আমি নেমে গেছিলাম এই ট্রেডিংয়ে। হিরে আনা, হিরে বেচা। খনির হিরে এ-বর্ডার, সে-বর্ডার পেরিয়ে পেশোয়ারে ঢুকে, অনিক্স পাথরের ডিমের মধ্যে থেকে, চলে আসত আমার কাছে। আমি বিরাট লাভ রেখে সেই হিরে…অকাট্য। হিরে… চালান দিতাম ঠিক ঠিক জায়গায়… প্রফিট? কল্পনায় আনতে পারবি না…
হিরের গুদোম ছিল ব্যাঙ্গালোরেই… একটা হাই-টেক ইস্পাত সিন্দুকে… সে সিন্দুকের পাল্লা খুলে যেত শুধু আমার ডানহাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ সিন্দুক খোলার সঙ্কেতের সঙ্গে মিলে গেলে… খুঁটিয়ে বলতে চাই না… শুধু বুড়ো আঙুলটা বিশেষ একটা জায়গায় চেপে ধরলেই কাজ শুরু হয়ে যেত… সিন্দুকের প্রথম পাল্লা খুললে সামনের চেম্বারে থাকত ছ’টা ডিম… জহুরি দণ্ডপথের দেওয়া ডিম, ভেতরে আছে আর একটা চেম্বার… সেখানে আমার ডানহাতের পুরো পাঞ্জা চেপে ধরতে হতো… এই সেকেণ্ড চেম্বারে বাকি তিনটে ডিম ছাড়াও থাকত বিস্তর অনিক্স পাথরের ডিম। প্রত্যেকটার ভেতরে চালানি হিরে… খনি থেকে চোরাই হিরে… হিরের খনি নিয়ে অনেক কথা তোকে আগে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বলেছি। এ ব্যাপারটা মাথায় ঢোকানোের জন্যে…।
একটানা এতগুলো কথা বলে দম নেওয়ার জন্যে একটু যতি দিয়েছিল রবি রে! সুরুৎ করে সেই ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম আমার জেরা—ময়দানের শিল্পমেলা থেকে হাওয়া হওয়া পেশোয়ারি ডিম তুই নিয়েছিলি?
২১. রাঘব বোয়াল বিগ ব্রেন
রবি রে চকমকি চোখ নাচিয়ে নাচিয়ে আমার তরল চোখ আর শক্ত ঠোঁটের চেহারা-টেহারা একটু দেখে নিয়ে বললে, ইন্দ্র, তুই আগের জন্মে টিকটিকি ছিলি।
আমি বললাম, জুরাসিক যুগে ডাইনোসর ছিলাম। টিকটিকির পূর্বপুরুষ। মরুদ্যানের পেশোয়ারি পাথরের ডিম তোর খপ্পরে গেছিল?
হ্যাঁ, বন্ধু, হ্যাঁ। সাপ্লাই এসেছিল আমার নামে, মাল চলে এসেছে আমারই কাছে।
কে এনে দিল? তুই তো ময়দানের ত্রিসীমানায় যাননি?
সে খবরও রাখিস?
রাখতে হয়। কে এনে দিল?
রাঘব বোয়াল বিগ ব্রেন।
সেটা আবার কী বস্তু?
বস্তু নয়, একটা গুপ্ত সচ্ছা। এরা টেররিস্টদের আর্মস সাপ্লাই বিজনেস পণ্ড করে দেয় যে-কোনও প্রকার কৌশলে। পেশোয়ারি হিরে আমিই ভ্যানিশ করে দিয়েছিলাম এদেরকে দিয়ে—মূল্য ধরে দিয়েছি—সে হিরে এখন নিরাপদ—আমার জিম্মায়।
হিরে লেনদেন তোর বিজনেস। রাঘব বোয়াল বিগ ব্রেন নামক গুপ্ত সংস্থা নিয়ে তুই চোরাই হিরে কিনেছিস। কাজটা অন্যায়।
হ্যাঁ, বন্ধু, হ্যাঁ, বিজনেস ইজ বিজনেস।
সেই হিরে এখন কোথায়?
বেচে দিয়েছি ভাল লাভে। হিরে জমা হয় আমার পয়েন্টে… ডলার বেরিয়ে যায় পৃথিবীর অন্য পয়েন্টে… মাড়োয়ারি বিজনেসের মতো একটা চেন ওয়ার্ক। ইন্দ্র, এত কথা তোকে বললাম কেন, এবার তা বলছি। আমার অন্য হিরে যে নিখোঁজ হয়েছে।
অন্য হিরে? পেশোয়াড়ি পাথরের মধ্যের হিরে?
না। মন্ত্রপূত হিরে।
কল্পনা নিয়েছে? না’খানা ডিম?
না। ভেতরের চেম্বার খুলতে পারেনি। ভেতরে যে আর একটা চেম্বার আছে, সেটা খুলতে গেলে আমার পাঞ্জার ছাপ দরকার, তা জানত না।
বাইরের পাল্লা খোলার সিক্রেট জানত?
জানত।
তুই জানিয়েছিলিস?
হ্যাঁ।
কেন, মূখ কেন?
যেদিন সত্যি প্রেমে পড়বি, সেদিন বুঝতে পারবি।
মূর্খ, মিথ্যে প্রেমে মজা বেশি। সে কথা থাক। সিন্দুকের প্রথম পাল্লা তো খোলে তোর বুড়ো আঙুলের ছাপ চেপে বসলে। তুই দিতে গেলি কেন?
হিপনোটাইজড হয়ে।
হোয়াট?
তোকে বার বার বলে এলাম, কামরূপ কামাখ্যার মেয়ে যার মা, সে এাটক যোগসিদ্ধা… চোখে চোখে চেয়ে বনের পশুকেও বশ করতে পারে…
তোর মতো বুনোকেও…
বশ করেছিল। আমি ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম। কী করেছিলাম, মনে নেই। ঘোর কাটলো সকালে ঘুম ভাঙবার পর। কল্পনা পাশেই ঘুমোচ্ছিল অঘোরে। খাট থেকে নেমে চটিতে পা গলাতে গিয়ে দেখলাম, একটা চটি নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, দেওয়াল সিন্দুকের সামনে রয়েছে। খটকা লেগেছিল। ঘুমন্ত কল্পনাকে না জাগিয়ে পা টিপে টিপে গিয়ে সিন্দুক খুলেছিলাম থাম্ব ইমপ্রেশন দিয়ে। জহুরি দণ্ডপথের দেওয়া পেশোয়ারি পাথরের বাক্স দুটো দেখতে পাইনি। এক-একটা বাক্সে থাকত তিনটে করে ডিম। পাঞ্জা ইমপ্রেশন দিয়ে ভেতরের চেম্বার খুলেছিলাম। সেখানে রয়েছে বাকি তিনটে ডিম… অন্য অন্য হিরে… পেশোয়ারি পাথরের কৌটোয়… বুঝলাম, রাতে, ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে কো আমার দিকে অমনভাবে চেয়েছিল কল্পনা… সবুজ পাথরের মতো চোখে যেন সবুজ শিখা দেখতে পাচ্ছিলাম… তারপর আর কিছু মনে নেই।
তারপর? তারপর?
অবান্তর কথায় কথা না বাড়িয়ে উপসংহারে চলে আসছি। যবনিকা টেনে দিলাম মারমার কাট-কাট কাণ্ডকারখানার পর। ডিভোর্স। এক পয়সাও অ্যালিমনি না নিয়ে যেন পরমানন্দে পলায়ন করল কল্পনা চিটনিস—দ্য গ্রেট চিটিংবাজ।
ছেলেকে ছেড়ে দিলি? তোর ঔরসের ছেলে—নিজের মুখে স্বীকার করেছিস। চাইলি না কেন?
চেয়েছিলাম। দেয়নি।
সেই ছেলেই কিডন্যাপড হয়ে গেল অনেক… অনেকদিন পরে… পাহাড়ি অঞ্চলে… যেখানে আমাকে ভালবেসে টেনে এনে রেখেছিল কল্পনা…
২২. কিডন্যাপার কে?
অবশ্যই বন্ধু হিসেবে।
মোহিনী মেয়ে কল্পনা আমার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করেছিল ডিভোর্সি হয়ে যাওয়ার অনেক… অনেক পরে। রবি রে-র পেট থেকে একটু একটু করে সব কথাই তদ্দিনে আমার বের করা হয়ে গেছিল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হিরে নিয়ে ঝগড়া লাগতেই পারে। গয়নাগাটিতে আর শাড়ি-টাড়িতে মেয়েদের আকর্ষণ চিরকালের। সেকাল থেকে একাল-সব কালেই মেয়েরা এই রূপটা পাল্টাতে পারেনি। সুতরাং ওইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আমার মাথা ঘামানো দরকার মনে করিনি।