ইতি
তোর মাজেদা খালা
পুনশ্চ : হিমু আমার মাথাটা আসলেই খারাপ হয়ে গেছে। যে ঘটনাটা তোকে জানাবার জন্যে চিঠি লিখেছিলাম। সেই ঘটনাই জানানো হয় নি। অথচ চিঠি শেষ করে বসে আছি। আসলে আমি আর টেনশন নিতে পারছি না বলে। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সেদিন মাথা ধরার ট্যাবলেট ভেবে তোর খালুর দুটা প্রেসারের ওষুধ খেয়ে ফেলেছি। তারপর দেখি ধুম করে প্রেসার নেমে যাচ্ছে। মাথায় পানি ঢালাঢালি–ডাক্তার ডাকাডাকি।
যাই হোক, মূল ঘটনাটা মন দিয়ে শোন। এখন পর্যন্ত ঘটনাটা নিয়ে কারো সঙ্গেই আলাপ করি নি। শুধু আমার কাজের মেয়ে তিনটিকে বলেছি। কাজটা ভুল হয়েছে। তিনটা মেয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। তোর খালুকে ঘটনাটা বলতে গিয়েও বলি নি। তাকে যা বলব— সে গম্ভীর হয়ে বলবে, এটা কিছু না। তুমি স্বপ্ন দেখেছি। চোখের সামনে দেখা জলজ্যান্ত জিনিসকে কেউ যদি বলে স্বপ্ন তাহলে কেমন রাগ লাগে তুইই বল?
ঘটনাটা ঘটেছে ভূমিকম্পের রাতে। তখন ঘটনাটা আমি নিজেও বুঝতে পারি নি। ভূমিকম্পের ভয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কী দেখছি বাঁ কী দেখছি না বুঝতেই পারি নি। যতই দিন যাচ্ছে ব্যাপারটা ততই পরিষ্কার হচ্ছে–আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
ভূমিকম্পের রাতের কথা তোর নিশ্চয়ই মনে আছে। দরজা ভেতর থেকে লক করা। আমি দরজা খুলতে পারছি না। চাবি পাচ্ছি না। ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার উলট-পালট করছি। তোর খালু পাগলের মতো বিড়বিড় করছে। এক সময় ছুটে গেলাম জহিরের ঘরে। তখন তুই বললি বালিশের নিচে খুঁজে দেখতে। আমি গেলাম শোবার ঘরে। আমি মশারি খাটিয়ে ঘুমাই। ঢাকায় ডেঙ্গু রোগ দেখা দেয়ার পর থেকে এই ব্যবস্থা। রাত আটটা বাজতেই কাজের মেয়ে মশারি খাটিয়ে দেয়। আমি গোলাম অবাক হলাম— দেখি বাড়ির চাবি। চাবি হাতে নিতে গিয়ে আরেকটা জিনিস দেখলাম— দেখি বুড়ো একজন মানুষ কুজো হয়ে মশারির ভেতর বসে আছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তখন আমার মাথাতেই নেই যে এটা একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আমার মশারির ভেতর কোনো বুড়ো মানুষ বসে থাকতে পারে না। ভূমিকম্পের ভয়ে আমি এতই অস্থির যে বুড়ো মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা আমার মাথায় ঢুকাল না। আমি চাবি নিয়ে দরজা খুলে দৌড়ে নিচে চলে গেলাম।
হিমু, ব্যাপারটা কী বল তো? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আমার কি কথা বলা উচিত?
সাক্ষাতে এটা নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলব। আপাতত তুই ফুলফুলিয়ার ব্যাপারটা দেখ। প্রয়োজনে কেয়ারটেকারকে সাথে নিয়ে যা। এই ধরনের মেয়েরা হিংস্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাদের হাতে পোষা গুণ্ডাপাণ্ডাও থাকে। তোকে একা পেয়ে কিছু করে বসতে পারে। দুজন থাকলে কিছুটা রক্ষা। ভালো থাকিস।
ফুলফুলিয়া যার নাম তার স্বভাব-চরিত্র যাই হোক সে দেখতে খুব সুন্দর হবে। এরকম ধারণা হবেই। আমি ধরেই নিলাম মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকব। মনে মনে বলব, বাহ।
মেয়েটির বাসা ঝিকাতলায়। ঠিকানা লেখা কাগজ হাতে নিয়ে তার বাসা খুঁজছি। আর কল্পনা করছি মেয়েটা দেখতে কেমন হবে। গায়ের রঙ গৌর বর্ণ। মাথা ভর্তি চুল। কুচকুচে কালো চুল না। সামান্য পিঙ্গল ভাব আছে। অতিরিক্ত ফর্স মেয়েরা সাধারণত পিঙ্গলকেশী হয়। রোগা, গোলগাল মুখ। খুবই ছটফট স্বভাবের মেয়ে। স্থির হয়ে এক জায়গায় বসেও থাকতে পারে না। অকারণে হেসে ফেলার বাতিকও আছে। সিরিয়াস ধরনের কথাতেও মুখ আড়াল করে হাসছে।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর যে মেয়েটি দরজা খুলে দিল সে-ই যে ফুলফুলিয়া এতে আমার মনে সন্দেহের তিল মাত্ৰও নেই। অথচ কল্পনার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। শান্ত চেহারার শ্যামলা মেয়ে। রোগাটা ঠিক আছে, তবে মুখ গোলাকার না, লম্বাটে। মনে হয় রুটি বানাচ্ছিল। হাতে ময়দা লেগে আছে। ফুলফুলিয়া অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমাকে দেখে এত বিস্মিত হচ্ছে কেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমার চেহারা বিস্মিত হবার মতো না। আমি সহজ গলায় বললাম, ফুলফুলিয়া কেমন আছ?
মেয়েটা খানিকটা ভীত গলায় বলল, ভালো আছি।
রুটি বানাচ্ছিলে নাকি?
মেয়েটার গলা থেকে বিস্ময় ভাবটা চলে গেল। সেখানে চলে এলো আনন্দ। সে বলল, আপনি হিমু ভাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ। চিনেছ কীভাবে? জহির নিশ্চয়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার চেহারার বর্ণনা তোমার কাছে করেছে।
উনি কিছুই বলেন নি। উনি শুধু বলেছেন হিমু ভাইজান যদি তোমার কাছে আসেন তাহলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলবে। তিনি দেখতে কেমন, এইসব কিছু বলার দরকার নেই।
আমি যে হলুদ পাঞ্জাবি পরি এটা নিশ্চয়ই বলেছে।
না, হলুদ পাঞ্জাবির কথাও বলেন নি। বাসা অন্ধকার কেন?
বারান্দার বাতিটা চুরি হয়ে গেছে। এই জন্যে অন্ধকার। ভেতরে আসুন, ভেতরে
আলো আছে।
তুমি ছাড়া বাসায় আর কে আছে?
রহমতের মা বলে একজন মহিলা আছেন। উনি আমার পাহারাদার। উনি ছাড়া আর কেউ নেই।
তোমার বাবা কোথায়?
ফুলফুলিয়া মিষ্টি করে হেসে বলল, বাবা আমার উপর রাগ করে দুপুরবেলা চলে গেছেন। বলে গেছেন। আর ফিরবেন না।
প্রায়ই কি এরকম রাগ করে চলে যান?
জ্বি।
রাগ ভেঙে গেলে দিনে দিনেই কি ফেরেন?
না, সব দিন ফেরেন না। এমনও হয়েছে চার পাঁচদিন পরে ফিরেছেন।
আমি ফুলফুলিয়ার সঙ্গে একটা ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরে সস্তার একটা খাট পাতা আছে। টেবিল চেয়ার আছে। আলনা আছে। আলনার কাপড়-চোপড় দেখে মনে হচ্ছে এই ঘরে ফুলির বাবা ঘুমান।