আপনার পিসাব আপনি ধুয়েছেন এতে লজ্জার কী আছে? আপনার পেসাব যদি ওসি সাহেব ধুতেন— সেটা ছিল লজ্জার।
তাও ঠিক। ভাই সাহেব সন্ধ্যার সময় যখন মারতে নিয়ে যাবে তখন বোধহয় মেরেই ফেলবে।
না তার আগেই আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন।
কীভাবে?
ব্যবস্থা করে রেখেছি। আই জি সাহেব টেলিফোন করবেন। টেলিফোন তিনি বলবেন, আবুল কালাম অতি সৎ চরিত্রের মানুষ। আমার পূর্ব পরিচিত। এতেই কাজ হবে।
শুকারিয়া।
রাতে ঘুম হয় নি?
জি না।
এখন ছোট্ট একটা ঘুম দিন। আই জি সাহেবের টেলিফোন এলে আমি ডেকে তুলব।
শুকারিয়া।
আবুল কালাম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। যেভাবে নিশ্বাস পড়ছে। তাতে মনে হয়। ঘুমিয়েই পড়েছেন। ভাইস প্রিন্সিপালের মতো দেখতে ভদ্রলোক আবারো আমাদের দিকে ঝুকে এসেছেন। আড়ি চোখে তাকিয়ে আছেন ঘুমন্ত আবুল কালামের দিকে। আমি বললাম, কিছু বলবেন?
ভদ্রলোক না সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, আপনাকে পুলিশ ধরেছে কেন?
ভদ্রলোক অতি মিষ্টি গলায় বললেন, খুনের আসামী হিসাবে ধরেছে।
খুন করেছেন?
হ্যাঁ করেছি।
কাকে খুন করেছেন?
করেছি। একজনকে। তার নাম বলার দরকার দেখছি না। যে চলে গেছে তার নাম দিয়ে দরকার কী? He does not exist.
আপনার নাম কী?
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করলেন। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন–আপনার এই লোক সারারাত ছটফট করেছে। এখন আপনাকে দেখে শান্তি পেয়ে ঘুমাচ্ছে। মিথ্যা কথা বলে আপনি তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। মিথ্যার শক্তি যে সত্যের চেয়ে বেশি এটা বুঝলেন?
বোঝার চেষ্টা করছি।
এই যুগে সতি্যু কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সত্যি কথা বললে সন্দেহের চোখে তাকায়। আমি যখন বললাম, খুন করেছি আপনি বিশ্বাস করেন নি। সন্দেহের চোখে তাকিয়েছেন। অথচ আমি সত্যি খুন করেছি।
আমি চুপ করে ভদ্রলোকের কথা শুনছি। ভদ্ৰলোক কী সুন্দর করেই না কথা বলছেন। হাসিহাসি মুখ চোখ ঝিকমিক করছে।
ভদ্রলোক আধা খাওয়া সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–খান সিগারেট খান। আপনি কী করে মিথ্যা কথা বলে একটা লোককে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন সেটা মোটামুটি অবাক হয়েই দেখলাম। নাম কী আপনার?
হিমু।
শুধু হিমু?
জি।
পুলিশ আপনাকে ধরেছে কেন?
আমি আবুল কালাম সাহেবকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। পুলিশ আমাকে লকারে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ভদ্রলোক মনে হল আমার কথায় খুব মজা পেলেন। শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। খুবই অন্যরকম হাসি। সমস্ত শরীর কাঁপছে, কিন্তু হাসির কোনো শব্দ আসছে না। চোখ দুটিতে কোনো হাসি নেই! চোখ স্থির।
হিমু সাহেব!
জি।
আমার নাম সাদেক চৌধুরী। আমার এই কার্ডটা রেখে দিন। প্রয়োজন পড়লে যোগাযোগ করবেন।
শুকরিয়া।
শুকরিয়া বলা কি আপনি আপনার বন্ধুর কাছে শিখেছেন?
জি।
আমি আপনাকে আর আপনার বন্ধুকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারি। করব?
দরকার নেই। আমরা ঘণ্টা দু-একের মধ্যে ছাড়া পাব।
আই জি সাহেব টেলিফোন করে ছাড়াবেন?
জি।
ভদ্রলোক আবারো তার বিচিত্ৰ হাসি হাসতে লাগলেন। তার এ বারের হাসি দেখে গা শিরশির করে উঠল। নিঃশব্দ হাসির বিষয়ে বাবা লিখে গিয়েছিলেন।
যে মানুষ নিঃশব্দে হাসে তাহার বিষয়ে খুব সাবধান। দুই ধরনের মানুষ নিঃশব্দে হাসে— অতি উঁচু স্তরের সাধক এবং অতি নিম্ন শ্রেণীর পিশাচ চরিত্রের মানুষ। এই দুই এর ভেতর প্রভেদ করা তেমন জটিল কর্ম নহে। ঘ্রাণের মাধ্যমে এই দুই শ্ৰেণীকে আলাদা করা যাইবে। হাস্যকালীন সময়ে সাধু মানুষের গাত্র হইতে সুঘ্ৰাণ পাওয়া যাইবে। পিশাচ শ্রেণীর মানুষের গায়ে পাওয়া যাইবে তিক্ত ও কটুম্বাদময় দূষিত গন্ধ। সাধু মানুষ যেমন সংখ্যায় অতি নগন্য তেমনি পিশাচ শ্রেণীর মানুষও সংখ্যায় অতি নগন্য। এই দুই শ্রেণীর মানুষের কাছেই অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। বাবা হিমু মনে রাখিও অতি ভয়ঙ্কর যে গরল তাহাতেও অমৃত মিশ্রিত থাকে। অতি পবিত্ৰ অমৃতে থাকে প্রাণসংহারক গরল। খাদ ছাড়া সোনা হয় না। গরল ছাড়া অমৃতও হয় না।
হাজাতের দরজা খুলেছে। দুবলা পুলিশ আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। কথা বলার পরিশ্রম করতেও সে মনে হয়। রাজি না।
ওসি সাহেবের সামনে দাঁড়ালাম। তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমাকে দেখলেন। চোখ মুখ কুঁচকালেন। একজন শিক্ষক যেমন যাকেই দেখেন তাকেই ছাত্র মনে করেন। একজন পুলিশ অফিসারও যাকে দেখেন তাকে খারাপ ধরনের ক্রিমিন্যাল মনে করেন। আমি অতি বিনয়ী টাইপ হাসি দিয়ে বললাম, স্যারের শরীর এবং মন কি ভালো? কোনো ক্রিমিন্যাল শরীর স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞেস করলে রাগে শরীর জুলে যাবার কথা। ওসি সাহেবের শরীর জ্বলল না। তিনি চোখ মুখ কুঁচকেই রাখলেন। তবে ভদ্র স্বরে বললেন, বসুন।
আমি বসলাম। ওসি সাহেব চোখে চশমা পরতে পরতে বললেন–শুনলাম আপনি একজন কবি।
আমি বিনয়ী ভঙ্গিতে বললাম, জি স্যার কবি। মনে একটা ক্ষোভ ছিল পুলিশ বিডিআর এবং আর্মিকে নিয়ে কেন কবিতা লেখা হয় না। এরাও তো জনগোষ্ঠির অংশ। রবীন্দ্রনাথ কত কিছু নিয়ে কত কবিতা লিখেছেন– অথচ পুলিশ নিয়ে কোনো কবিতা লিখেন নি ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। উনি লিখেছেন— ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তা না লিখে তিনি অনায়াসে লিখতে পারতেন— ও আমার দেশের পুলিশ তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা। এতে পুলিশ ভাইদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হত।