এটা কিন্তু জহুরিদের, হিরে ব্যবসায়ীদের একটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। হিরের দর তোলার ব্যবসায়িক চাল। তাই কথায় কথায় সব জহুরিই বলে, হিরে! সে তে চিরকালের! হিরে থাকলে সব থাকবে! হিরে স-ব টেনে ধরে রাখে!
ফলটা কি হয়েছে জানিস, ইন্দ্র–আমেরিকান, ইউরোপিয়ান জাপানিজ, ইনিজ মেয়েরা আরও বেশি করে হিবে বসানো আংটি কিনে পরিয়ে দিচ্ছে মনের মতো পুরুষদের আঙুলে…যুগ যুগ ধরে এই রীতিই যে চলে আসছে…মনের মানুষকে যদি পায়ের জুতো বানিয়ে রাখতে চাও,পরিয়ে দাও তার অনামিকায় হিরে গাঁথা একটা আংটি…অপার্থিব কুহেলি রচিত হবে সেই পুরুষের মনের অন্দরে কদরে…মনের আকাশ ছেয়ে যাবে একটিমাত্র রমণীর লালসা মদির মেঘপুঞ্জে।
জহুরিদের এই ব্যবসায়িক বুকনির পিছনে সত্যিই কি কোনও অপার্থিব শক্তির অস্তিত্ব আছে?
এই ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে খোঁচা মেরে চলেছিল অনেক…অনেকদিন ধরে! আমি একটু ইনকুইজিটিভ মাইণ্ডেড, অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী, তা তুই জানিস। হিরে নামক অতি-কঠিন একটা পাথরের সঙ্গে কিংবদন্তী জড়িত রয়েছে কেন যুগ যুগ ধরে, সেই গবেষণায় মন ঝুঁকে পড়েছিল বড় বেশি।
তাই ড়ুব মেরেছিলাম এই ভারতবর্যের পৌরাণিক কাহিনি সাগরে। ইন্দ্র, আজব দেশ এই ভারতবর্ষ। এত পৌরাণিক সম্পদ তুই আর কোনও দেশে পাবি না। এ দেশের লোকগুলো আর কিছু না পারে, লিখতে পারে বটে। মাথা খাটিয়ে বিস্তর ব্যাপার লিখে একালের ধুরন্ধর বৈজ্ঞানিকদেরও মুণ্ড ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে,পুরাণের রূপকের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন রাখা হয়েছে বহু বৈজ্ঞানিক সত্য…দর্শন আর কিছুই নয়, এক এবং অদ্বিতীয় মহাবিজ্ঞানের ঈষৎ আভাস…
কী বলছিলাম? হ্যাঁ, ইণ্ডিয়ান পুরাণ। এখানে কিন্তু বলা হয়েছে, রত্নমাত্রই কসমিক পাওয়ার বিধৃত। ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়ক বিশেষ বিশেষ রত্ন ধারনের পরামর্শ দিয়ে আসছেন জোতিষী মহাশয়রা সেই আদ্যিকাল থেকে আজ পর্যন্ত। বিষয়টা আমার কৌতূহলী মনকে খুচিয়ে গেছিল বলেই আমি গেছিলাম হায়দ্রাবাদে। বসেছিলাম এক জহরত দক্ষ জ্যোতিষীর সঙ্গে। তেলেগু ভাষাটায় যৎকিঞ্চিৎ দখল আছে বলেই তার ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলাম। শুনেছিলাম সেই একই কথা।
প্রেম এবং পরিণয়, সহবাস আর সন্তান উৎপাদন, এমনকী অমরত্ব এনে দেওয়ার ব্যাপারেও জহর মহাশয়দের অব্যাখ্যাত ভূমিকা রয়েছে।
হাসছিস? আমিও হেসেছিলাম—মনে মনে। জহর যদি অমর করে রাখতে পারে, তাহলে আওরঙ্গজেব প্রমুখ জগৎ কুখ্যাত মানুষগুলো আজও বেঁচে থাকত।
এই দ্যাখ! হিরের ঘোরে আবোল-তাবোল বকে যাচ্ছি। ইন্দ্র, হিরে এমনই একটা বস্তু। সর্বনাশ করে! সর্বনাশ করে!
কিন্তু এই বিশ্বাসটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস—স্রেফ আমার। কারণ আমি কুসংস্কার মানি না। কিন্তু মানত সেকালের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মহাগুরুরা। ধর্মের সঙ্গে হিরে পাথরটা যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, এ তত্ত্ব তারা মনে মনে বিশ্বাস করত কি না জানি না, তবে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছিল সাধারণ মানুষদের। তাই, আজও পিল পিল করে মানুষ ছুটে যায় মাদ্রাজের উত্তর-পশ্চিমের তিরুপতি পাহাড়ে-খানে রয়েছে সোনার পাতে মোড়া বালাজি বিগ্রহ। আগাগোড়া হীরক-আকীর্ণ প্রস্তর দেবতা।
আমি অবশ্য মুগ্ধ হয়ে চোখের পাতা না ফেলে চেয়েছিলাম নফুট হাইটের বিশাল সেই বিগ্রহের দিকে। নফুট হাইট কম কথা নয়, তার ওপর মিশমিশে কালো পাথর কুঁদে গড়া। একটা সরু গলিপথের শেষপ্রান্তে রাখা সেই বিগ্রহের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না—এমনই আকর্যণ তার। প্রতিবর্গ সেন্টিমিটারে। লক্ষ্য করেছিস, ‘তার’ বললাম? ভক্তি নিবেদন করলাম। কিছু একটা আছে ওই বিগ্রহর মধ্যে। তা নাহলে আজ আমি হীরক সাম্রাজ্যের একটা কেউকেটা হলাম কী করে!
আজকের ইণ্ডিয়ায় সবচেয়ে পপুলাব বিগ্রহ হতে চলেছে এই বালাজি। আমি চোখের পাতা ফেলতেও বোধহয় ভুলে গেছিলাম। আমার পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল…মাইল কয়েক লম্বা লাইনে…হাজার হাজার ভক্ত…প্রত্যেকের কণ্ঠের বালাজি বদনায় গলিপথ যেন ফেটে চৌচির হতে চাইছিল…থর থর করে কাঁপছিল ওপরে নিচে দু’পাশের পাথর… সেইসঙ্গে মিশেছিল ঝনঝন ঝনঝন ঝনঝন শব্দ…মেশিনের গজরানি…কেন? আরে বাবা, অত রেজকি…দর্শনার্থীদের চাঁদা…না… না…প্রণামী…মেশিন চলছে…বাছাই করে যাচ্ছে…বেগুলার বিজনেস…আওয়াজ হবে না? কান ফেটে যাওয়ার মতো কোলাইল! চাঁদা…ইয়ে, প্রণামী মিটিয়ে, তবে দেখতে হয় বালাজিকে। ধারে কারবার নেই। আশ্চর্য! গণতন্ত্রের দেশে এ কি জুলুম। পয়সা দিয়ে দেবতাকে দেখতে হবে?
যাকগে, হচ্ছিল হিরের কথা, এসে গেল পয়সার কথা। বালাজির মাথার মুকুটটার দিকে চেয়ে আমি চোখের পাতা ভুলে গেছিলাম নিশ্চয়। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। আগাগোড়া হিরে দিয়ে গড়া এমন মুকুট আমি জীবনে দেখিনি, দেখব বলেও মনে হয় না। ওজনে যাট পাউণ্ড…প্রায় তিরিশ কেজি…হিরের সংখ্যা কত জানিস? শুনলে মুণ্ডু ঘুরে যাবে। আঠাশ হাজার।
১৩. হিরের শঙ্খ, হিরের চক্র
চেহারা আর চোখ দেখে যাকে নিরেট পাথর বলেই মনে হয়, সেই রবি রে যে হিরের মুকুট দেখে এভাবে গলে গেছে, তা তো জানতাম না। কথা তো নয়, যেন হিরের ফুলকি ঠিকরে ঠিকরে আসছিল ওর গলার মধ্যে থেকে…হিরের পরশমণি ছুঁয়ে গেছিল ওর দুই চক্ষুকেও…মুহুর্মুহু বিদ্যুৎবহ্নির আভাস জাগছিল ওর বিশেষ গড়নের দুই চোখে…বালাজি-প্রভাব ওকে অবশ্যই উদ্দীপ্ত করেছিল, নইলে ওর মতো চাপা স্বভাবের মানুষ আচম্বিতে এমন উজ্জ্বল হয়ে উঠবে কেন?