আমি নিজে সেলসম্যান। সেলস টক দিয়ে আমাকে ভাওতা মারা যায় না। আমরা পুঁদে সেলসম্যানরা, বলেই থাকি, এক সেলসম্যান আর এক সেলসম্যানকে ঠকাতে যায় না।
তাই মনে হল, জহুরি দণ্ডপথ সত্য বলছেন।
কথা বাড়ালাম না। শুধু জানতে চাইলাম, এমন খুদে হিরে কাটাই হচ্ছে কোথায়? আটান্ন দিক তুলছে কারা?
জহুরি দণ্ডপথ আমার চোখে চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর মধুর হেসে বললেন, ইয়ংম্যান, যদি তাদের কাউকে পছন্দ হয়, তাহলে দেখাতে পারি।
আমি অবাক গলায় বলেছিলাম, আমি হিরে পছন্দ করতে এসেছি, হিরে কাটিয়েদের নয়। কিন্তু আটান্ন দিক কেটে বের করছে যারা, তাদের দেখার ইচ্ছেটা আছে।
দণ্ডপথ বললেন, তারা মনের মানুষদের মন কেটে আটান্ন দিক বের করতে পারে।
হেঁয়ালি বুঝলাম না। শুধু চেয়ে রইলাম।
দণ্ডপথ তখন যা বললেন, তা পরে বলছি। তবে… কল্পনা চিটনিসকে প্রথম দেখলাম সেই হিরে কারখানায়।
১৬. মানিক দানার কারখানায়
ইন্দ্রনাথ রুদ্র, আমার অদ্ভুত কাহিনি তোর কাছে উদ্ভট মনে হচ্ছে—তোর চোখে অবিশ্বাসের রোপনি দেখছি, তাই ছোট করে আনছি। মূল কাহিনি থেকে একটু-আধটু ফ্যাকড়া বেরয়। বড় গাছের শেকড় যেমন অনেক, ডালপালাও তেমনি অনেক। সুপুরি, নারকেলগাছের ছোট গপ্পো এটা নয়। এ বড় জাঁকালো-জমাটি ব্যাপার।
জহুরি দণ্ডপথকে চোখে চোখে রেখে কথায় কথায় কেটে কেটে যে ব্যাপারটা কারখানায় ঢোকবার পূর্বাহ্নে জেনেছিলাম, তা অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যি।
এই ব্যাপার আমি হো চি মিন শহরে দেখেছিলাম। ফের দেখলাম সুরাটে। ভিয়েতনামের মিস্টার কিউপিড ইণ্টারন্যাশনাল ম্যাচমেকার্স সার্ভিস সাড়ে তিন হাজার কুমারী… ইয়ে… অক্ষতযোনি, মেয়েদের কাজ দিয়ে একটা বাড়িতে রেখে দেয়… মাইনে দেয় না… কিন্তু বর জুটিয়ে দেয়… ফরেনার বর… অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্যি… গরিব মেয়েরা রীতিমতো দরখাস্ত পাঠিয়ে সেখানে আসে বর জোটাতে… রিয়াল ভার্জিন কি না, তার পরীক্ষা দিতে হয়… ভার্জিনিটি টেস্ট… হাইমেন ছিন্ন হয়েছে কিনা… হাইমেন মানে যে সতীচ্ছেদ, তা তোর মতো চিরকুমারকে বোঝানো দরকার বলেই বললাম… তলপেটে রেখা পড়েছে কিনা অথবা, সিজারিয়ান অপারেশনের কাটা দাগ আছে কিনা, তাও দেখা হয়—আগে পেটে বাচ্চা এসেছিল কিনা জানবার জন্যে… জঘন্য… কিন্তু উদ্দেশ্য মহৎ… আজও এই সংস্থা চালু রয়েছে… তোর যদি সতী বধূর দবকার হয় যেতে পারিস… হাসছিস?
জহুরি দণ্ডপথ ঠিক এই সিস্টেম চালু করেছেন নিজের মাণিক কারাখানায়। স্বয়ংবরা হতে ইচ্ছুক মেয়েদের এনে কাজ শেখান… কাজ করান… বর জুটিয়ে দেন… ভার্জিনিটি টেস্ট করেন কিনা, সেটা জানতে চাইনি… হিমালয়ে আজও দ্রৌপদী গোত্রের মেয়েরা পাঁচখানা বর রাখতে পারে… বিয়ের আগে বা পরে… জানিস না? জেনে রাখ। সেলুকাস, বড় বিচিত্র এই দেশ।
এইসব বাগাড়ম্বর শুনিয়ে মানিক কারখানায় আমাকে ঢুকতে দিয়েছিলেন জহুরিমশাই। ফিকে সবুজ হিরে চোখ দিয়ে একটি মেয়ে আমাকে টেনেছিল। তার নাম কল্পনা। মা নেই, অভাবে পড়ে বদ পথে না গিয়ে বর খুঁজতে এসেছিল জহর কারখানায়।
কল্পনা কাহিনি এখন থাক। জহর কাহিনি হোক।
জহুরি দণ্ডপথ আমার মনের কৌতূহল মিটিয়ে দিয়েছিলেন হিরে পাথরের অলৌকিক শক্তির উৎস শুনিয়ে। ব্যাপারটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে রেখে শুনে রাখ, ইন্দ্র, আখেরে কাজ দিতে পারে।
ফোর্থ ডাইমেনশন নাকি টাইম। আইনস্টাইন এ রকম একটা আভাস নাকি দিয়েছেন। যাকগে…যাকগে… ভুল হলে শুধরে দিস। জহুরি দণ্ডপথ তিব্বত থেকে চিনেদের চোখে ধুলো দিয়ে, শিখে এসেছেন… অজস্র ডাইমেনশন রয়েছে এক-একটা হীরক খণ্ডের মধ্যে। এক-একটা দিক এক-একটা কিউব… ঘনক… রচনা করেছে হিরের মধ্যে… অনেক ঘনক ভেতরে ভেতরে ঢুকে কল্পনাতীত ডাইমেনশন সমষ্টি রচনা করে রয়েছে… শেষ নেই… শেষ নেই… এক-একটা ডাইমেনশনে এক-একটা শক্তি… সূক্ষ্ম শক্তি… আধুনিক কোয়ান্টাম থিওরি তো সবে বলছে, নটা ডাইমেনশন থাকলেও থাকতে পারে… তিব্বতি জ্ঞানীরা বলছেন–এই ব্রহ্মাণ্ড যেমন অনন্ত, এক-একটা হিরে, তেমনি অন্তহীন শক্তিপুঞ্জের আধার… হীরকশক্তির মূল সূত্রটা এইখানেই।
ইন্দ্র, কল্পনাকে পেলাম, রঙিন হিরেদের সৃষ্টি কীভাবে, তাও জানলাম। তিব্বতি প্রক্রিয়ায় সূক্ষ্ম শক্তিদের সংহত করেছেন জহুরি দণ্ডপথ। শুধু জেল্লা দেখানোর জন্যে নয়, বিশেষ বিশেষ শক্তির আধার সৃষ্টি করবার জন্যে…
সেলস টক? হয়তো তাই। হিরে বেচাতে জানেন দণ্ডপথ।
আমি কিন্তু হিরে-বুঁদ হয়ে গেলাম। নন্দিতা, কল্পনা, দণ্ডপথ—এই তিনজনের কাছ থেকে যে জ্ঞান আহরণ করেছিলাম, যে প্রেরণা পেয়েছিলাম—তার তাড়নায় হিরেদের উৎস সন্ধানে টহল দিয়ে গেছিলাম দেশে দেশে… জেনেছিলাম বিস্তর রক্তাক্ত কাহিনি…
অ্যাডভেঞ্চার… অ্যাডভেঞ্চার… অ্যাডভেঞ্চার…
১৭. হিরের খনি! হিরের খনি!
তার আগে শুনে নিয়েছিলাম জহুরি দণ্ডপথের মুখে–হিরে, কত রকমের অভিশাপ টেনে এনো দেশে দেশে, কত রক্ত ঝরিয়েছে… কত রাজ্যের উত্থান আর পতন ঘটিয়েছে…
মানুষটা নিজেই একটা হীরক-ইতিহাস… আশ্চর্য! আশ্চর্য!
শুধু কি তিব্বত, হিরে তাকে টেনে নিয়ে গেছে যেখানে খনি, যেখানে হিরের কারবার… সেইখানে, সেইখানে… কি জানি কেন আমার মতো উজবুককে উনি ‘স্নেহের চোখে দেখে ফেলেছিলেন অথবা কিঞ্চিৎ কৃপাবর্ষণ করেছিলেন–কারখানার কল্পনাকে জীবনসঙ্গিনী করবার পথে পা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলাম বলে… না করেও পারিনি, ইন্দ্র… যা কারও কাছে বলা যায় না, তা প্রিয় বন্ধুর কাছে বলা যায় … কল্পনা আমাকে টেনেছিল কেন? ওর চোখ দিয়ে… ওর চোখ দিয়ে… চিরকাল জুলিয়েটরা রোমিওদের যেভাবে টেনে ধরে… সেইভাবে… যে পন্থায় চুয়া মোহন করেছিল চন্দনাকে… লায়লা-মজনুর কাহিনি রচিত হয়েছে যেভাবে, সেইভাবে… সেইভাবে. .স্রেফ চাহনিবাণ মেরে… মোহন চাহনি দিয়ে আমাকে মগ্ন করে দিয়েছিল… যাচ্চলে… হিরের কথা বলতে বলতে ফের মানবী-হি.লর কথায় চলে এলাম… হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কল্পনা একটা হিরের টুকরো কন্যা…