হিমু ভাইজান, দুধ ছাড়া এককাপ চা খাবেন?
খাব।
ঘরে খুব ভালো ঘি আছে। গরম রুটিতে ঘি মাখিয়ে চিনি দিয়ে দেই?
দাও।
ফুলফুলিয়া খানিক্ষণ ইতস্তত করে বলল, উনি বলছিলেন। আপনি নাকি একজন মহাপুরুষ। আপনি যে-কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারেন। এটা কি সত্যি?
না, এটা সত্যি না।
আপনি কি মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?
তাও পারি না।
তাহলে উনি কেন এত বড় গলায় আপনার কথা বললেন? আপনি কী পারেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি সুখে এবং দুঃখে মানুষের পাশে থাকতে পারি।
সে তো সবাই পারে। আপনার বিশেষত্ব কী?
আমার বিশেষত্ব হচ্ছে। আমি সব সময় একটা হলুদ পাঞ্জাবি পারি। সবাই হলুদ পাঞ্জাবি পরে না।
সব সময় হলুদ পাঞ্জাবি কেন পরেন?
হলুদ পাঞ্জাবি পরার প্রধান কারণ হচ্ছে–হলুদ রঙের কাপড় সহজে ময়লা হয় না। একবার ধুয়ে অনেক দিন পরা যায়।
এটাকে বললেন প্ৰধান কারণ। অপ্রধান কারণ কী?
অপ্রধান কারণ আমার বাবা। তিনি মহাপুরুষ বানাবার একটা স্কুল খুলেছিলেন। আমি ছিলাম স্কুলের একমাত্র ছাত্র। হলুদ পাঞ্জাবি হলো স্কুল ড্রেস। বাবার ধারণা হয়েছিল গেরুয়া বৈরাগ্যের রঙ। গেরুয়া রঙের কাপড় পরলে মনে বৈরাগ্য আসে। মহাপুরুষদের বৈরাগ্য থাকতে হয়।
ফুলফুলিয়া কথা শুনে মজা পাচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ফুলফুলিয়ার পাহারাদারও একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেল। মৈনাক পর্বতের মতো শরীর। সাধারণভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিন্তু ফোস ফোঁস শব্দ হচ্ছে। এ রকম পাহারাদার থাকলে আর চিন্তা নেই। ফুলফুলিয়া বলল, আপনার বাবা কি সত্যি সত্যি আপনাকে মহাপুরুষ বানাবার চেষ্টা করেছিলেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বাবা রীতিমতো স্কুল খুলে বসেছিলেন!। স্কুলের তিনিই প্রিন্সিপাল, তিনিই শিক্ষকমণ্ডলি, তিনিই ড্রিল স্যার। এত করেও শেষ রক্ষা হয় নি। স্কুল থেকে পাশ করে বের হবার আগেই বাবার মৃত্যু। বাবার মৃত্যু মানেই প্রিন্সিপাল স্যারের মৃত্যু, শিক্ষকমণ্ডলির মৃত্যু এবং ড্রিল স্যারের মৃত্যু।
নিজের বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা এত সহজভাবে বলছেন?
মহাপুরুষ স্কুলের ট্রেনিং-এর কারণে বলতে পারলাম। ট্রেনিং না থাকলে বাবার মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে যেত। চোখ ভেজা ভেজা হয়ে যেত। তুমি তাড়াতাড়ি রুটি বানিয়ে নিয়ে এসো। খাওয়া-দাওয়ার পর ইন্টারভ্যু পর্ব।
কীসের ইন্টারভ্যু?
মাজেদা খালাকে তোমার সম্পর্কে একটা রিপোর্ট দিতে হবে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
কিছু বুঝতে না পারা খুবই ভালো কথা। যত কম বুঝবে তত ভালো। কাগজ-কলম আছে না? কাগজ কলম দাও–আমি পয়েন্টগুলো লিখে নেই। কী কী প্রশ্ন করব ঠিক করি।
ফুলফুলিয়া আনন্দিত গলায় বলল, আমার এখন রুটি বানাতে ইচ্ছে করছে না। আপনার প্রশ্নগুলো শুনতে ইচ্ছে করছে।
ঠিক আছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব আগে শেষ হোক।
ফুলফুলিয়া কাগজ-কলম। এনে দিল। খাটের উপর বসল। আনন্দ ও উত্তেজনায় তার চোখ চকচক করছে। আমি বললাম, তোমার নাম কী?
ফুলফুলিয়া।
ফুলফুলিয়া কোনো নাম না, ভালো নাম বলো।
আক্তারী জাহান।
বয়স?
একুশ।
উচ্চতা?
বলতে পারছি না। উচ্চতা কখনো মাপি নি।
ওজন নিয়েছ? ওজন কত?
ওজনও নেই নি।
যাই হোক অনুমান করে লিখে নিচ্ছি— উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ। ওজন পঞ্চাশ কেজি। পড়াশোনা কি?
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছি।
কোন ডিভিশন?
ফাস্ট ডিভিশন।
বর্তমানে কী করছ?
আমাদের এখানে একটা ক্লিনিক আছে। ক্লিনিকে শমসের আলি বলে একজন ডাক্তার আছেন। আমি তার রোগীদের সিরিয়েল দেই।
ক্লিনিকে আয়ার কাজ কখনো করেছ?
জ্বি করেছি। শুরুতে তাই করতাম। ডাক্তার চাচা সেখান থেকে আমাকে নিয়ে রোগী দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন।
কী খেতে পছন্দ? আলাদা করে আইটেম বলবে। মাছের মধ্যে কোন মাছ?
ইলিশ মাছ।
ভর্তার মধ্যে কোন ভর্তা?
শুকনা মরিচের ভর্তা।
পোলাও, ভাত, খিচুড়ি –এই তিনটের মধ্যে কোনটা পছন্দ?
খিচুড়ি।
শুকনা খিচুড়ি না ঢলঢালা খিচুড়ি?
শুকনা।
পছন্দের ফুল?
যুঁই ফুল।
একজন খুব পছন্দের মানুষের নাম বলো।
ফুলফুলিয়া হেসে ফেলল।
আমি বললাম, হাসছ কেন?
ফুলফুলিয়া বলল, হাসছি কারণ আমি যখনই আমার খুব পছন্দের মানুষের নাম বলব। আপনি বিশ্বাস করবেন না। কারণ আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ হচ্ছেন আপনি অথচ আপনার সঙ্গে মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমার দেখা হয়েছে।
তোমার খুব অপছন্দের একজন মানুষের নাম বলো।
আমার বাবা।
জহির তোমার খুব পছন্দের তালিকায় নেই?
না। তিনি মোটামুটি পছন্দের একজন।
মোটামুটি পছন্দের একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছ?
ফুলফুলিয়া চমকে উঠে বলল, তাকে আমি কেন বিয়ে করব?
বিয়ের কোনো কথা তার সঙ্গে তোমার হয় নি?
না।
জহির তো বিয়ে করার জন্যে খুবই ভালো ছেলে। জহির যে কত ভালো ছেলে সেই সার্টিফিকেট কিন্তু আমি তোমাকে দিতে পারি।
সার্টিফিকেট দিতে হবে না। মানুষের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মানুষটা ভালো না মন্দ।
তাই না কি?
হ্যাঁ তাই। পুরুষ মানুষের পক্ষে হয়তো এটা বোঝা সম্ভব না। কিন্তু সব মেয়ের এই ক্ষমতা আছে।
জহির তো পরিকল্পনা করে রেখেছে তোমাকে কাজি অফিসে নিয়ে বিয়ে করবে। বিয়েতে আমি একজন সাক্ষী। তোমার তরফ থেকে যদি কোনো সাক্ষী না পাওয়া যায় দ্বিতীয় সাক্ষীও আমিই জোগাড় করব।
কী সর্বনাশ! এইসব আপনি কী কথা বলছেন!! আমার তো বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী নাইক্ষ্যংছড়ি পোস্টাপিসের পোস্টমাষ্টার। ঐ এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালিতে ঝামেলা হচ্ছে এই ভয়ে সে আমাকে নিতে চায় না।