লরিতে তোলা হলো। পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের জড়োয়া-জঞ্জাল।
আমি ইন্দ্রনাথ রুদ্র, মূক থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলাম সেই মুহূর্তে এক বিলিয়ন মানে মিলিয়ন মিলিয়ন। এক মিলিয়ন মানে দশ লক্ষ। কত লক্ষ, কত কোটি মুদ্রা মূল্যের জঞ্জাল নিয়ে লরি বোেঝাই করা হয়েছিল, বিপুল বেগে মস্তিষ্ক চালনা করতে করতে সেই হিসেব করবার ব্যর্থ প্রয়াসে নিমগ্ন হয়েছিলাম। বিশেষ করে হিসেব এবং অঙ্কশাস্ত্রে আমি যখন নেহাতই কাঁচা।
আমার মুখভাব নিশ্চয় বিহুল আকার ধারণ করেছিল। রবি রে তা অবলোকন করে বিলক্ষণ প্রীত হয়েছিল। সহাস্যে বলে গেছিল, ইন্দ্র, হিরে নামক পাথরটা পাথর-হৃদয় ললনাদের প্রাণাধিক প্রিয় দোস্ত হতে পারে, কিন্তু হিরে ব্যবসায়ীরা ওই কুহাকে ভোলে না। তারা চলে সরল পাটিগণিতের হিসেবে। প্রতি বছর পৃথিবীর বুক খুঁড়ে তোলা হয় একশো কুড়ি মিলিয়ন ক্যারাট ওজনের আকাটা হিরে। রাফ ডায়মণ্ড।
একটু থ’ হলাম। কিন্তু মুখে সেই ব্যঞ্জনা আনলাম না। সপ্রতিভ স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কত টন বল, মাথায় ঢুকবে।
চব্বিশ টন।
এবার ঢোঁক গেলার প্রবল ইচ্ছেটাকে প্রবলতর সংযম সহকারে সামলে নিয়ে বললাম, চব্বিশ টন! হিরে!
আজ্ঞে! যা ধরে যায় একটা মাত্র ট্রাকে। এক ট্রাক হিরে-জঞ্জাল বিক্রি হয় কিন্তু মাত্র সাত বিলিয়ন ডলারে। যে জঞ্জাল তুলতে খরচ হয়েছে দু’বিলিয়ন ডলার বেচে লাভ হয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। লাভের অঙ্কটা কী মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো নয়?
আমি, চৌকস নামে পরিচিত এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ভ্যাবাচাকা ভাবটাকে ম্যানেজ করে নিয়ে বলেছিলাম সপ্রতিভ স্বরে, খদ্দেরদের কাছে, মানে, হিরে-চোখো মেয়েগুলোর কাছে এই হিরে যখন ঝকঝকে চকচকে হয়ে গিয়ে পৌঁছয়, তখন কামায় কত ডলার?
বেশি না, মুচকি হেসে বলেছিল রবি রে, পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার। অলঙ্কার-টলঙ্কারে সেটিং হয়ে যাওয়ার পর।
এইবার আমার মাথা ঘুরে গেছিল। বুরবক মেয়েগুলোর জন্যেই চলছে হিরে নিয়ে এলাহি কারবার। এক লরি হিরের জঞ্জাল মেয়েদের মানিব্যাগ থেকে বের করে আনছে পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার।
মাই গড!
০৯. কালাহারি মরুভূমির হিরের খনি
বিচিত্র এবং অতীব বিস্ময়কর এই হীরক আখ্যায়িক পঠন নিরত অবস্থায় গৃহলক্ষ্মীরা অবশ্যই ভ্র-কুঞ্চন এবং বিবিধ আপত্তিকর মন্তব্যের সমাহার ঘটিয়ে চলেছেন। কাহিনির পত্তন ঘটেছিল কল্পনা চিটনিসের পুত্র অপহরণ দিয়ে… অপহৃত সেই বালকের পুণরুদ্ধার কাহিনির মধ্যে না গিয়ে বেরসিক এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র সহসা হীরক-অবর্তে ঘূর্ণমান হচ্ছে কেন—নাসিকাকুঞ্চন সহকারে এইটাই তো অভিযোগ?
বিশ্বের বিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই একটি পরম সত্যে অবহিত থাকেন। মা লক্ষীরা বড় ধৈর্যহীনা। ধৈর্য, তিতিক্ষা, সহিষ্ণুতা—এই তিন মহাগুণ থেকে এ বপিত। ঈশ্বর ইভ সৃষ্টিকালে ধরণীর প্রথম রমণীকে বহুবিধ রঞ্জণী বস্তু দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন—কিন্তু ভূলক্রমেই হোক বা ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবেই হোক—এই মহাগুণত্রয়ের সন্নিবেশ ঘটাননি জিন গঠনে।
আমি টের পাচ্ছি, আমার এই লতায় পাতায় পল্লবিত কাহিনি পড়তে পড়তে এই এঁরা বিবিধ প্রকার ভ্রূ-ভঙ্গিমা দেখিয়ে চলেছেন এবং সরস বঙ্কিম কটুক্তি বর্ষণ করে চলেছেন।
কিন্তু হে মা-বোনেরা, আমি নিরুপায়। এ যে ভর পাওয়া কাহিনি। হিরের আত্মা ভর করেছে আমার এই লেখনীতে। হিরে নিয়েই তো যত বিভ্রাট এই দুনিয়ায়। সেই প্রহেলিকাই প্রভঞ্জন আকারে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই ভাঙা কলমটাকে। আপনারা স্বচ্ছন্দবোধ করুন, এই আমার মিনতি, কল্পনা চিটনিসের বিচ্ছু পুত্রের প্রসঙ্গে ফিরে আসব যথাসময়ে…।
রবি রে বললে আমার দিকে অপাঙ্গচাহনি নিক্ষেপ করে, ইন্দ্র, তুই অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, কিন্তু কালাহারি মরুভূমিতে হিরে খোঁজের অ্যাডভেঞ্চারে অবশ্যই যাসনি। ঠিক বলছি?
আমি অনুক্ষণ সময় ব্যয় না করে বলেছিলাম, না যাইনি। তুই গেছিস?
শ্ৰীযুক্ত রবি রে তখন শুরু করেছিল অত্যাশ্চর্য সেই উপাখ্যান-ইন্দ্র, পেশোয়ারের পাথরের কথা তোকে একটু আগেই বলছিলাম। এই প্রসঙ্গে পরে তোকে আরও কিছু বলব। এখন শুধু জেনে রাখ, হিরের বাজারে দর তোলবার জন্যে হিরে-কারবারিরা মাঝে মাঝে হিরে লুকিয়ে রাখে…কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে…কোল্ডস্টোরেজে সবজি রেখে দেওয়ার কায়দায়…পেশোয়ারের সেই বন্ধ্যা অঞ্চলে পাহাড় দিয়ে ঘেরা পাহাড়ি দুর্গের গোপন ধনাগারে এইভাবেই হিরে জমানো থাকে। যেমন থাকে এই পৃথিবীর আরও কয়েকটা জায়গায়…নামগুলো। পরে শুনিস।
কল্পনা…কল্পনা আমাকে ওর চোখের হিরের জাদু দিয়ে টেনে এনেছিল এই লাইনে। কল্পনা সুন্দরী ওর একটু চাপা আর টানা ছোট চোখের জন্য…নাক মুখ ঠোঁট সবই ডানাকাটা পরীদের মতো…আশ্চর্য…এত লাবণ্য আর কোনও মেয়ের মুখে তো দেখিনি…তা ওর চাহনি…হিপনোটিক. সত্যিই সম্মোহনী। ঠাট্টা করে আমাকে একদিন বলেছিল, কামরূপের মেয়ে আমার মা, বিয়ে করেছিল। ইস্পাহানের বাবাকে…জন্মেছি আমি সিকিমের মাটিতে…তাই আমি সিকিমি মেয়ে…গ্যাংটকের রূপসী…ওগো আমার প্রিয়…আমার আসল রূপ কোথায় জান? এই চোখে .এই চোখে…এই চোখে…আমি যে ত্রাটক যোগে যোগিনী… মায়ের কাছে রপ্ত করা এই গুপ্ত বিদ্যার বলে আমি বশে আনতে পারি মনের মতো মানুষকে…তুমি থাকবে চিরকাল আমার পাশে…আমার এই চোখের। টানে…মদনের বান যে আমার এই চোখ!