাজ হয়ে বসেছে দোস্ত রবি রে (যদিও তার দেহের গঠন কুৎসিত নয়, সে এক চক্ষু নয়, অষ্টপদের অধিকারীও নয়)—সেই ডিম চাইছে কিডন্যাপার–অতিশয় কর্কশ গলায়।
কিডন্যাপারদের কণ্ঠস্বর কর্কশই হয়—সায়গল-হেমন্ত-পঙ্কজের মতো হয় না। কিন্তু তার বাচনভঙ্গী আর বাক্য সংযমের তারিফ না করে পারিনি। সে চায় শুধু ডিম। টেলিফোন নামিয়ে রেখে মুক্তিপণের স্বরূপ শোনালাম কল্পনাকে। সে বিবর্ণ হয়ে গেল।
২৩. ডিম যখন মহার্ঘ হয়
উৎসুক হয়েছেন কিছু পাঠক এবং অবশ্যই পাঠিকা। কেচ্ছা শুনতে চায় সবাই। এই কলকাতায় যদি একটা পি-এন-পি সি ক্লাব করা যায়, নির্ঘাৎ তার সেক্রেটারি হবেন এক ললিতা মহিলা।
পি-এন-পি-সি বস্তুটা কী? যাঁরা জানেন, তারা মুচকি হাসছেন, যাঁরা জানেন না, তাদের অবগতির জন্যে জানাই-পরনিন্দা পরচর্চা—সংক্ষেপে পি-এন-পি-সি।
যাকগে, যাকগে, মূলে ফিরে আসা যাক। শেকড় তাহলে এই ডিম। যত অনর্থ ঘটাচ্ছে এই ডিম। ডাইনো ডিমের মতোই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়ছে… অনিক্স পাথরেব ডিম।
আমি, টেলিফোন নামিয়ে রেখে, সবুজাভ নয়নার চোখে চোখ রেখে বললাম, কল্পনা, কেসটা ডিম চুরি নিয়ে।
কল্পনা আইভরি গ্রীবা বেঁকিয়ে বললে, কী বলতে চান?
আমি তার চোখের চাহনি এড়িয়ে গিয়ে নাকের পাথরটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি সব জানি।
কী জানেন?
জহুরি দণ্ডপথ বিশ্বাস করে যে ডিম দান করে গেছিলেন রবিকে, তুমি তা চক্ষুদান করতে গেলে কেন?
দপ করে জ্বলে উঠল কল্পনা রূপসীর রূপময় সবুজ চোখ–আমাকে যে দান করতে হয়েছে অনেক। প্রতিদান তখন পাইনি। পরে নিলাম।
হকচকিয়ে গেলাম ভেতরে। বাইরে রইলাম প্রশান্ত–তোমাকে দান করতে হয়েছে?
আজ্ঞে?
কাকে?
জহুরি দণ্ডপথকে।
অতি কষ্টে কণ্ঠস্বরকে নিষ্কম্প রেখে বললাম, কী দান?
অঙ্গসেবা।
অর্থ?
তখন, কল্পনা যে কাহিনি শুনিয়ে গেল, অতি সংক্ষেপে তা যযাতির লাম্পট্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
২৪. জহুরি যখন যযাতি হতে চায়
কল্পনা বলছে–
ইন্দ্ৰদা, দাদা বলেই এখনও সম্বোধন করব, বন্ধু রূপে তো রইলেন, অন্য রূপে নাই বা পেলাম…পেলে বর্তে যেতাম। তেরিয়া পুরুষদের আমার বড় পছন্দ-পুরুষ মানুষ ন্যাতাজোবড়া হলে কি মানায়? পুরুষ হবে কাটাগাছ অথবা কাটা গোলাপের মত… তুলতে গেলে আঙুলে ফুটবে… কিন্তু খোঁপায় মানায় ভাল।
ভুরু কুঁচকোবেন না। অপ্রিয় সত্যি বলছি তো, তাই মনে ধরছে না। তোয়াজ করা আমার ধাতে নেই।
অথচ একদা তোয়াজ করেই আমাকে থাকতে হয়েছে। কাকে জানেন? জহুরি দণ্ডপথ নামক ঋষিপ্রতিম বৃদ্ধটাকে। তাঁর চুল সাদা, ভুরু সাদা, দাড়ি সাদা। মুখের চামড়ায় কিন্তু যৌবন-কান্তি। কীভাবে এহেন যৌবনশ্রী ধরে রেখেছিলেন জানেন? একটু-আধটু আফিংয়ের জন্যে শুধু নয়। উনি যযাতি-প্রক্রিয়া আয়ত্ত করেছিলেন।
গোড়া থেকেই তাহলে শুনুন। জহুরি দণ্ডপথ অতি অমায়িক, অতি সজ্জন, অতি দয়ালু। এইটাই জানে জগজন। তিনি খুঁজে খুঁজে অনাথা রূপসীদের এনে হিরের কারখানায় কাজ করান, তাদের খাওয়া-পরা-থাকার ভার নেন। বিয়ের ব্যবস্থা করে দেন। দুর্নাম নাকি সুনামের আগে যায়, এমন একটা কথা আছে। কিন্তু তার বিপরীতটাও সত্যি বটে। সুনাম দুর্নামকে চাপা দিয়ে রাখে।
জহুরি দণ্ডপথ আসলে যে কি বস্তু, তা কেউ টের পায়নি। যারা টের পেয়েছে, তারা জীবন গেলেও মুখে প্রকাশ করতে পারেনি। যেমন আমি পারিনি। এখন পারছি কেন? আমার পেটের ছেলে গায়েব হয়েছে বলে। ইন্দ্রদা, জহর কারখানার তরতাজা মেয়েরা পালা করে প্রতি রাতে যেত জহুরি দণ্ডপথের অঙ্গ সংবাহন করতে। যাকে বলে ম্যাসাজ-তাই সারা শরীর ডলে দিয়ে একই শয্যায় থাকতে হতো—এর বেশি আর যেতেন না বৃদ্ধ—অক্ষম ছিলেন বলে।
কিন্তু কেন এই মনোবিকলন? বৃদ্ধ বয়েসে কেন হেন ভ্রষ্টাচার?
তার একটা সুযুক্তি খাড়া করেছিলেন জহুরি দণ্ডপথ। বলতেন, দ্যাখো মেয়ে, পুরাণ ঘাঁটলে অনেক বিজ্ঞান জানা যায়। যযাতি লোকটা মুখ বজ্জাত ছিলেন না। তিনি জানতেন, যুবতীদের শরীর থেকে যে প্রাণজ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়, তা যুবকদের যেমন সক্ষম রাখে, তেমনি বৃদ্ধদের জরা এগোতে দেয় না। বিলেত আমেরিকায় নাকি এই টেকনিকেই ইয়ং বিউটিদের পার্সোন্যাল সেক্রেটারি বানিয়ে রাখা হয়। কল্প বিজ্ঞানের একজন আমেরিকান বৈজ্ঞানিক তো ছ’জ বিউটিফুল যুবতীকে দিয়ে নিয়মিত বডি ম্যাসাজ করাতেন—তার জরা তাকে কাবু করতে পারেনি। পুরু আসলে নাকি হাজার বছর বাঁচেননি—ছেলের হাজার উপপত্নীদের পর নিয়েছিলেন যৌবন টনিক নিংড়ে নিয়ে নিজেকে তাজা রেখেছিলেন। হাজার শব্দটা গল্পে চলে এসেছে অন্যভাবে।