আমার বিয়ে হয় নি। বিয়ের কথা মিথ্যা করে বলা হচ্ছে –এই তথ্য আপনাকে কে দিল? বাবা দিয়েছেন?
না। আমি নিজেই চিন্তা করে বের করেছি।
কবে বের করেছেন?
যেদিন তোমার সঙ্গে প্ৰথম দেখা হলো সেদিন।
এতদিন বলেন নি কেন?
তোমরা পিতা-কন্যা একটা খেলা খেলছ, আমি খেলাটা নষ্ট করি নি।
আজ হঠাৎ খেলাটা নষ্ট করলেন কেন?
খেলা নষ্ট করলাম। কারণ–জহির ঢাকায় আসছে। তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে। আমি চাই তোমরা ঝামেলা সেরে ফেল।
কী ব্যামেলা?
বিয়ের ঝামেলা।
আপনি অবলীলায় এইসব কথা কীভাবে বলছেন?
দীর্ঘদিনের অভ্যাস। জটিল কথা সহজ করে বলে ফেলি। ফুলফুলিয়া শোন, তুমি কিন্তু আমার কথা রাখ নি। তোমাকে বলেছিলাম আমি না বলা পর্যন্ত তুমি যেন জহিরের চিঠি না পড়। তুমি কিন্তু পড়ে ফেলেছি।
এটাও কি অনুমান করে বললেন?
হ্যাঁ।
আপনার অনুমান শক্তি ভালো। এখন বলুন তো চিঠিতে কী লেখা।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, দীর্ঘ চিঠিতে একটাই বাক্য গুটি গুটি করে লেখা— তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি। জহির চিঠিতে এত অসংখ্যবার তোমাকে ভালোবাসি বলে ফেলেছে যে বাকি জীবনে সে যদি আর একবারও না বলে তোমার কোনো অসুবিধা হবার কথা না। ফুলফুলিয়া তুমি খুবই ভাগ্যবতী মেয়ে।
ফুলফুলিয়ার কঠিন চোখ কোমল হতে শুরু করেছে। চোখের দুপাশের ল্যাকরিমাল গ্র্যান্ড উদ্দীপ্ত হয়েছে। এখনই চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। চোখের পানি বর্ণহীন। কিন্তু ভালোবাসার চোখের পানির বর্ণ ঈষৎ নীলাভ। ফুলফুলিয়া গাঢ় স্বরে বলল, হিমু ভাইজান আমাদের বিয়েতে আপনি থাকবেন না?
আমি তার প্রশ্নের জবাব দিলাম না। সব প্রশ্নের জবাব দিতে নেই।
ওসি সাহেব নিজেই আমাকে জেল হাজতে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার হাতে হাতকড়া নেই, কোমরে দড়ি নেই। আমি পুলিশের জিপের পেছনের সিটে বেশ আরাম করেই বসে আছি। ওসি সাহেব বসেছেন। আমার পাশে। তিনি একটার পর একটা সিগারেট টানছেন। জিপের ভেতরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। ওসি সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন–ওপরের দিকে যারা আছেন তাদের কাজকর্ম বোঝা খুবই মুসকিল। এখন প্ৰাণপণ চেষ্টা চলছে— যে প্যাচে আপনি পড়েছেন সেখান থেকে আপনাকে উদ্ধার করা। আপনার এক আত্মীয়, সম্ভবত সম্পর্কে আপনার খালু, তিনি হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে ধরনা না দিচ্ছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার। তিনি বুঝতে পারছেন না যে, প্যাচ থেকে আপনাকে উদ্ধার করা অসম্ভব কঠিন। আপনি এখন হত্যা মামলার আসামি। মৃত ব্যক্তি আপনাকে ফাঁসিয়ে ডেথ বেড কনফেসন দিয়ে গেছে।
আমাকে দড়িতে বুলতেই হবে?
ওসি সাহেব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে শুরু করলেন। আমি বললাম, ওসি সাহেব। আপনি এত আপসেট হবেন না। জগৎ খুব রহস্যময়। হয়তো এমন কিছু ঘটবে যে আমি হাসিমুখে জেল থেকে বের হয়ে আসব। জহিরের বিয়েতে আমার সাক্ষী হবার কথা। হয়তো দেখা যাবে যথাসময়ে আমি কাজি অফিসে উপস্থিত হয়েছি।
ওসি সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব?
আমি বললাম, যে লোক আসলেই খুনটা করেছে। হয়তো দেখা যাবে সে অপরাধ স্বীকার করে পুলিশের হাতে ধরা দেবে, কিংবা পুলিশ বলবে উপরের নির্দেশে আমরা নিরপরাধ একটা লোককে ধরে এনে মামলা সাজিয়েছি। কী বলেন এ রকম কি ঘটতে পারে না?
ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। আমি বললাম, ভাই আপনি কি আমার ছোট্ট একটা উপকার করবেন? জেল-হাজতে ঢুকবার আগে আমি একজনের সঙ্গে দেখা করে যেতে চাই।
কার সঙ্গে?
একটা গাছের সঙ্গে। মানুষ জেল হাজতে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে।। গাছতো পারবে না। তার কাছ থেকে বিদায় নিতে হলে তার কাছেই যেতে হবে।
আমি রাধাচুড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। গাছের রোগমুক্তি ঘটেছে। পত্রে পুষ্পে সে ঝলমল করছে। বিকেলের পড়ন্ত আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে গাছের পাতায় আগুন ধরে গেছে। অপার্থিব কোনো আগুন। যে আগুনে উত্তাপ নেই— আলো আছে, আনন্দ আছে।
আমি গাছের গায়ে হাত রেখে বললাম, বৃক্ষ তুমি ভালো থেকো।
বৃক্ষ নরম কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল, হিমু তুমিও ভালো থেকো। ভালো থাকুক। তোমার বন্ধুরা। ভালো থাকুক সমগ্ৰ মানব জাতি।
(সমাপ্ত)