আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হিব্রু শব্দটা কী রে?
মজল।
মা-মানে?
গুড লাক।
সিক্রেট শব্দটা ডায়মণ্ডের সমতুল্য। একটু-আধটু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, ডায়মণ্ড মহোদয়রা কক্ষনো জানতে দেয় না কোন ডায়মণ্ড কোন খনিতে আবির্ভূত হয়েছিল। চেহারা দেখে চেনা যায় না। কোন মুলুকের মাল। চেহারা দেখে চরিত্র বুঝতে হবে-জন্মস্থান জানা যাবে না। পাকেও তো পদ্ম ফোটে।
রবি রে ওর ডায়মণ্ড চক্ষুর নৃত্য দেখিয়ে বলেছিল, মাই ডিয়ার ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ওই যে একটা কথা আছে না, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানস্তি, ডায়মণ্ডদের ক্ষেত্রে কথাটা খাটে। জলুস দেখে কেউ বলতে পারবে না–কোন মুলুকের মাল। তুই তো সূত্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ রুদ্র–
ক্ষীণ স্বরে বলেছিলাম, মৃগাঙ্ক থাকলে তোর এই বিশেষণটা লুফে নিত।
বাগড়া পেয়ে থমকে গিয়ে চোখ পাকিয়ে রবি বলেছিল, কোন বিশেষণটা?
সুত্রান্বেষী। একদা আমাকে ছিদ্রান্বেষী বিশেষণ দিয়ে একখানা জম্পেস গল্প বানিয়েছিল। সূত্রান্বেষী…সূত্রান্বেষী…গুড অ্যাডজেক্টিভ।
বিরক্ত হয়েছিল রবি। এটা আমার ইচ্ছাকৃত। কথার টানা স্রোতকে হঠাৎ হঠাৎ ঘুলিয়ে দিতে হয়। আচমকা আচমকা বাগড়া পড়লে অনেক অনিচ্ছার কথা ফুসফাস করে বেরিয়ে আসে। চতুর পাঠক এবং চতুরা পাঠিকা, আপনারা এই টেকনিক বাস্তব জীবনে কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন। রতিপতির বাণ যখন মানব মনকে শিথিল করে দেয়, তখন এইভাবে আলটপকা ঢিল মেরে দেখতে পারেন-অনেক কদর্য কাহিনি বেরিয়ে এলেও আসতে পারে। এই জগতের যারা মাতাহারি, তারা জানে এই গুপ্ত কৌশল। জানে কল্পনা চিটনিস…।
যাচ্চলে, ঘুরে ফিরে সবুজনয়না ফের চলে এসেছে লেখনী অগ্রে…
এবার টেনে কলম চালাচ্ছি। শী বলছিলাম? ও হ্যাঁ, হিরে দেখে অতি ওস্তাদ জহুরিও বলতে পারে না, ধরণীর কোন খনন ভূমিতে ঝিকিমিকি পাথরটির প্রথম আবির্ভাব ঘটেছে। আদিভূমি অজানা থেকে গেলেও হিরের টুকরোর সার্টিফিকেট দিতে কসুর করে না ডায়মণ্ড এক্সপার্টরা। লক্ষ কোটি হিরে-পাথর এই মুহূর্তে পাইপলাইন দিয়ে স্রোতের আকারে বয়ে চলেছে, অথচ তাদের প্রত্যেকেই উৎসবিহীন। এবড়ো-খেবড়ো আকৃতি ঝেড়ে ফেলে ঝকঝকে চকমকে হয়ে উঠছে, কিন্তু কোনমতেই জানতে দিচ্ছে না ধরণীর কোন কোণ থেকে তারা এসেছে।
উৎস অজানা, কিন্তু ঔৎসুক্য কারোরই কম থাকেনি। অ-রূপ পাথরটাকে রূপময় করে তোলার ব্যাপারে। সার্টিফিকেট না পেলে বুনো পাথরে দাম চড়বে কী করে? স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো রবি বলে গেছিল এবড়ো-খেবড়ো অতি কদাকার একখানা পাথরকে মেজে ঘষে কেটে কুটে কীভাবে ৫৮ দিকওয়া হিরে বানানো হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য ওর হয়েছিল নিউইয়র্কে—মানহাট্টান ডিসট্রিক্টের ঠিক মাঝখানে—কড়া পাহাবায় রাখা ওয়ার্ক রুমে এক অপরাহ্নে। হিরে কারিগর ঘুরিয়ে যাচ্ছিল একটা চাকা–পুরনো দিনের গানের রেকর্ড গ্রামোফোনের ওপর বাই বাই করে ঘুরত যেভাবে—সেইভাবে। ঘুরন্ত চাকায় তেল আর হীরক-চূর্ণের আস্তরণ…কুমোরের চাকা ঘুরছে বলে মনে হয়েছিল রবির…বাংলার ছেলে তো…হিরে-কারিগরের সঙ্গে কুমোরের মিল খুঁজে পেয়েছিল মনের মধ্যে…মিল থাকার কারণও ছিল যথেষ্ট…এক তাল মাটিকে যেমন টিপে টুপে মূর্তির অবয়ব ইত্যাদি এনে দেয় কুমোর, প্রায় সেই একই পন্থায় হিরে-কারিগর আকাটা হিরেকে কেটেকুটে খাসা হিরে বানাচ্ছে…একপাশের ফ্ল্যাম্পে আটকানো রয়েছে অধরা হিরে…দু’মাস ধরে সাজাচ্ছে বদখৎ বৃহৎ হীরকখণ্ডকে—খনি থেকে যখন এসেছিল কাটাই-ঘরে, তখন সেই হিরে ছিল অস্বচ্ছ, অর্ধ-আয়তাকার একটা চাই…একপ্রান্ত আর এক প্রান্তের চেয়ে থ্যাবড়া…
অস্বচ্ছ? এই পর্যন্ত শুনে আমি মুখ খুলে ফেলেছিলাম, হিরে আবার অস্বচ্ছ হয় নাকি?
হয় বন্ধু, হয়। ভেতরের ত্রুটি চেপে রেখে দেওয়ার জন্যেই হীরকজননী সত্তানতুল্য হিরেকে ঈষৎ ধোঁয়াটে রেখে দেয়।
ধোঁয়াটে হিরে!
আজ্ঞে। মনে হয় যেন এক তাল কুয়াশা জমাট হয়ে রয়েছে ভেতরে। ঘুরন্ত সেই হিরোকে কয়েক মিনিট অন্তর চোখের সামনে তুলে ধরে অন্তর্ভেদী চোখে চেয়ে থাকে হিরে-কাটিয়ে…আমি যাকে দেখেছি, এ ব্যাপারে তার মতো ওস্তাদ খুবই কম আছে এই দুনিয়ায়…তিরিশ বছর ধরে শুধু হিরে কাটছে…কাটছে…কাটছে। যে হিরেটাকে দেখেছিলাম গ্রামোফোন ডিস্কের মতো চাকার ওপর ঘুরতে, সেটার পিছনে লেগেছিল মাস দেড়েক…একখানা হিরে কাটতে দেড় মাস।
বিড় বিড় করে বলেছিলাম, সাধারণ হিরে নিশ্চয় নয়।
একেবারেই নয়। সত্যিই অসাধারণ। জীবনে এমন হিরে আমি দেখিনি, ইন্দ্র। আর আমাকে তা দেখানোর জন্যে, আমার চোখ তৈরি করার জন্যে—দেওয়া হয়েছিল দুর্লভ এই সুযোগ।
যোগ্য বলেই প্রশংসাটা করেছিলাম অন্তর থেকে। রবি রে অকারণে রবি রশ্মি হয়নি। হীরক রশ্মির জগতে ও দুম করে চলে আসেনি। জীবন বিপন্ন করে দেখেছে, অন্তরশক্তিকে জাগ্রত করেছে-তবেই না, অধুনা ব্যাঙ্গালোরের ডায়মণ্ড কমপ্লেক্সের জনক হতে পেরেছে। হৃদয়জাত শক্তি দিয়ে চিনেছে পৃথীজাত পাথরকে…
কিন্তু চিনতে পারেনি ত্রাটক যোগসিদ্ধা কল্পনা চিটনিসকে।
দম নিয়ে ফের শুরু করেছিল রাব—এই যে দিনের পর দিন একটা মাত্র হিরে পাথরকে অনবরত মেজে ঘযে কেটেকুটে যাওয়া,এর মধ্যে আসল আর্টটা কি জানিস?
অপচয় যাতে কম হয়, আলটপকা বলে দিয়েছিলাম আমি।
দ্যাটস রাইট; খুশি উপচে পড়া চোখে বলেছিল রবি রে, কাটতে গিয়ে, পালিশ করতে গিয়ে যেন বেশি হিরে ধুলো হয়ে না যায়—