শুধু কি উই…কঙ্করাকীর্ণ সেই পার্বত্য এলাকায় থুক খুক করছে অস্ত্র পাহাড়ি কঁকড়া বিছে…তারা লুকিয়ে থাকে পাহাড়ের অন্দরে কন্দরে…কিন্তু পিল পিল করে বেরিয়ে আসে মানুষের গন্ধ পেলেই আনেক…অনেক বছর আগে পেশোয়ারের পাষণ্ডরা প্রাণদণ্ড দিতে গ্রহণ করেছিল এহেন নিষ্ঠুর উল্লাসের পন্থা…গর্দান না নিয়ে শুধু গর্দান আর মুণ্ডটুকু বের করে রেখে বাকি শরীরটা পুঁতে রাখত মাটির মধ্যে… পিল পিল করে ধেয়ে যেত লোহিত বর্ণের বিভীষিকা জাগানো কঁকড়া বিছে…
বীভৎসর বর্ণনায় আর যেতে চাই না। ফিরে আসা যাক উইপোকা রক্ষিত হীরক ভাণ্ডারের রোমাঞ্চ জাগানো কাহিনিতে।
ফিকে সবুজ রঙের পাথর-পাঁচিল মাথা তুলে খাড়া ছিল পথের দু’পাশে…পাহাড় দুর্গের এমন রঙের প্রাচীর স্বয়ং প্রকৃতি নির্মাণ করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে…রবি রে আর মাহী বেঞ্জামিনের ট্রাক নাচতে নাচতে ধেয়ে যাচ্ছিল এহেন উপল সমাকীর্ণ পথের ওপর দিয়ে…
মাহী এই অভিযানের পথপ্রদর্শক এবং নেতা। তার একটা গালভরা পদও আছে—মিনারেল রিসোর্স ম্যানেজার…সরল বাংলায় যার অর্থ-রত্নসম্পদ ম্যানেজার। খনিজ সম্পদ বললে যথার্থ হয়। কিন্তু এ খনিতে আছে যে শুধু রত্ন।
রবি রে’র সঙ্গে তার দোস্তি যে সব কারণে, তার সবিস্তার বর্ণনা এ কাহিনিতে নিষ্প্রয়োজন—অতএব তা উহ্য থাকুক।
ওরা চলেছে জবানেঙ্গ রত্ন-গহুরের একদম তলদেশ অভিমুখে। হ্যাঁ, ধরণীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্নময় খনি এই জবানেঙ্গ খনি। যার ভাণ্ডারে থরে থরে সঞ্চিত রয়েছে অতুলনীয় হীরক সম্পদ-মা-পৃথিবী বানিয়েছেন বহু সংহারক তাণ্ডবলীলার মাধ্যমে…সযত্নে সঞ্চয় করে রেখেছেন নিজের গভীর গোপন জঠরে…
কিন্তু ধূর্ত মানুষ সন্ধান পেয়েছে সেই জঠর-গহ্বরের, উইয়ের দৌলতে…অযুত নিযুত বছর ধরে ছোট ছোট ডালিম দানার মতো বজ্র মণিদের জুড়ে জুড়ে বৃহৎ সুবৃহৎ প্রকাণ্ড মণি বানিয়েছেন প্রকৃতি-জহুরি, লোহা-টাইটানিয়াম-অক্সিজেনের সমাহারে নির্মাণ করে গেছেন কৃষ্ণকায় খনিজ পাথর ইলমেনাইট-যে সবের মধ্যে গেঁথে চোথে লুকিয়ে রেখেছেন হিরে…হিরে…হিরে…পুঁতে রেখেছেন একশো বিশ ফুট গভীরের বালি আর পাথরের মধ্যে…লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা কল্পনাতীত সেই ঐশ্বর্য ভাণ্ডারের দিকে ধেয়ে চলেছে হীরক-অন্বেষীদের এই ট্রাক…
হীরক উত্তোলন অতিশয় ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। ফি বছরে নব্বই বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করে যেতে হয় এই খনির পিছনে। এই খনি, সেই সঙ্গে আবও দু’টো খনির সন্ধান পাওয়া গেছে প্রথম কিমবারলাইট পাইপ আবিষ্কৃত হওয়ার পর… ১৯৭৩ সালে…তারপর থেকেই আফ্রিকার মানুষদের কপাল ফিরে গেছে…তাদের জীবনযাপনের মান এখন চোখ টাটানোর মতো।
স্রেফ হীরক ভাণ্ডারের দৌলতে! হিরে-নিহিত আগ্নেয়-পাথর কিমবারলাইট সেই ভাণ্ডার…হীরক ভাণ্ডার…দক্ষিণ আফ্রিকার কিমবারলি অঞ্চলে যে হীরক শিরার আবিষ্কার ঘটে সর্বপ্রথম।
ট্রাক থেকে নেমে খনির তলদেশে পৌঁছে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল রবি রে—
অবিরাম বিস্ময়ের চোটপাট আঘাতে যে কি না বিস্ময় কি বস্তু, তা একেবারেই ভুলে মেরে দিয়েছিল। গহ্বরের দেওয়াল হাজার ফুট উঠে গিয়ে ছাদ নির্মাণ করেছে অনেক উঁচুতে। হেঁট হয়ে মেঝে পরখ করবার অছিলায় যখন বুট জুতোর ফিতে বাঁধছিল রবি রে, মাহী গর্জে উঠেছে কানের কাছে—খবরদার! মেঝেতে হাত দেবেন না।
কেন? ধরণী স্পর্শ তে নিষিদ্ধ নয় কোনও দেশেই?
মানুষ মাত্রই একদিন না একদিন ধরণীর ধুলোয় মিশে যায়, তাহলে ধরণী স্পর্শ নিষিদ্ধ হতে যাবে কেন?
প্রশ্নটা রবি রে’র দুই চোখে নৃত্য করে ওঠার আগেই ‘কেন’র উত্তর জুগিয়ে গেছিল হীরক-প্রহরীদের সর্দার মাহী বেঞ্জামিন।
পাথরের এই সমুদ্রে এক পিস হিরে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। পঞ্চাশ লক্ষ পিস সমান সাইজের নুড়ি ঘাঁটলে পাবে এক পিস হিরে। তা সত্ত্বেও সিকিউরিটি বড় সজাগ। রিমোট ক্যামেরা নজর রাখছে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে। আসবার সময়ে তোমাকে যতটা সার্চ করা হয়েছে, এখান থেকে বেরোনোর সময়ে তার চেয়ে বহুগুণ সার্চিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এক রতি হিরে নিয়েও এ তল্লাট থেকে বেরোনোর হিম্মৎ কারও নেই। পুরো কমপ্লেক্সটাকে কিভাবে উঁচু বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, তা তো নিজের চোখেই দেখে এলে আসবার সময়ে।
হেঁয়ালির ঢঙে বলেছিল রবি রে, কেন, বন্ধু, কেন? অনেক সিকিউরিটি পেরিয়ে এলাম-চোর যে নই, ওপরওলা তা জানে। তবে কেন এত অবিশ্বাস, এত অপমান?
কারণ, হিরে পেলেই মানুষ মাত্রই তা কাছে রাখে। এই স্বভাব রয়েছে যে প্রতিটি মানুষের মধ্যে। হিরে হাতছাড়া কেউ করে না…কেউ করে না।
রবি রে কি তা জানে না? হিরের টানকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হিরের দামকে আকাশছোঁয়া করে দিয়ে–দামের এহেন উত্থান কিন্তু সম্পূর্ণ তৈরি করা। আসল দাম যা হওয়া উচিত, নকল দাম তার চেয়ে ঢের বেশি করে রাখা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে—হীরক বাণিজ্যের ঘুঘু বণিকরা জানে, কীভাবে হিরে লোভীদের চক্ষু চড়কগাছ করে দিয়ে টাক থেকে টাকা খসিয়ে আনতে হয়।
এবং সেটা হয় কিভাবে?
ডিম্যাণ্ড আর সাপ্লাইয়ের মধ্যে ফারাক রেখে দিয়ে। যে জিনিস যত কম পাওয়া যায়, সেই জিনিসের জন্যে মন বেশি লালায়িত হয়। সিম্পল থিওরি।
রবি রে কি তা জানে না? হিরে বাণিজ্যের অবিশ্বাস্য কেনাবেচার খবর-টবর নিয়েই তো অনেক কলকাঠি নেড়ে ঢুকতে পেরেছে পাতাল প্রদেশের এই হীরক ভাণ্ডারে। খনি থেকে তোলা হিরের থলি রাখা হয় মাত্র একশো পঁচিশ জন হীরক-সওদাগরের সামনে। তামাম দুনিয়া ঘেঁচে বেছে নেওয়া হয় এই একশো পঁচিশজনকে–অনেক রকমভাবে হুঁশিয়ার হয়ে। হিরে বেচা আর আলু-পটল বেচা, এক জিনিস নয়। হিরে যে বেচবে, সে খুঁটিয়ে খবর নেয় হিরে যে কিনবে–তার সম্পর্কে। তারপর, তাদের জড়ো করা হয় বছরে একবার—দু’জায়গায়-লণ্ডনে আর জোহান্নে সবার্গে। তারপর, হলুদ রঙের একটা প্লাস্টিক ব্রিফকেস আনা হয় তাদের সামনে, যার মধ্যে থাকে একটা প্লাস্টিক জিপ ব্যাগ। হিরে ভর্তি। আকাটা হিরে।