কোনো আর্টিকেল পড়বেন না।
কেন?
বজ্রপাতের উপরে আর্টিকেল পড়লেন–সঙ্গে সঙ্গে আপনার উপর বজ্রপাত হলো। পুড়ে কয়লা হয়ে গেলেন।
তুমি কি রসিকতা করার চেষ্টা করছ?
জ্বি।
তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক রসিকতার না। রসিকতা করবে না।
জ্বি আচ্ছা।
একটা জিনিস খেয়াল রাখবে। তোমার নাম হিমু। তুমি একজন ভ্যাগাবল্ড। তুমি চার্লি চ্যাপলিন না।
জ্বি আমি খেয়াল রাখব।
তুমি জহিরের ঘরে যাও। ওকে বিরক্ত করা। ওর সঙ্গে হিউমার করার চেষ্টা কর। আমার সঙ্গে না।
জি আচ্ছা।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। খালু সাহেব থমথমে গলায় বললেন, তোমাকে আরেকটা বিষয় বলি। দয়া করে সহজ উত্তর দেবে, প্যাচানো উত্তর দেবে না।
জ্বি আচ্ছা।
ভূমিকম্প হচ্ছে। সবাই দৌড়ে নেমে খোলা জায়গায় চলে গেল। তুমি ঘরে বসে রইলো। খুব ভালো কথা, থাক ঘরে বসে, কিন্তু জহিরকে আটকে রাখলে কেন?
খালু সাহেব, আমি জহিরকে আটকে রাখি নি। ও হঠাৎ খালি গায়ে দৌড় দিল। যাকে বলে ভো দৌড়।
দৌড়ে কোথায় গেল?
প্রথম বুঝতে পারি নি কোথায় গেছে। পরে ওকে আবিষ্কার করলাম ছাদে। সে ভাষায় আকাশে লেখা ভাসে। সত্যি কি-না দেখতে গেছে।
যে ছেলে ফিজিক্স পড়ছে সে ভূমিকম্পে আকাশে হাবিজাবি লেখা হয়। এইসব বিশ্বাস করে? ওকে তো কানে ধরে উঠবোস করানো দরকার। ওকে আমার কাছে পাঠাও তো। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার।
খালু সাহেব আজ কথা না বলে আরেকদিন বলুন। এখন সে একটু ব্যস্ত আছে। ব্যস্ত বলেই আমি আপনার কাছে বসে আছি। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন জেনেও বসে আছি।
কী নিয়ে ব্যস্ত?
সে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে একজনের কাছে খবর পাঠাবার চেষ্টা করছে। জানার চেষ্টা করছে ভূমিকম্পে তাদের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি-না। পদ্ধতিটা খুব সহজ। শবাসন হয়ে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়…
চুপ কর।
জ্বি আচ্ছা।
খালু সাহেব থমথমে মুখে জহিরের ঘরের দিকে এগুলেন। আমিও তাঁর পেছনে পেছনে গেলাম। ইন্টারেস্টিং কোনো পরিস্থিতি হয় কি-না দেখার জন্যে যাওয়া। তেমন কিছু হলো না। খালু সাহেব হতভম্ব হয়ে দেখলেন, তাঁর পুত্র চোখ বন্ধ করে সরল রেখা হয়ে শুয়ে আছে। মুখে বিড়বিড় করছে। খালু সাহেব যেভাবে নিঃশব্দে ছেলের ঘরে ঢুকেছেন সেইভাবে নিঃশব্দেই ছেলের ঘর থেকে বের হলেন। আমাকে ইশারায় তার পেছনে পেছনে আসতে বললেন। আমিও বাধ্য ছেলের মতো তাকে অনুসরণ করলাম। তিনি আমাকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বললেন, হিমু তুমি নানাবিধ যন্ত্রণা তৈরি করা। আমি আমার পরিবারে কোন যন্ত্রণা চাই না। তুমি আর এ বাড়িতে আসবে না। তুমি এক্ষুণি বিদেয় হও।
আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, আমার রাতে খাওয়ার কথা। ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে। কথা বাড়বে না। বিদেয় হও। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। খালু সাহেব দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখ থমথম করছে।
রাতে কাউকে কিছু না বলে
হিমু,
তুই রাতে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলি কেন? তুই নিজেকে কী ভাবিস? যা মনে আসে করে বেড়াবি? তোকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।? বাংলাদেশের সব মানুষের মাথা কি তুই কিনে নিয়েছিস?
ঐ রাতে কী ঘটেছিল আমার কাছে শোন। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছিল। আমি বাতি বন্ধ করে শুয়েছিলাম। এতে মাথা ধরা আরো বাড়ল। তুই বোধহয় জানিস না শুয়ে থাকলে আমার মাথা ধরা বাড়ে। আমার সবই উল্টা। যাই হোক মাথা ধরা যখন খুব বাড়ল তখন মাথা ধরার টেবলেটের খোঁজে গেলাম তোর খালুর কাছে। দেখি সে একা মুখ আমসি করে বসে। আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হিমু কোথায়? তোর খালু বলল, জানি না। কোথায়। আমি বললাম, সে চলে গেছে না কি? তোর খালু বলল, জানি না। যেতেও পারে, খবর না দিয়ে যে আসে সে খবর না দিয়ে চলে যায়। তখন আমি গোলাম জহিরের ঘরে। সেখানেও তুই নেই। কাজের মেয়েরাও কেউ কিছু বলতে পারে না। গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম। সেও বলল, গেট দিয়ে কাউকে যেতে দেখে নি। তোর খালু বলল, চলে গেছে— গেছে। এত হৈচৈ করছ, কেন? টেবিলে খাবার দিতে বলে।
হিমু, কাউকে কিছু না বলে চলে যাওয়াটা ঠিক না। আমি রাগ করেছি এবং মনে কষ্ট পেয়েছি। আমি যাদেরকে বেশি স্নেহ করি। তারাই আমাকে কষ্ট দেয়। জহিরের কথাই মনে করে দেখ।
ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারে জহিরের সব কথাবার্তা এই নিয়ে পাঁচবার শুনলাম। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এইসব কী ধরনের কথাবার্তা? আমার তো মনে হয় ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে। তার ডাক্তারি চিকিৎসা দরকার। কোনো সুস্থ মাথার ছেলে এ ধরনের কথা বলতে পারে না। ভূমিকম্পের রাতে সে তার বাবার সঙ্গে যে কথাবার্তা বলেছে সেটা শুনলেই যে কেউ বলবে, ছেলেকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দাও। ঐটাই তার জন্যে উপযুক্ত জায়গা। ঘটনা। কী হয়েছে শোন। বাপ-ছেলে খেতে বসেছে। আমি বসি নি। প্রথমত, আমার মাথার যন্ত্রণা; দ্বিতীয়ত, তোর জন্য রান্না-বান্না করিয়েছি। আর তুই না বলে পালিয়ে গেছিস; যাই হোক মূল ঘটনা শোন। জহিরের বাবা বলল, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
জহির বলল, ভালোই হচ্ছিল। তবে এখন হচ্ছে না।
জহিরের বাবা বলল, হচ্ছে না কেন?
জহির বলল, ফিজিক্স পড়ে কোনো লাভ নেই বাবা।
লাভ নেই কেন?
প্রকৃতিকে বোঝার জন্যেই ফিজিক্স পড়া। আমি চিন্তা করে দেখেছি। এখন পর্যন্ত ফিজিক্সের যে উন্নতি হয়েছে তা দিয়ে প্রকৃতিকে কিছুতেই বোঝা যাবে না। বরং উল্টো হবে। ফিজিক্সের জ্ঞান আমাদের চিন্তাকে আরো ধোঁয়াটে করে ফেলবে।