কেমন লাগছে জেনে?
ভালো লাগছে এই ভেবে যে মৃত্যুর ঠিক আগে বলা কথার উপর আপনারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। মৃত্যুপথ যাত্রীকে সম্মান দেখাচ্ছেন। যদিও এটা করা ঠিক না।
কেন ঠিক না?
মৃত্যুর আগে মানুষের মাথা এলোমেলো থাকে। চিন্তা-ভাবনা লজিক সব পাল্টে যায়। সেই সময়ের কথার কোনো গুরুত্ব থাকা উচিত না। আমার বাবা মৃত্যুর সময় আমাকে বলেছিলেন–হিমু, তোর মা আমাকে নিতে এসেছে। তোর পাশের চেয়ারে বসে আছে। সে এত রেগে আছে কেন বুঝতে পারছি না। এখন স্যার আপনি বলুন যে লোক এই কথা বলছে তার কোনো কথার কি গুরুত্ব দেয়া উচিত?
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চোখ মুখ কুঁচকে বলবেন, তোমার মতো ক্রিমিনালের সঙ্গে এইসব আলাপ করার কোনো ইচ্ছা নেই। শুধু জেনে রাখ— তোমার খবর আছে।
আপনিও জেনে রাখুন। স্যার। আমাদের সবারই খবর আছে।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চলে যাবার পরপরই পত্রিকার রিপোর্টাররা এলো। পুলিশের এত বড় সাফল্য। ভয়ঙ্কর একজন ক্রিমিন্যালকে ক্ষুর হাতে ধরে ফেলেছে। খবরটা পত্রিকায় যাবে। আমাকে একটা রক্তমাখা ক্ষুর দেয়া হলো। সেই ক্ষুর হাতে নিয়ে আমি দাঁড়ালাম। আমার পাশে খোলা পিস্তল হাতে সেকেন্ড অফিসার দাঁড়ালেন। ছবি তোলা হলো। ছোটখাট ইন্টারভ্যু হলো। রিপোর্টার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? আমি বললাম। আমার নাম–হিমু।
শুধু হিমু?
জ্বি না–চন্দ্র হিমু। বেশির ভাগ সময় চাঁদে বাস করি বলে চন্দ্র হিমু।
সকালের নাস্তা খেয়ে আমি দুপুর পর্যন্ত হাজতে ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে আরাম করে দুপুরের খাবার খেলাম। ওসি সাহেবের জন্যে বাসা থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার এসেছিল। তিনি ডিউটিতে যাবেন। সেখানেই দুপুরের খাবার খাবেন বলে টিফিন কেরিয়ার তিনি আমাকে দিয়ে গেলেন। চারটা বাটিতে অনেক আয়োজন। করলা ভাজি, কচুর মুখির ভরতা, ইলিশ মাছের ঝোল, লাল লাল করে ভাজা ছোট চিংড়ি। টিফিন কেরিয়ারের প্রথম বাটিতে পলিথিনে মোড়া একটা চিঠিও পাওয়া গেল। ওসি সাহেবের মেয়ের লেখা চিঠি।
বাবা,
চিংড়ি মাছের ভাজা আমি রান্না করেছি। মা শুধু মশলা মাখিয়ে দিয়েছে। চিংড়ি মাছটা প্রথম খাবে। প্রথমে চিংড়ি মাছ না খেয়ে অন্য কিছু খেলে আমি খুব রাগ করব। বাবা তুমি জানো চিংড়ি মাছ কিন্তু মাছ না— পোকা। চিংড়ি মাছের গু থাকে মাথায়। এটা কি জানো? এটা আমাকে বলেছে রহিমা বুয়া।
তবে সে খুব মিথ্যা কথা বলে। আর চিংড়ি মাছ যে পোকা এটা বলেছে মা। চিংড়ি মাছ যদি পোকা হয় তাহলে আমরা কেন চিংড়ি মাছ বলি? আমরা কেন চিংড়ি পোকা বলি না? বাবা এখন তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি।
বলো তো
তিন অক্ষরে নাম তাঁর
বৃহৎ বলে গণ্য
পেটটি তাহার কেটে দিলে
হয়ে যায় অন্ন।
এটা কী? একটু চিন্তা করলেই পারবে। এই জিনিসটা তুমি আজ খাবে। জিনিসটার রঙ সাদা।
আজ এই পর্যন্ত। এবার তাহলে (৭০+১০)। তুমি ভালো থেকে। কেমন?
তোমার আদরের মেয়ে
Pয়াল
দুপুরে খাবার পর আরেকবার লম্বা ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙলো সেন্ট্রি পুলিশের ডাকাডাকিতে। আমাকে মেডিকেল কলেজে যেতে হবে। আবদুর রহমানের জ্ঞান ফিরেছে। ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে তাঁর সামনে আমাকে হাজির করা হবে। আব্দুর রহমান সাহেব আমাকে দেখে বলবেন— আমিই সেই ব্যক্তি কিনা। ওসি সাহেব নিজেই আমাকে নিয়ে যাবেন। আমি তাকে তার কন্যা পিয়ালের চিঠির কথা বললাম। তিনি চুপ করে রইলেন। মনে হলো খুবই চিন্তিত। আমি বললাম, এত চিন্তিত কেন?
ওসি সাহেব বললেন, আপনাকে নিয়ে চিন্তিত। আপনি ঠিকই বলেছিলেন। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। আপনাকে নিয়ে যখন তার সামনে হাজির করা হবে, ম্যাজিস্ট্রেট যখন বলবে–এই কি সেই ব্যক্তি? আব্দুর রহমান অবশ্যই বলবে, হুঁ। কিছু না বুঝেই বলবে। আগে এ রকম দেখেছি। নিরাপরাধ লোক হাজির করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করেছে— এই কি আপনাকে গুলি করেছিল? গুলি খাওয়া মানুষ সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, জ্বি।
নিরাপরাধ মানুষটাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে?
হুঁ।
আমি ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি এত চিন্তিত হবেন না। ফাঁসিতে বুলতে হলে বুলিব। এতে আপনার নাম ফাটবে। উপরওয়ালার নির্দেশে এমন মামলা সাজানো হয়েছে যে পাঁচ বছর জেলে থাকার বদলে ফাঁসিতে ঝুলে পড়তে হয়েছে।
ওসি সাহেব। আবারো বললেন, হুঁ।
আমি বললাম, একটা সিগারেট দিন। ধুয়া ছাড়তে ছাড়তে যাই।
ওসি সাহেব সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, প্যাকেটটা রেখে দিন।
আব্দুর রহমান পুলিশ পাহারায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। তাকে ঘিরে আছে আত্মীয়স্বজন। তিনি কাউকে চিনতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর নাকে অক্সিজেনের নল। মাথার ওপর স্যালাইনের বোতল ঝুলছে। একটা হাত উঁচু করে বাঁধা।
ভদ্রলোক হা করে আছেন। নাক দিয়ে স্যালাইন দেয়া হলেও তিনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন মুখে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। তার বুকে ব্যান্ডেজ। সেই ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে।
সকালের তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আবদুর রহমানের পাশেই চেয়ারে বসে আছেন। তার হাতে ফাইলপত্র। তিনি আমাকে দেখিয়ে উঁচু গলায় বললেন, চাচামিয়া একে চিনতে পারছেন? আব্দুর রহমান মাথা নাড়লেন।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, মাথা নাড়লে হবে না। মুখে বলতে হবে, হ্যাঁ। বলুন হ্যাঁ।