কিন্তু রবি চলে ডালে ডালে, আমি চলি শিরায় শিরায়। মৃগাঙ্ক লিখিত মদীয় কাহিনি সমুচয়ে নিশ্চয় আমার এই মূল মস্তিষ্ক ক্ষমতাটা যথাযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়ে এসেছে। যতই ছাইপাশ লিখুক না কেন মৃগাঙ্ক, চরিত্রের মূল সুর ও ঠিক ধরতে পারে। আমি যে কি মাল, তা কিন্তু জানা ছিল না রবি রে’র কথার স্রোতে ওকে ভাসিয়ে রেখে, কিছুমাত্র বুঝতে না দিয়ে, কথার উপলখণ্ডে ঠোক্কর খাইয়ে নিয়ে এসেছি এমন একটা বিন্দুতে, যা এই হিরে নিয়ে তথ্যভিত্তিক রহস্য কাহিনির মূল উপপাদ্য…
কেন্দ্রবিন্দু।
আমতা আমতা ঢঙে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রবি, আমি আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবর রাখি না।
সবেগে মস্তিষ্ক চালনা করে রবি বলেছিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোর মুরোদ এই বেঙ্গলে-যত্তোসব ছিচকে কেস নিয়ে মস্তানি দেখিয়ে–
নিমেষে চলে এলাম সার কথায়। বললাম, ভিজে বেড়ালের মতো, একট। গুজব কানে এসেছে, উদ্ভট গুজব…স্রেফ গুজব…পাকা খবর নয়…আনকনফার্মড রিপোর্ট।
ঝেড়ে কাশলেই তো হয়। তেলাচ্ছিস কেন?
চতুর এবং চতুর্মুখ রবি রে বুঝতেই পারেনি ওটা আমার অভিনয়। সাধে কি কবিতা বউদি আমার পেছনে লাগে। মিনমিন করে বলেছিলাম, পাছে অপযশ করা হয়ে যায়, তাই কাউকে বলতে পারি না…সাংবাদিকদের কানেও কথাটা গেছে কি না জানি না…
অসহিষ্ণু স্বরে বলেছিল রবি রে, কথাটা কী?
ইয়ে, মানে, ওসামা বিন লাদেনের টেররিস্ট অরগানাইজেশন–
আল কায়েদা?
হ্যাঁ, হা, এরা নাকি এই অপারেশনে আছে? ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের মার্চ, ২০০২ সংখ্যার ২০ পৃষ্ঠায় ২০ এই সংবাদের আভাষ দেওয়া হয়েছে।
অমনি সতর্ক হয়ে গেছিল বকমবাজ রবি রে। ওম হয়েছিল মিনিটখানেক। তারপর বলেছিল হুঁশিয়ার স্বরে—ইন্দ্র, তুই আদার ব্যাপারি, আমি হিরের ব্যাপারি—ওষুধের জগত থেকে হিরের জগতে চলে এসেছি স্রেফ জ্ঞানবান হওয়ার জন্যে…যে জ্ঞান আখেরে কাজ দেবে…কিন্তু গুপ্ত সংগঠনের ব্যাপার-ট্যাপার—
গুপ্তই থাকুক, ঝটিতি বলেছিলাম আমি। কেন না আমার যা জানবার, তা জানা হয়ে গেছিল।
১১. আট লাখ হিরে শ্রমিকের দেশ—এই ভারত
উইপোকা আর লাল কাঁকড়া বিছে পাহারা দিয়ে চলেছে হিরের যে খনি অঞ্চল, তা নিয়ে আরও কথা বলতে ভুলেই গেছিল কুশলী বক্তা রবি রে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ লাইনটাই তো বকমবাজদের লাইন-আজকাল অবশ্য মেয়েরাও এই লাইনে লাইন দিয়ে নামছে। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাম-টামও করে ফেলেছে। কেন না, সুধী ব্যক্তি মাত্রই জানেন, ঈশ্বর মহোদর নারীজাতিকে জিহ্বা সঞ্চালনের ক্ষমতা কিঞ্চিৎ অধিক দিয়েছেন, সেই সঙ্গে দিয়েছেন কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতা। বুদ্ধিমত্তার ক্ষিপ্রতা এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় দশভুজা হতে পারে শুধু তারাই…
যাচ্চলে, আবার কল্পনা-কাহিনিতে চলে আসছি নাকি? যত নষ্টের গোড়া অবশ্য সেই সবুজময়না—কিন্তু তার আগে আরও কিছু বলে নেওয়া যাক…, যা-যা জেনেছিলাম মহা ডানপিটে রবি রে’র পেট থেকে…
হিরের খনির ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে হেঁট হয়েছিল বলে ধমক খেয়েছিল রবি রে। তারপর কি হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আর না গিয়ে চলে এসেছিল এই পৃথিবীর ডায়মণ্ড বাজারে হৃৎপিণ্ড যেখানে, সেইখানে-অ্যান্টওয়ার্প রেলরোড স্টেশনের পাশের তিনটে রাস্তায়-কালাহারির কথা আধাখাচড়া রেখে দিয়ে এমন একটা জায়গায়—হিরে যেখানে উড়ছে। খনি থেকে তোলা এবড়ো-খেবড়ো অতিশয় অসুন্দর। হিরেদের শতকরা আশিভাগের লেনদেন হচ্ছে সরু সরু তিনটে রাস্তায় আর এই বিশাল হিরে বাজারের শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের অন্য অন্য শহরেও।
আমি প্রকৃতই জ্ঞান বুভুক্ষুর মতো জানতে চেয়েছিলাম, রবি, সে শহরগুলো কোথায় রে?
নিউইয়র্কে, লণ্ডনে, তেল আভিভে, আর বোম্বাইতে।
বোম্বাইতে!
অপেরা হাউস ডিসট্রিক্টে কখনও যাসনি?
সেটা কোথায়?
বোম্বাইতে।
বম্বে যে একটা ডায়মণ্ড সিটি, আমার তা অজানা ছিল না। এত বুক নয় এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র। বম্বে একা এখন আর ডায়মণ্ড সিটি নয়, এই গৌরব ছড়িয়ে পড়েছে ইণ্ডিয়ার অন্য অন্য শহরেও।
যেমন, ব্যাঙ্গালোরে।
ব্যাঙ্গালোরের সুনাম অনেক দিক দিয়ে। ছিল গার্ডেন সিটি, হল আইটি সিটি, এখন শুতে চলেছে ডায়মণ্ড সিটি…শুধু একজনের উদ্যমে। তার নাম শ্রীযুক্ত রবি রে। এত লম্বা কাহিনি সেই কাহিনিরই ভূমিকা।
রবি অনেকদিন ধরেই স্বপ্ন দেখেছিল, এই পৃথিবীর সেরা সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, ভারতকে আবার সেই রত্নময় ভারতের জায়গায় নিয়ে যাবে।
বাঙালির ব্রেন যখন খেপে ওঠে, তখন সে পারে না, এমন কিছু নেই। ওষুধ বিক্রির সুযোগকে হাতিয়ার করে ও ঢুকে গেছিল হিরের জগতে…এই ভারতের হীরক দুনিয়ায়…যে দুনিয়ায় আট লাখ শ্রমিক নানা শহরে বসে আকাটা হিরে কেটেকুটে খাসা হিরে বানিয়ে চলেছে…সাইজে এক ক্যারাটের কম হলেও ঝকমকে হিরের কণা বের করেছে…রমণীর নাকের জেল্লা বাড়িয়ে দিচ্ছে…ফলে, শুধু নাক নেড়েই কেল্লা মেরে দিচ্ছে মেয়েরা। ‘
মূলে রয়েছে আট লাখ হিরে কারিগর!
আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম রবিব হিম্মৎ কাহিনি শুনে। কি অসাধারণ বুকের পাটা। যে বাজারে গুজব ভাসছে হাওয়ায়, যেখানে হিরের দাম ঠিক হয়ে যায় শুধু চোখের ইশারা আর একটি মাত্র হিব্রু শব্দ উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে, সেই বাজারে বাংলার ছেলে জাঁকিয়ে বসেছিল শুধু ব্রেন আর ব্যক্তিত্ব খাটিয়ে।