উপুড় করে দেওয়া হয় একশো পঁচিশ জোড়া হীরক চক্ষুর সামনে। হিরে দেখে তারা নয়ন সার্থক করবে, মনে মনে দাম যাচাই করে নেবে, কিন্তু মুখে দাম হাঁকতে পারবে না। কেনাবেচার হাটে এ-এক কিম্ভুত ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থার অন্যথা হয়নি আজও।
কী সেই ব্যবস্থা?
দাম হাঁকবে হিরের মালিক। খনি ছেচে হিরে তুলে এনেছে যে, সে। হিরে নিতে হবে সেই দামেই। দরদামের কারবার নেই। নিতে হয় নাও, নইলে যাও! এই নিয়ম শিথিল হয় শুধু একটি ক্ষেত্রে। বড় হিরের ক্ষেত্রে। যে হীরক-খণ্ডদের ওজন ১০.৮ ক্যারাটের চেয়ে বেশি।
থ’ হয়ে শুনছিলাম হীরক-বাণিজ্যের থরথর কাহিনি। সকৌতুকে আমার মুখপানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হিরে-ধারালো গলায় বলেছিল রবি রে, কি রে ইন্দ্র, চোখ যে ছানাবড়া করে ফেললি!
স্রষ্টানামক ভদ্রলোক আমার চোখেও নাকি দু’খণ্ড কমল হিরে বসিয়ে দিয়েছেন-আমাকে নিয়ে আবোল-তাবোল গল্প লেখবার সময়ে বন্ধুর মৃগাঙ্ক প্রায়শ সেই উপমা টেনে আনে। আর, ওর বউ, দাপুটে কবিতা বউদি, তো যখন-তখন পিছনে লাগে আমার এই হিরে চোখের জন্যে। বলে, জলুস দিয়ে। মেয়ে টানা হচ্ছে, আবার যাচাই করাও হচ্ছে-কাচ, না, পাথর!
আমি, সেই ইন্দ্রনাথ রুদ্র, মূক হয়ে রইলাম হীরক সওদাগরি বৃত্তান্ত শুনে।
তারপর, বোধহয় মিনমিন করেই, জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু এই প্রথা যারা ভঙ্গ করে? হেঁকে হেঁকে দাম তোলে?
একশো পঁচিশ জনকে একসঙ্গে না ডেকে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। এক-একজনকে ডেকে নিজের জিনিস বেচা অন্যায় তো নয়।
ইন্দ্র, হীরক বাণিজ্যে সেটা ঘোরতর অন্যায়। অলিখিত এই কানুন যে ভাঙে, অতিলোভী সেই হীরক-সওদাগরের কপালে লেখা থাকে অনেক শাস্তি।
কীভাবে?
হাতে মেরে নয়, ভাতে মেরে।
কীভাবে? কীভাবে? সেটা হয় কীভাবে?
একটা পন্থা হলো, বাছাই করা হিরের স্রোতে বাজার ভাসিয়ে দিয়ে।
যাতে দর ভোলা হিরের দর পড়ে যায়?
হ্যাঁ, বন্ধু, হ্যাঁ। অভিনব পন্থা। হিরের দাম ফেলে দিয়ে হিরে লোভীর সর্বনাশ করে দেওয়া।
থ’ হয়ে গেছিলাম শাস্তি দেওয়ার পন্থা-প্রকরণ শুনে। হিরে একটা সর্বনাশা পাথর। হিরের মধ্যে আছে ধরিত্রীর অভিশাপ। আমার মূল কাহিনি তার প্রমাণ। কলম ধরেছি তো সেই কথা বলবার জন্যেই।
অনিক্স পাথরের ডিমের মধ্যে ছিল সেই অভিশাপ। যে অভিশাপকে টেনে এনেছিল সবুজ চক্ষু কল্পনা চিটনিস। গায়েব হয়েছিল তার চোখের মণি-পেটের ছেলে–সোমনাথ।
বাজারে হিরে পাথরের ঢল নামিয়ে দাম ফেলে দেওয়ার ফিকির আমাকে চমৎকৃত করেছিল বিলক্ষণ। তাই প্রশ্নাকারে ঔৎসুক্য ঠিকরে এসেছিল মুখ দিয়ে
রবি, এত হিরে আসত কোত্থেকে? কার হিরের গুদাম থেকে?
ঈষৎ হাস্য করে জবাব দিয়েছিল রবি—ডি বিয়ার্স নামক এক হীরক বণিকের কিংবদন্তীসম একটা হিরের গুদোম আছে লণ্ডনের হেড কোয়ার্টারে। কখনও-সখনও হিরের ঢল নামানো হতো এই গুদাম থেকে বাছাই করা হিরের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো হীরক-মার্কেট—কেঁপে যেত দুনিয়া।
শুধু একটা গুদোম থেকে? আমতা আমতা করেছিলাম আমি—তা কি করে হয়? লণ্ডনের এত ক্ষমতা?
ইন্দ্র, ইংরেজরা জাত বণিক! বণিকে মানদণ্ড—
ছেঁদো কথা রাখ। প্রতিদ্বন্দ্বী দড়ায়নি? পালটা হিরে গুদোম?
পয়েন্টে চলে এসেছিস। হ্যাঁ, দাঁড়িয়েছে–কালক্রমে। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া কানাডায়। বিশেষ করে ইজরায়েলের এক জহুরি-চক্র তাসখন্দ থেকে হিরে-ভেলকি দেখিয়ে কোণঠাসা করে এনেছে লণ্ডনের হিরে জাদুকরদের। রুশ হিরের নিয়ন্ত্রণ এখন তাসখন্দের মুঠোয়।
রবি, আমার মস্তক ঘূর্ণিত হচ্ছে।
বেচারা বাঙালি। গোয়েন্দাগিরিই তোর দৌড়। হিরে-দৌড়ে পাল্লা দেওয়া তোর কম্মো নয়। মাই ডিয়াব ডিটেকটিভ, হিবের সঙ্গে সোনা আর রূপোর কোনও তুলনাই হয় না। বাজার এক্কেবারে আলাদা। এক দামে হিলে কিনে সেই জহুরির কাছেই সেই একই দামে হিরে বেচা যায় না, জহুরি তার প্রফিট রাখবেই। সোনার দোকানে ঝোলে দৈনিক সোনার দাম, দৈনিক হিরের দাম ঝোলে না কোথাও। সেই দাম থাকে হুরির পেটের মধ্যে। ঝোপ বুঝে কোপ মারে। হিরে সেই কারণেই স্রেফ অমূল্য।
অ-মূল্য!
আজ্ঞে। ইরান বিপ্লবের দুঃসময়ে মুহূর্তের নোটিশে দেশ ছেড়ে পয়াকার দেওয়ার সময়ে এক ব্যক্তি কি করেছিলেন? বাড়ি বিক্রি করবার সময়ও পাননি, ব্যাঙ্কে যাওয়ার সময়ও ছিল না—সঙ্গে নিয়েছিলেন শুধু পাথর ভর্তি ব্যাগ।
হিরে পাথর?
হ্যাঁ। যার দাম তিরিশ মিলিয়ন ডলার।
আমি নির্বাক থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলাম। তিরিশ মিলিয়ন ডলার মানে যে কত কোটি রজত মুদ্রা, সে হিসেব সেই মুহূর্তে ভোঁ ভোঁ মাথায় আসেনি।
আমার হতভম্ব মুখভাব তারিয়ে তারিয়ে নিরীক্ষণ করে নিয়ে মুচকি হেসে বলেছিল হিরে-ধুরন্ধর রবি রে, হিরে এক রকমের কারেন্সি। পত্রমুদ্রা, মানে নোট, রজতমুদ্রা, স্বর্ণমুদ্রার মতো হিরেও একটা মুদ্রা। এ মুদ্রার দাম নির্দিষ্ট হয় জহুরির চাতুরির দৌলতে-গভর্নমেন্টের কোনও হাত নেই হিরের দাম বেঁধে দেওয়ার। হে বন্ধু, তাই মনে রেখ, যার হিরে আছে, তার সব আছে। দুনিয়া তার মুঠোয়। ইণ্টারন্যাশনাল কর্জ, দেনা শোধ, ঘুষ দেওয়া, অস্ত্রশস্ত্র কেনা—এই ধরনের বহু ব্যাপারে অন্য যে-কোনও মুদ্রার চেয়ে বেশি কাজ দেয় হিরে-মুদ্রা।
আমার চক্ষুযুগল নিশ্চয় বিলক্ষণ বিস্ফারিত হয়ে গেছিল হীরক-কীর্তন শুনতে শুনতে। দুই মণিকায় কৌতুক নৃত্য জাগ্রত করে বিষম আমোদে তা নিরীক্ষণ করে যাচ্ছিল হিরে পাটোয়ার রবি রে।