রবি বলছে—
ইন্দ্র, আমি নাকি বেঁকা চোখের এক বক্রমানব? এমন বিশেষণ জীবনে প্রথম শুনেছিলাম কল্পনার কণ্ঠে। অথচ আমাকে অতিমানব রূপে মন মঞ্জিলের অন্দরমহলে ঠাঁই দিয়েছে এই কল্পনা। কেন? আমার চেহারার বর্ণনায় হয়তো ও কিছুটা অতিরঞ্জন করেছে। এমনটাই হয়। তাই না? ভাবাবেগ যখন ভালবাসার আবেগে হোমকাষ্ঠ জুগিয়ে যায়, তখন মানুষমাত্রই সোজা চোখে না দেখে বঙ্কিম চোখে নিরীক্ষণ করে যায় নিজের নিজের মনের মানুষদের…নয়ন পাথের পথিক যখন মন পথের পথসাথী হয়ে ওঠে, ঠিক তখন…তাই না?
আমার চোখ…হ্যারে…আমার এই চোখ নাকি বিশ্বকর্মা বিশেষ পাথর কুঁদে বানিয়ে তবে আমার চক্ষুকোটরে সেট করেছেন। ইন্দ্র, তুইও দেখেছিস, আমার ভুরু দুটো সরল রেখায় নেই—দু’টো ভুরু ঢালু হয়ে নেমে গেছে দু’দিকে…ভুরু দু’টোর নিচে চোখের গড়ন দুটোও সেই রকমভাবে বানানো হয়েছে…দুটো চোখই একটু ঢালু—দু’প্রান্তে। যা দেখে কল্পনা আমাকে বলত, তোমার চোখে মেয়ে টেঁকে না…গড়িয়ে পড়ে যায়!
কী কথা! চোখের ঢালু গড়ন আমার মনকে তো ঢালু করেনি। এ মন যে কি মন, আজও তা বুঝে উঠলাম না। আমার বাইরের চেহারার সঙ্গে সমতা রেখে চলেছে এই মন। তাই তো হয়, তাই না রে, ইন্দ্র?
হ্যাঁ, আমার চেহারাটায় একটু পাঠান-পাঠান ভাব আছে। হয়তো আগের জন্মে আমি পাঠান ছিলাম। কাবুল কান্দাহার আফগানিস্তান ইরান-টিরানে রক্তঝ। তুলেছিলাম। আমার নাক চোখা, আমার বাটালি চিবুক সামান্য সামনে ঠেলে থাকে, আমার গালের হনু-হাড় একটু উঁচু-তার নিচে সদা জাগ্রত থাকে দুটো খোদল, আমার চোয়াল রীতিমতো চৌকোণা আর মারকাটারি মার্কা, আমি লম্বায় পাক্কা ছ’ফুট, আমার শরীরে পেশি বেশি-চর্বি কম।
এক কথায়, আমাকে এক নজরে অভারতীয় মনে হয়। সেটাই আমার কর্মজীবনে প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাড়িয়েছে। আমি এই ভাবালু বাঙালিদের মতো কবি-কৰি। নই—জিদও যোলআনা। তবে হ্যাঁ, বোগাস বাঙালি আমাকে বলা যায় না। বাঙালি যে কতখানি বেপরোয়া হতে পারে, তা বিজয় সিংহই শুধু দেখাননি, মহা রহস্যের নায়ক মহামতি সুভাষচন্দ্র বসুও দেখিয়েছেন…।
কিন্তু আমার একটা মহাদোষ আছে। আমি একটু বেশি বকি। ব্রাদার, এই কোয়ালিফিকেশন্টার জোরেই তো দাপিয়ে বেড়াচ্ছি মেডিক্যাল লাইনে…কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে যাই হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত চিকিৎসক মহলে…তাদের ভেতর পর্যন্ত ধোলাই করে দিয়ে চালু করে দিই আমার প্রোডাক্ট…..
একটু ভুল বললাম। এখন আর দিই না। আগে দিতাম। এখন তো আমি হিরের জগতের তারকা…স্টার…তবে হ্যাঁ, গোটা ভারতবর্ষটার শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে টহল দেওয়ার সুযোগ তো পেয়েছিলাম এই প্রফেশনে এসে…
আর দেখে গেছিলাম আমার এই ঢালু চোখ দিয়ে…জেনেছিলাম হিরে নিয়ে কত কাণ্ডই না হয়ে গেছে এই ভারতে…এখন সেই কাণ্ড আর কারখানা ছড়িয়ে পড়েছে তামাম পৃথিবী গ্রহে!
লোকে বলে বটে, আখাম্বা চেহারা থাকলেই কি সব হয়, মাথায় ঘি থাকা চাই। আমার মাথায় ঘি আছে কি গোবর আছে, সেটা বিশ্বকর্মা জানেন। তবে আমার এই পাঠান-পাঠান চেহারাটা কাজ দিয়েছে অনেক। এই চওড়া কাঁধে, আমাদের লেখক বন্ধু মৃগাঙ্ক রায় কাঁধকে বৃষস্কন্ধ বলে—অর্থাৎ ষাঁড়ের কাঁধ। এই কাধে যখন মার্কিনি কাস্টিংয়ের কোট ঝোলাই, তখন আমাকে মার্কিন মুলুকের মানুষ বলেই মনে হয়। তার ওপর ম্যারিকান ঢঙে ইংরেজি বলার কায়দা। ফলে, বিদেশি বাজারে পথ করে নিতে পেরেছি সহজে। এই ঢালু চোখ, এই উঁচু হনু, এই চওড়া কঁধ প্রশস্ত করে দিয়েছে আমার পথ।
হিরের জগতে প্রবেশ করেছিলাম স্রেফ জানবার তাগিদ নিয়ে। আমি সাউথ ইণ্ডিয়ার অনেকগুলো ভাষা গড় গড় করে বলে যেতে পারি। কোস্কানি, তামিলিয়ান, তেলেগু, কানাড়া, কেরালা বচন আমার জিভের ডগায়। তার ওপর এই ড্যাশিং পুশিং ফিগার। কেটে বেরিয়ে গেছি সর্বত্র।
হিরে আমাকে টেনেছিল অথবা বলতে পারিস, আমার টনক নড়িয়েছিল সর্বপ্রথম যেদিন বালাজির বিগ্রহ দেখেছিলাম। মঠ, মন্দির, মসজিদ, গির্জা আমাকে কস্মিনকালেও ভক্তি বিহুল করে তোলে না, তা তুই জানিস। বিধর্মী আমি সবার কাছেই। কিন্তু বচনে দর বলে পথ করে নিই সর্বত্র। এইভাবেই একদিন দর্শন করতে গেছিলাম তিরুপতির বালাজিকে—এত ভক্ত সমাগম কেন হয়, তার হেতু অন্বেষণ করতে।
ইন্দ্র, বালাজি বিগ্রহ দর্শন করে আমার এই বেঁকা চোখ ট্যারা হয়ে যায়নি, এই যথেষ্ট। ইন্দ্রনাথ রুদ, তুই নাকি বহু বিষয়ে বিজ্ঞ পুরুষ, লোকে তাই বলে, অবশ্য এহেন বচনসুধার পিছনে কলকাঠি নাড়ায় আমাদের লেখক বন্ধু মৃগাঙ্ক, ওর কলমকে যদি বাণিজ্যিক কলম বলি, তাহলে ও ক্ষেপে যায়। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি কিঞ্চিৎ বাণিজ্য নির্ভর না হলে কোনও শিল্প এবং সাধনক্ষেত্র কালজয়ী হতে পারে না।
এটা আমার নিজস্ব জীবন দর্শন। আর এই কাঠখোট্টা একান্ত পার্থিব দর্শন নিয়ে বালাজির বিগ্রহ দর্শন করতে গেছিলাম।
হিরে পাথরটা নিছক পাথর নয়। এই পাথরের মধ্যে একটা অপার্থিব শক্তি নিহিত আছে, এমন কথা আমি অনেকদিন ধরে অনেকজনের কাছে শুনে আসছি। ব্যবসাবাজ-জহুরিরা এই প্রবাদের সঙ্গে আর একটা মাত্রা যোগ করেছে। হিরে নাকি প্রেম টেনে আনে, মনের মধ্যে হিরের খনির মতো ভালবাসার খনি বানিয়ে দেয়, বিপুল আবেগ সহজাত করে মনের মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। লাখো উপহারেও যা হয় না, এক কণা হিরে তা করতে পারে।