আব্দুর রহমান বললেন, হ্যাঁ।
এই লোকটা কি আপনাকে ক্ষুর দিয়ে ফালা ফালা করেছে?
আব্দুর রহমান আবারো হাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, মাথা নাড়লে হবে না। মুখে হ্যাঁ বলুন।
আব্দুর রহমান বললেন, হ্যাঁ।
আমি ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার উনার যে অবস্থা। আপনি উনাকে যাই জিজ্ঞেস করুন। উনি মাথা নাড়বেন। হ্যাঁ বলতে বললে বলবেন–হ্যাঁ। আপনি উনাকে জিজ্ঞেস করুন— গরু কি আকাশে উড়তে পারে? উনি বলবেন–হ্যাঁ।
ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আমার খালু সাহেবের মতো ইংরেজিতে আমাকে যা বললেন তার সরল বাংলা হলো— আমি কী জিজ্ঞেস বাঁ করব না। সেই বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নেব। তোমার কাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা, তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে।
আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার।
আব্দুর রহমান সাহেবের আত্মীয়স্বজনরা এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। তাদের কারো চোখে ভয়, কারো চোখে ক্ৰোধ, কারো চোখে তীব্র ঘৃণা। শুধু একটা পাঁচ ছ বছরের বাচ্চা মেয়ের চোখে প্রবল বিস্ময়। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, খুঁকি তোমার কী নাম? মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমার নাম উর্মি। আমি ক্লাস টুতে পড়ি।
আমি বললাম, ক্লাস টু খায় গু।
ঊর্মি ফিক করে হেসে ফেলল। বয়স্ক একজন মহিলা ধাক্কা দিয়ে ঊৰ্মিকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন।
ভালো থাকুক সমগ্ৰ মানব জাতি
ওসি সাহেবের ঘরে আমি বসে আছি। আমার সামনে ফুলফুলিয়া। সে আমাকে দেখতে এসেছে। ওসি সাহেব ভদ্রতা করে ফুলফুলিয়াকে তাঁর ঘরে বসিয়েছেন। আমাকে হাজত থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন। আমরা দুজন যেন নিরিবিলি কথা বলতে পারি। তার জন্যে নিজে ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে গেছেন। আমার হাতে হাতকড়া নেই, কোমরে দড়ি নেই। সকালে দাড়ি শেভ করার জন্যে ওসি সাহেব ডিসপোজেবল শেভার এবং শোভিংক্রিম পাঠিয়েছিলেন। খাওয়া-দাওয়া তাঁর বাসা থেকেই আসছে। আজ দুপুরের পর আমাকে থানা হাজত থেকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওসি সাহেবের সমস্যার সমাধান। বেচারা খুবই লজ্জার মধ্যে পড়ে গেছেন। কেইস সাজানো এত নিখুঁত হবে সেটা মনে হয়। ভবেন নি।
তারপর ফুলফুলিয়া কেমন আছ?
ফুলফুলিয়া জবাব দিল না। চেয়ারে বসা ছিল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর ব্যাপারটা তরুণী মেয়েদের মধ্যে নেই।
আমি যে হাজতে আছি খোঁজ পেলে কী করে?
সব পত্রিকায় আপনার ছবি ছাপা হয়েছে। আপনি ক্ষুর হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার হাতে হাতকড়া পরানো। আপনার সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার। তার হাতে পিস্তল।
ছবিটা সুন্দর হয়েছে?
খুব ভালো হয়েছে। কোনো খুনি আসামি ক্ষুর হাতে এমন হাসিমুখে ছবি তুলে না। আপনার মুখ ভর্তি হাসি। এই ঝামেলায় আপনি ইচ্ছা করে জড়িয়েছেন, তাই না?
মানুষ ইচ্ছা করে ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
ভুল বললেন। প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ইচ্ছা করে ঝামেলায় জড়ায়। মানুষ ঝামেলা পছন্দ করে।
ফুলফুলিয়া দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।
ফুলফুলিয়া বসল। আমি বসলাম তার পাশে এবং মুগ্ধ হয়ে তাকালাম। ফুলফুলিয়াকে আজ ইন্দ্রাণীর মতো লাগছে। আজ যে তার সাজাগোজের পরিবর্তন হয়েছে তা না। তার বাবার বাজনা রেকর্ডিং-এর দিন যে শাড়ি পরা ছিল সেই শাড়িটিই সে পরেছে। চোখে কাজল দেয় নি বাঁ মুখে পাউডার দেয় নি। মেয়েদের এই একটি বিশেষ ব্যাপার আছে–দিনের কোনো কোনো সময়ে তাদের ইন্দ্রাণীর মতো লাগে।
ফুলফুলিয়া বলল, বাবার সিডিটা বের হয়েছে। আপনি অসাধারণ একজন মানুষ। সত্যি সত্যি সিডি বের করেছেন?
কই দেখি কেমন হয়েছে।
আমি আনি নি। বাবার ইচ্ছা সিডিটা উনি নিজে আপনার হাতে দেবেন।
উনি কেমন আছেন?
ভালো না।
ভালো না মানে কি?
তিনি কারো সঙ্গেই কথা বলছেন না। ডাক্তাররা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না।
তাকে কি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে?
জি। হাসপাতালের বেডে তিনি হাত-পা সোজা করে লম্বা হয়ে পড়ে থাকেন। কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দেন না।
তোমার কথারও জবাব দেন না?
না। শুধু গতকাল রাতে অতীশ দীপংকর রোডের রাধাচুড়া গাছটার কথা বললেন। গাছটা দেখে আসতে বললেন।
তুমি নিশ্চয়ই গাছ দেখতে যাও নি?
না, আমি যাই নি। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খুব হাস্যকর লাগছে। একটা মানুষ তার নিজের জীবন গাছকে দিয়ে সে গাছ হয়ে যাবে। একজন উন্মাদও তো এভাবে চিন্তা করবে না।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তোমার বাবা গাছ হয়ে গেলে তোমার জন্যই তো সুবিধা।
ফুলফুলিয়া অবাক হয়ে বলল, আমার জন্যে কী সুবিধা?
তোমাকে আগলে আগলে রাখবেন না। তোমার সঙ্গে যাতে কোনো তরুণের পরিচয় না হয় তার জন্যে আগ বাড়িয়ে বলবেন না যে আমার মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্বামী থাকে নাইক্ষ্যংছড়ি।
ফুলফুলিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পলকহীন মাছের দৃষ্টি। আমি বললাম, যতদিন তোমার বাবা বেঁচে থাকবেন ততদিন তোমার জীবন শুরু হবে না।
একজন মানুষের মৃত্যুর ব্যাপার আপনি এত সহজে বলতে পারলেন?
হ্যাঁ পারলাম।
আপনি পাথরের মতো মানুষ, এটা জানেন?
জানি।
যদি আপনার ফাঁসি হয় আপনি কি হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় দিতে পারবেন?
চেষ্টা অবশ্যই করব। পারব কি-না বুঝতে পারছি না।
চেষ্টা কেন করবেন? আপনি আলাদা, আপনি অন্যদের মতো না, এটা প্ৰমাণ করার জন্যে?
আমরা কেউ তো কারো মতো নাই। আমরা সবাই আলাদা।