তাহলে এখন আসা যাক হিরে প্রসঙ্গে। জ্যোতিষশাস্ত্র যা জানে না, সেই প্রসঙ্গে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে রেখে যা উদ্ভট এই তত্ত্বকে।
কাগজ কলম কোথায়? এই যে… এই আঁকছি একটা নক্ষত্র—এক টানে। কলম না তুলে।
লক্ষ্য করেছিস নিশ্চয়, কলম যেখানে বসালাম, সেখান থেকেই তুললাম। পাঁচ পয়েন্টের নক্ষত্র। তার ওপারে, নক্ষত্রের ডগায় ডগায় পাঁচ পয়েন্ট ছাড়াও, ভেতরে ভেতরে রয়েছে আরও পাচটা পয়েন্ট। বুঝলি না? বুঝিয়ে দিচ্ছি…
মোট দশটা পয়েন্ট পাওয়া গেল। দশটা বিন্দু। বিন্দু রহস্যের সূত্রপাত এইখান থেকেই। শক্তির দুর্গ। এ শক্তির আদি নেই, অন্ত নেই। অজানা অনন্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে এই দশটা বিন্দুতে। এইবার আহরণ করতে হবে এই বিন্দু শক্তিকে—দশ বিন্দুতে দশটা হিরে বসিয়ে।
কীভাবে? গুপ্ত প্রকরণ এইখানেই, কিন্তু খুব সোজা। জহুরি দণ্ডপথের কাছে আগেই জেনেছিলাম, জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলাম, মোট ন’রঙের ন’টা হিরে তার কাছে আছে—সাদা আর কালো প্লাস বর্ণালির সাত রঙের সাতটা হিরে…মনে পড়ছে?
উনি ন’টা পয়েন্টে বসালেন ন’খানা হিরে… দশম বিন্দু তখন হিরেহীন …আমার চোখে চোখে চোখ রেখে বললেন, শক্তিস্রোত বইছে ন’টা হিরের মধ্যে দিয়ে… সূক্ষ্ম শক্তি… বর্ণশক্তি. আটকে আটকে যাচ্ছে দশম বিন্দুতে…ওই বিন্দুতে এখন যে হিরে বসানো হবে… গুপ্তশক্তির আধার হয়ে দাঁড়াবে সেই হিরে…।
ইন্দ্র, এই মুহূর্তে তোর চোখে যে অবিশ্বাস দেখছি, আমার চোখেও সেই অবিশ্বাস দেখতে পেয়েছিলেন গুহ্যতত্ত্বজ্ঞানী জহুরি দণ্ডপথ। রাগ করেননি। দশম হিরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে দশবার একটা উৎকট সংস্কৃত মন্ত্র জপ করে গেছিলেন—আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে… আমার তা মুখস্থ হয়ে গেছে… কিন্তু তোকে তা বলতে পারব না… কথা দিয়েছি গুরু দণ্ডপথকে… পা ছুঁয়ে শপথ করেছি… তবে তুই প্রাণের বন্ধু… কাব্য দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি… মন্ত্রশক্তির যে অনুকম্প… ভাইব্রেশন… শব্দশক্তি. বিপুল এনার্জি… তা থাক শুধু আমার মগজে…
অধৈর্য হয়েছিস? তবে শোন আনাড়ির কবিতা…,
সাত রঙের ছটা…
খেলেছে নাচের উড়নিতে…
নবম দশা পেয়েছে আমার মন্ত্রশক্তিতে…
দশম পাথর ভিন্ন তখন মহাশক্তিতে।
ছন্দ মিলল না? দুঃখিত। আমি কবি নই। কিন্তু এটা তো জানিস, নয় সংখ্যাটা হিব্রু সংখ্যা বিজ্ঞান অনুযায়ী অসীম শক্তিধর? সেই শক্তি চলে আসে দশম বিন্দুর হিরেতে… তখন, ইন্দ্র, শুধু তখন, ভাগ্যবিধাতার সেরা সম্পদ… নিয়তির নতুন লিখন হীরকের ক্রিস্টাল পুর্গে প্রচ্ছন্ন থেকে যায়। সেই হিরে যার অধিকারে আসে, সে হয় অসীম শক্তিধর। হিরে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ঘটে গেছে যুগে যুগে এই কারণেই… পাওয়ারফুল হিবেদের শুধু জবরদখল করে রাখলেই হয় না… তাদের শক্তি ভাঙানোর প্রক্রিয়াটাও শিখতে হয়…ইন্দ্র, আমি সেই প্রক্রিয়া জানি… জানি বলেই কোনও পুঁজি না নিয়ে আমি আজ ডায়মণ্ড কমপ্লেক্সের মালিক… নখানা। পাথবের ডিমের দৌলতে।
পাথরের ডিম বৃত্তান্ত তোকে বলা হয়নি? গুছিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই—তোর মতো। এখন বলছি-পাঁচ কান যেন না হয়। সাত রঙের বালির সাইজের হিরে আমাকে দেখিয়েছিলেন জহুরি দণ্ডপথ, মনে আছে? উনি সেই রঙিন হিরেদের রেখে দিতেন পাথরের ডিমের মধ্যে… পেশোয়ারের পাথর কারিগরের গড়া পাথরের ডিম… দেখতে হাঁসের ডিমের মতো… তবে সাদা নয়… সারা গায়ে পাথরের রেখা … এমনভাবে গড়া যে পেঁচিয়ে খুলে ফেলা যায়… রেখাগুলো ঢেকে রেখে দেয় প্যাঁচের দাগ… এ ছাড়াও অবিকল ওই রকম আরও দু’টো ডিমের মধ্যে রাখতেন সাদা আর কালো হিরে… বালির সাইজের হিরে… দশম হিরোকে তুক… ইয়ে…, মন্ত্রপূত করে শক্তিধর করার জন্যে…
শিক্ষা সমাপ্ত করাব পর উনি ন’খানা হিরেই আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কল্পনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার পর… বিয়ের যৌতুক অথবা পণ হিসেবে… যা খুশি বলতে পারিস…
কিন্তু যে রহস্যটার আজও কোন কিনারা করতে পারিনি, তা তোকে আগে বলেছি… মানে, ছুঁয়ে গেছি…
পরের দিন সকালে জহুরি দণ্ডপথের শরীরটা পাওয়া গেছিল বিছানায়… কিন্তু প্রাণ ছিল না সেই শরীরে…
হে পাঠক, হে পাঠিকা, প্রায় দম বন্ধ করে শুনে গেছিলাম রবি বের অবিশ্বাস্য কাহিনি। ন’টা পাথরের ডিম যে তার হেপাজতে… জেনেছিলাম তখনই।
তার অনেক… অনেক পরে… ছ’খানা ডিম হল নিরুদ্দেশ। নিপাত্তা। নিখোঁজ। আর তার ঠিক পরেই বিয়ে ভেঙে গেল রবির। ছেলেকে নিয়ে আলাদা নীড় রচনা করেছিল কল্পনা। এক পয়সাও খোরপোস না নিয়ে। আমার দিকে কল্পনাব সবুজ চোখের লেহন শুরু হয়েছিল এর পর থেকেই। কিন্তু সে অনেক পরের কথা… যদিও সেই ব্যাপার দিয়েই শুরু হয়েছে এই কাহিনি।
১৯. উৎকণ্ঠার মন্ত্র আর মত্ততার নৃত্য
কল্পনা নাম্নী কন্যা যে বিশেষ কঠিন পদার্থ দিয়ে নির্মিত, এই তত্ত্ব আহরণ করতে বিলক্ষণ সময় লেগেছিল রবি রে নামক দুদে সেলসম্যানের। যে নাকি মানুয চরিয়ে খেয়েছে, দেশে দেশে ঘুরে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, তার মতো চৌকস সেয়ানা ধুরন্ধর চক্ষুষ্মন ব্যক্তিকেও ঘোল খাইয়ে দিয়েছে এই কল্পনা… কল্পনা চিটনিস।
প্রিয় বন্ধু বলেই প্রথম মধুরাতের মধুকথা আমার কানে যৎকিঞ্চিৎ উপুড় করেছিল রবি। সখীদের নিয়ে, হীরক, কারিগর বান্ধবীদের নিয়ে, কল্পনা সেই রজনীতে রমণ নৃত্য নেচে গেছিল রবির সামনে।