জ্বি না কিছু মনে করছি না।
আমি নিশ্চিত তুমি আমার কথায় হার্ট হয়েছ। তোমাকে হার্ট করার জন্যে কথাগুলি বলি নি। আমার নিজের ছেলে জহির যদি তোমার মতো জীবন যাপন করত। তাকেও আমি আমার পাশে বসতে দিতাম না।
খালু সাহেব। আবারো ম্যাগাজিন পাঠে মন দিলেন। এই পরিস্থিতিতে নিঃশব্দে উঠে অন্য কোথাও সরে যাওয়া উচিত। সেটি করছি না। মানুষটাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। রেগে তিনি তেতে থাকবেন, কিন্তু ভদ্রতা ও রুচিবোধের কারণে আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে নিচু গলায় প্রায় হাসিমুখে— এই দৃশ্যটি দেখতে ভালো লাগে। আদ্রতা এবং রুচিবোধ থাকারও বিপদ আছে।
আমি এখন জহিরের ঘরে। জহির হাত-পা সোজা করে বিছানায় লম্বা হয়ে হয়ে ঘুমুচ্ছে। গাঢ় ঘুম। এক বছর পর জহিরের সঙ্গে দেখা। মানুষের বয়স বাড়ে, এই ছেলের মনে হয়। বয়স কমছে। চেহারায় বালক বালক ভাব এসে গেছে। ঘুমন্ত জহিরকে দেখে মনে হচ্ছে তার স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সে রাত জেগে পড়ছে। মাঝখানে ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ শুয়েছিল, ভেবে রেখেছিল রেস্ট নিয়ে আবার পড়া শুরু করবে। রেস্ট নিতে নিতে ঘুম এসে গেছে। আমি ডাকলাম, এই জহির! এই!
জহির স্প্রিং-এর পুতুলের মতো উঠে বসল। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে রোবট টাইপ গলায় বলল, হিমু ভাইজান কটা বাজে?
আমি বললাম, সাড়ে আট।
জহির বলল, তোমার নটার মধ্যে আসার কথা। তুমি সাড়ে আটটায় চলে এসেছি। আশ্চর্য তো!
আমার নটার মধ্যে আসার কথা না-কি?
হুঁ। আমি তোমাকে কল দিয়েছি। সাতটা পাঁচ মিনিটে। তখনই বলে দিয়েছি বাই নাইন তুমি যেন চলে আস। মানুষ টাইমের পরে আসে, তুমি চলে এসেছ আগে।
কীভাবে কাল দিলি?
আধ্যাত্মিক উপায়ে কল দিয়েছি। ব্যাপারটা যে সত্যি সত্যি কাজ করবে বুঝতে পারি নি। আমার খুবই অবাক লাগছে।
মনে মনে আমাকে ডেকেছিস?
হুঁ। কীভাবে ডেকেছি শোন। প্ৰথমে দরজা জানালা বন্ধ করেছি। তারপর বিছানায় শবাসন করে শুয়েছি। হাত-পা সোজা করে সরলরেখার মতো শোয়া। চোখ বন্ধ করে। একমনে বলেছি–হিমু ভাইজান, তুমি যেখানেই থোক রাত নটার মধ্যে চলে আস। পঞ্চাশবারের মতো বলেছি। বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমিয়ে পড়ার কথা না। আমার ঘুম এসে গেছে। টেলিপ্যাথিক উপায়ে তোমার কাছে ম্যাসেজ চলে গেছে। তুমি চলে এসেছ। How Wonderful.
টেলিপ্যাথিক ডাকাডাকির বুদ্ধি কি তোর মাথাতেই এসেছে না কেউ দিয়েছে?
জহির গলা নিচু করে বলল, একটা মেয়ের কাছ থেকে এই বুদ্ধি পেয়েছি। এই মেয়েটার বাসায় টেলিফোন নেই। ওর যখন কাউকে ডাকার দরকার পড়ে তখন এভাবে ডাকে। তাতে নাকি কাজ হয়। মেয়েটার কথা আগে বিশ্বাস করি নি। এখন পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে।
আমি বললাম, মেয়েটার নাম কি ফুলফুলিয়া?
বেশ কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে থাকার পর জহির প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল, তুমি কীভাবে জানো?
সেটা দিয়ে তোর দরকার নেই। মেয়েটার নাম ফুলফুলিয়া কিনা বল?
হু! মেয়েটার বাবা তাকে ডাকেন ফুল। মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন ডাকতেন ফুলিয়া। মেয়েটা করেছে কী দুজনের নাম একত্র করে তার নাম দিয়েছে ফুলফুলিয়া।
তুই আমাকে ট্যালিপ্যাথিক পদ্ধতিতে ডেকে এনেছিস কেন? ফুলফুলিয়ার বিষয়ে কথা বলার জন্যে?
হু! তুমি এতসব জানো কীভাবে? ভাইজান তুমি খুবই বিস্ময়কর একজন মানুষ।
তুই নিজেও কম বিস্ময়কর না। যা হোক এখন ঘটনা। কী বল?
তোমাকে আর নতুন করে কী বলব। তুমি তো মনে হচ্ছে সবই জানো।
তা জানি, তবু তোর মুখ থেকে শুনি…
জহির চাপা গলায় প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল–ভাইজান আমি ঠিক করেছি। ফুলফুলিয়াকে বিয়ে করব।
ঠিক করে থাকলে করবি।
মা মনে হয় রাগ করবে। তাই না?
রাগ অবশ্যই করবে। তোর বাবার পিস্তল দিয়ে ফুলফুলিয়াকে গুলি করার সমূহ সম্ভাবনা।
ওকে কেন গুলি করবে? গুলি করলে আমাকে করবে।
মাজেদা খালা তোকে কিছুই বলবে না। তুই যদি একটা খুন করে এসে বলিস–মা আমি খুন করে এসেছি। তাহলে খালা বলবেন, ভালো করেছিস। এখন যা গোসল করে আয়–ভাত খা। ইলিশ মাছের ডিম রান্না করেছি।
জহির অবাক হয়ে বলল, এত কিছু থাকতে ইলিশ মাছের ডিমের কথা বললে কেন?
মনে এসেছে বলেছি। তুই এত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন?
মাছের ডিম খুবই অপছন্দের খাবার। ফুলফুলিয়ার আরেকটা পছন্দের খাবারের কথা শুনলে তুমি চমকে উঠবে।
শুকনা মরিচের সঙ্গে রসুন মিশিয়ে বেটে ভর্তা।
জহিরের মুখ হা হয়ে গেল। সত্যিকার বিস্মিত মানুষের মুখ দেখা খুবই আনন্দের ব্যপার। বেশির ভাগ মানুষই বিস্মিত হবার ভান করে, বিস্মিত হয় না। জহির সত্যি সত্যি বিস্মিত। তার হা করে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে আমি খুবই মজা পাচ্ছি।
জহির!
জ্বি ভাইজান?
ফুলফুলিয়া সম্পর্কে তোর পরিকল্পনা কী বল শুনি। খুব গুছিয়ে বলবি। তার আ.ে এক মিনিটের জন্যে চোখ বন্ধ করা।
কেন?
আমি একটা লাল বোতাম টিপব।
কীসের লাল বোতাম?
কীসের লাল বোতাম তোর জানার দরকার নেই। তোকে চোখ বন্ধ করতে বলছি তুই চোখ বন্ধ করা।
জহির বাধ্য ছেলের মতো চোখ বন্ধ করল। আমি ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারের বোতাম টিপে জহিরের সামনে রাখলাম।
এখন ইচ্ছা করলে চোখ মেলতে পারিস। লাজ করলে চোখ মেলার দরকার নেই। ফুলফুলিয়া সম্পর্কে তোর পরিকল্পনা গড়বড় করে বলে যা। ফিসফিস করবি না। উঁচু গলায় বলবি। প্রতিটি শব্দ যেন আলাদা করে বোঝা যায়। টু দ্য পয়েন্ট থাকিবি। ফেনাবি না। রেডি, গেট সেট গো…।