টুক করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই ধুলো থেকে কি হিরে ভস্ম তৈরি হয়?
হিরে ভস্ম!
যা খেয়ে নাকি নবাব-বাদশারা হারেম ম্যানেজ করে যেত।
স্টুপিড! হচ্ছে হিরে-কথা, চলে গেল হারেমে। ইন্দ্র, তোর মতিগতি বিশুদ্ধ নয়
নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
সেকেণ্ডে কয়েক ব্যাজার থাকবার পর ঝেড়ে উঠল রবি। বললে, ইদ্র, যে হিরেটাকে সেদিন রিভলভিং স্টেজে নেচে নেচে কাটাই হতে দেখেছিলাম, মামুনি হিরে সেটা নয়। একখানা পাথরে আটান্নটা দিক-এক-একদিকে এক-রকম জলুস। সে যে রোশনাই, না দেখলে তুই ধারণায় আনতে পারবি না।
আনতে চাইও না। তুই বলে যা।
জুল জুল করে আমার চোখের দিকে চেয়ে রইল রবি। চোখে চোখে কথা যখন হল না, অর্থাৎ আমার হিরে-নিরেট মাথায় যখন ওর মনের কথা জাগ্রত হল না, তখন বাচন আকারে যে কথাটা বলেছিল রবি, তা এই–
ইন্দ্র, হিরেটা সাইজে ঠিক একটা ডিমের মতো।
অশ্বডিম্বের মতো নয় নিশ্চয়।
নিতান্ত অসময়ে নেহাৎই অপ্রাসঙ্গিক এইরকম অনেক রসিক আমি করে ফেলি। বাক্য বীরাঙ্গনা কবিতা বউদি তখন আমার ওপর তেড়ে ওঠে। হে সুবুদ্ধি পাঠক এবং হে জ্ঞানবতী পাঠিকা, আপনারা দয়া করে সেই ইচ্ছা সম্বরণ করুন। কথার খই অনেক সময়ে খেই ধরিয়ে দেয়।
রবি একটু বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু হীরক-উপাখ্যানে নিমগ্ন থাকার ফলে তা নিমেষে কাটিয়েও উঠেছিল। বলেছিল, ডিম। হিরের ডিম। হিরে-ইতিহাসে এমন অতিকায় ডিম আর জন্মায়নি।
বলতে বলতে স্মৃতির কুয়াশার আবিল হয়ে গেছিল হীরক উপাধ্যায় রবি রে।
আমি ওর ঘোর কাটানোর জন্যে আলতোভাবে বলেছিলাম, অজ্ঞর অজ্ঞতা ক্ষমাঘেন্না করে একটা প্রশ্নের জবাব দিবি?
প্রশ্নটা যে রকম, জবাবটা সেই রকম হবে।
তেড়ে উঠছে দেখে, আলতোভাবে পেশ করেছিলাম কৌতূহলটা, হিরে কি চেঁচায়?
অদ্ভুত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রবি। তারপর বললে, সত্যিই তুই ভাল গোয়েন্দা।
থ্যাঙ্কস ফর দ্য সার্টিফিকেট। কিন্তু…হিরে কি চেঁচায়?
হ্যাঁ, চেঁচায়…মাঝে মাঝে…কাটাই করার সময়ে। জননীর জঠর থেকে বেরিয়ে এসে শিশু যেমন কেঁদে ওঠে, হিরে তেমনি কাঁদে…রূপান্তর ঘটানোর সময়ে।
অ, বলে নিশ্চুপ রইলাম সেকেণ্ড কয়েক।
আর একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম তারপরেই—হিরে কি খানখান হয়ে যেতে পারে বেমক্কা ঠোক্করে?
বিপুল বিস্ময়ে চেয়ে রইল রবি। বললে তারপরে, আঁচ করলি কী করে? হিরে তো কঠিনতম পদার্থ এই পৃথিবীতে…হিরেকে ভাঙা যায় না—এইটাই তো সবাই জানে। ইন্দ্র, তুই একটা জিনিয়াস। হ্যাঁ, হিরেও খান খান হয়ে যেতে পারে—বেঠিক জায়গায় ঠোক্কর খেলে।
হিরে কঠিন মানুষদের মতো—আমি দার্শনিক হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।
হীরকপ্রতীম রবি রে কিন্তু দর্শন-ফর্শনের ধার ধারে না। বললে, এই জন্যেই একজন ঘুরন্ত চাকার নিচে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। হিরে হাত ফসকে গেলে যেন। মাটিতে না আছড়ে পড়ে—লুফে নিতে পারে তার আগেই।
মুখখানাকে বোক চন্দরের মতো করে আমি জানতে চেয়েছিলাম, মস্ত হিরেকে কি কেটে খানকয়েক করা হয়েছিল?
হ্যাঁ…হ্যাঁ…তেড়াবেঁকা ছিল যে আকাটা হিরে।
ক’টা হিরে বেরিয়েছিল?
ছটা।
ছ’টা! খনির হিরের মূল ওজন তাহলে ছিল কত?
দু’শ পঁয়ষট্টি দশমিক বিরাশি ক্যারাট।
পেল্লায় হিরে যে। ডায়মণ্ড মার্কেট কাঁপানো হিরে। বন্ধু, এবার বল তো, এ হিরে কোথাকার হিরে?
কঙ্গোর হিরে।
এই আখ্যায়িকার নামকরণে একটু ভুল করেছি। নাম রাখা উচিত ছিল ‘হিরের ডিম’।
তবে হ্যাঁ, ক্ষুরধার বুদ্ধি প্রয়োগে পাঠক এবং পাঠিকা নিশ্চয় আঁচ করে ফেলেছেন, অনিক্স পাথরের ডিমের সঙ্গে হিরের ডিমের কোথায় যেন একটা মিল আছে।
সবুর…সধুর…আর একটু।
১২. হিরেময় বিগ্রহ-বালাজি
হিরের মধ্যে আছে কসমিক পাওয়ার—অলৌকিক শক্তি—এই বিশ্বাসের বনেদের ওপর গড়ে উঠেছিল এই ভারতের হিরে বিগ্রহ…হিরের দখল নিয়েই রক্তক্ষয়ী লড়াই লেগেছে রাজ্যে রাজ্যে, হিরের লোভেই ছুটে এসেছে লোলুপ বিদেশিরা।
এইসব বৃত্তান্ত আমার কিছু কিছু জানা ছিল, পুরোটা জানতাম না। শুধু বুঝেছিলাম সব অনর্থ এবং অকল্পনীয় আর অভিশপ্ত অর্থ ভাণ্ডারের মূলে রয়েছে হিরে। এবং, একদা এই ভারত ছিল হিরের মূল উৎস।
কঙ্গোর হিরের গল্প শুনতে চেয়েছিলাম রবির কাছে। জানতে চেয়েছিলাম ওষুধের সাম্রাজ্য ছেড়ে কেন এল সে হিরের মার্কেটে। তখন হিরে প্রোজ্জ্বল চোখে আবিষ্ট স্বরে হিরে-ইতিহান শুনিয়েছিল আমাকে—এই রবি রে…
হিরে নাকি সৌভাগ্যের প্রতীক? তবে কেন ঘনিয়ে এল এমন কালো মেঘ তার ভাগ্যাকাশে?
আমি…ইন্দ্রনাথ রুদ্র…শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা দিয়ে বিশ্বাস করি, হিরে একটা ঘণীভূত রক্তঝঞা ছাড়া কিসসু নয়…
কিন্তু সেই কথা টেনে শেষ করে দিতে চাই…স্বপ্নিল চোখে যেসব কথা দুর্মদ রবি রে সেদিন আমাকে বলে গেছিল। ওর জীবনের নিবিড় তমসার সঙ্গে হয়তো সেই কাহিনীর কোথাও না কোথাও সংযুক্তি আছে…নাও থাকতে পারে…কিন্তু ঝড়ের বেগে হিরে ইতিহাস শুনিয়ে আমাকে যেভাবে বিহুল চমকিত বিমুঢ় কবে তুলেছিল রবি রে…তার কিছুটা অন্তত না লিখে যে পারছি না…একটা অদৃশ্য শক্তি আমার কলম টেনে ধরে লিখিয়ে নিচ্ছে…আমি চাইছি না সবুজাভ নয়না কল্পনা চিটনিসের কিডন্যাপড পুত্রের কাহিনির অবতারণা ঘটিয়ে হীরক-উপাখ্যানে আসতে…কিন্তু রুখতে পারছি না…আমার সে শক্তি নেই…কিছু একটা আমার কলমকে ভর করেছে.আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে, লিখতে আমাকে হাবেই…লিখতে আমাকে হবেই…যা শুনেছি, বর্ণে বর্ণে তা লিখে যেতে হবে…রবি রে’র জবানিতে।