জহির আবার তার বিখ্যাত রোবট গলায় কথা বলা শুরু করল। মনে হচ্ছে প্রতিমন্ত্রীদের মতো লিখিত ভাষণ পড়ছে। ভাইজান, আমি ঠিক করেছি। ফুলফুলিয়াকে বিয়ে করব। আমি জানি সবাই খুব রাগ করবে। কিন্তু আমি মন ঠিক করে ফেলেছি। বিয়ে করব কাজির অফিসে। বিয়েতে তুমি একজন সাক্ষী হবে। আরেকজন সাক্ষীও তুমি জোগাড় করবে। কোত্থেকে করবে। সেটা তুমি জানো। ফুলফুলিয়া সম্পর্কে এই আমার পরিকল্পনা।
বিয়ের পরেও কি তুই তোর মাকে জানাবি না?
বিয়ের পর জানাব। কাজি অফিস থেকে টেলিফোন করে জানাব।
খালা তোকে ষ্ট্রেট বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তুই যাবি কোথায়?
সেটা নিয়ে চিন্তা করি নি।
চিন্তা না করে ভালোই করেছিস। বেশি চিন্তা-ভাবনা করে কিছু হয় না। তুই একভাবে চিন্তা করে রাখবি ঘটনা ঘটবে অন্যভাবে। চিন্তাহীন জীবনযাপন করা উচিত।
ফুলফুলিয়ার একটা ছবি আমার কাছে আছে, দেখবে?
না।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়কার ছবি। এখনকার চেহারার সাথে কোনো মিল নেই।
এই সময়ের কোনো ছেলে প্রেমিকার ছবি পকেটে নিয়ে ঘুরে না। ছবি পকেটে নিয়ে ঘুরাটাকে গ্ৰাম্যতা মনে করা হয়। তুই কী মনে করে ঘুরছিস?
আমি ছবি পকেটে নিয়ে ঘুরছি না তো। ছবিটা পেজ মার্ক হিসেবে ব্যবহার করছি। আমার অবশ্য অন্য একটা পরিকল্পনাও আছে। খুবই হাস্যকর পরিকল্পনা। বলব?
বল।
আমার কম্পিউটারে ফটোশপ আছে। আমি করব কী ফুলফুলিয়ার ছবি ফটোশপে ঢুকাব। আইনস্টাইনের ছবি তার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে প্রিন্ট বের করব। ছবিতে দেখা যাবে আইনস্টাইন ফুলির মাথায় হাত রেখে হাসি হাসি মুখে বসে আছেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবি থাকবে না? কবিগুরুর কোলে ফুলফুলিয়া বসে আছে? কবিগুরুর দাড়ির খোঁচা লাগছে ফুলফুলিয়ার গালে।
অবশ্যই থাকবে। কবি নজরুলের সঙ্গে থাকবে। কবি নজরুল হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন— ফুলফুলিয়া গান করছে।।
বাংলাদেশের বিখ্যাতদের কেউ থাকবে না? বাংলাদেশের বিখ্যাতরাও থাকবে, তবে কোনো পলিটিক্যাল ফিগার রাখব না। শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া এরা বাদ। শুধু কবি-সাহিত্যিকরা থাকবেন। আমার আসল ইচ্ছা ফুলিকে চমকে দেয়া। সমস্যা হচ্ছে মেয়েটা চমকায় না। ভাইজান, তুমি ওকে চমকাবার কিছু বুদ্ধি বের কর তো।
তুই কোনো চিন্তা করিস না। চমক কত প্রকার ও কী কী এই মেয়ে এখন টের পাবে। ওকে আমরা ধারাবাহিক চমকের মধ্যে রাখব। চমকাতে চমকাতে ওর চমকা রোগ হয়ে যাবে। তখন দেখবি কারণ ছাড়াই চমকাচ্ছে।
থ্যাংক য়্যু।
তুই চুপ করে বসে থাক। আমি খালাকে একটা জিনিস হ্যান্ডওভার করে এক্ষুণি আসছি।
তুমি কি রাতে থাকবে?
বুঝতে পারছি না। থেকে যেতেও পারি।
যদি রাতে থাক তাহলে ফুলির সঙ্গে পরিচয়টা কীভাবে হলো সেটা তোমাকে বলব। খুবই ইন্টারেস্টিং। শুনলে হাসতে হাসতে তোমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমার যখনই মনে হয়। আমি একা একা হাসি।
জহির মুখ টিপে হাসছে। কী সুন্দর সহজ হাসি! তার আনন্দ সারা শরীর দিয়ে আলোর মতো ঠিকরে বের হচ্ছে। ঠিক তখন একটা ঘটনা ঘটল। টিভির ওপর রাখা জাপানি চিনামাটির বালিকা মূর্তি ধূম করে নিচে পড়ে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। দেয়ালে ঝুলানো দুটা ক্যালেন্ডার হঠাৎ পেণ্ডুলাম হয়ে দুলতে শুরু করল। আমরা যে খাটে বসেছিলাম। কেউ মনে হয়। সেই খাট ধরে হাচক টানে ইঞ্চি খানেক সরিয়ে দিল। মাথার ভেতরের মগজও মনে হয় খানিকটা দুলল। জহির ভীত গলায় বলল, ভাইজান কী হচ্ছে?
আমি বললাম, তেমন কিছু না। টাইট হয়ে বসে থাক। ভূমিকম্প হচ্ছে।
জহিরের মুখ দ্বিতীয়বারের মতো হা হয়ে গেল। মুখের হা বন্ধ না করেই সে কথা বলল, ভূমিকম্প হচ্ছে মানে কী?
আমি হালকা গলায় বললাম, মা বসুন্ধরা সামান্য কেঁপে উঠেছেন। ঢাকা শহর দুলছে।
আমরা বসে আছি কেন?
আমরা বসে আছি কারণ আমরা বসে বসে গল্প করছিলাম। যদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতাম তাহলে— বসে না থেকে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
ততক্ষণে মাজেদা খালার বাড়িতে ভূতের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। মাজেদা খালা চিৎকার করছেন। তার কাজের তিনটি মেয়ের দুটি চিৎকার করছে। একটি গলা ছেড়ে কাঁদছে। খালু সাহেব ইংরেজিতে সবাইকে ধমকাচ্ছেন। (দারুণ টেনশনের মুহুর্তে খালু সাহেব বাংলা ভুলে যান।) মাজেদা খালা এন্ড ফ্যামিলি আটকা পড়ে গেছে। বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। কারণ দরজা খোলার চাবি পাওয়া যাচ্ছে না। মাজেদা খালা সম্প্রতি তাঁর পুরো বাড়ির দরজা তালা বদলে আমেরিকান তালা লাগিয়েছেন। এই তালাগুলো বাইরে থেকে লাগানো যায় আবার ভেতর থেকেও লাগান যায়।
জহির বলল, ভাইজান বাড়িঘর ভেঙে মাথার উপর পড়বে না?
আমি বললাম, পড়তে পারে।
আমাদের তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। রাস্তায় যাবি কীভাবে? দরজা খোলার চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ভূমিকম্প থেমে গেছে তাই না ভাইজান?
প্রথম ধাক্কাটা গেছে। আসলটা বাকি আছে।
আসলটা বাকি আছে মানে? ভূমিকম্পের নিয়ম হচ্ছে প্রথম একটা ছোট ধাক্কা দেয়। সবাইকে জানিয়ে দেয় যে সে আসছে। তারপর দেয় বড় ধাক্কাটা।
বড় ধাক্কাটা কখন দেবে?
তার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। পাঁচ মিনিট পরে দিতে পারে, পাঁচ ঘণ্টা পরে দিতে পারে। আবার ধর পাঁচ দিন পরেও দিতে পারে।
ভাইজান আমার খুবই টেনশন লাগছে।
ফুলফুলিয়ার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হলো সেই গল্পটা শুরু করা। টেনশন কমবে। দরজায় ধরাম করে শব্দ হলো। মাজেদা খালা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন। কন্দো কন্দাে গলায় বললেন, ভূমিকম্প হচ্ছে তোরা জনিস না?