পুলিশ অফিসারের স্ত্রী এই পর্যায়ে ভীত গলায় বলবে— আগ বাড়িয়ে তোমার সাহস দেখানোর দরকার কী? অতিরিক্ত সাহসের জন্যেই তুমি একদিন বিপদে পড়বে। খবরদার আর কখনো তুমি এমন ভয়ঙ্কর অপরাধীকে ধরতে যাবে না। এ ধরনের ভয়ঙ্কর ক্রিমিনালদের ধরার জন্যে তুমি ছাড়া কি আর লোক নেই? এদের ধরার বেলােয়ই শুধু তোমার ডাক পড়ে কেন?
আমাকে গ্রেফতার করেছেন মোহাম্মদপুর থানার সেকেন্ড অফিসার। তিনি আমাকে থানায় জমা দিয়ে আরেকজন কাকে যেন গ্রেফতার করতে গেলেন। আমি থানার ওসি সাহেবের কাছ থেকে জানতে পেলাম আমার অপরাধ গুরুতর। ভোর পাঁচটার সময় আব্দুর রহমান নামের এক লোক ব্যাগে দশ হাজার টাকা নিয়ে হেঁটে হেঁটে কাওরান বাজারের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় ধারালো ক্ষুর হাতে আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। তাকে আহত কয়ে ব্যাগ নিয়ে ছুটে পালানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। পুলিশ। হ্যান্ডব্যাগ, টাকা এবং রক্তাক্ত ক্ষুর উদ্ধার করেছে এবং আমাকে এ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে এসেছে।
আমি ওসি সাহেবকে বললাম, মামলাটা ভালো সাজাতে পারেন নি। ভোর পাঁচটায় কেউ দশ হাজার টাকা নিয়ে হেঁটে হেটে কাওরান বাজার যাবে না। দিনকাল খারাপ। স্যার আপনি এক কাজ করুন–টাকার পরিমাণ কমিয়ে দিন। চারশ টাকা করে দিন। অনেক বিশ্বাসযোগ্য হবে। চারশ টাকার জন্যেও খুন হয়।
ওসি সাহেব বললেন, আপনার কাছে তো পরামর্শ চাচ্ছি না।
পুলিশ এত দুর্বলভাবে মামলা সাজাচ্ছে–ভাবতেই খারাপ লাগছে। পুলিশ মামলা সাজানোর পরও তাতে ফাঁক থাকবে তা কেমন করে হয়? আব্দুর রহমান সাহেবের শরীরে ক্ষুরের দাগ আছে তো? নাকি তাও নেই।
বেশি কথা বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা, বেশি কথা বলব না।
আপনার বিরুদ্ধে যে চার্জ আনা হয়েছে আপনি কি তা অস্বীকার করতে চান।
সবই স্বীকার করছেন?
অবশ্যই। শুধু দশ হাজার টাকাটা বাদ। টাকার পরিমাণটা কমাতে হবে। টাকাটা কমিয়ে চারশতে নিয়ে আসুন।
ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্টেটমেন্ট দেবেন?
জ্বি দেব।
চা খাবেন না-কি?
জ্বি স্যার চা খাব। সকালে নাশতাও খাই নি।
চা-নাশতার ব্যবস্থা করছি। আপনি জেনেশুনে মিথ্যা স্টেটমেন্ট দিতে চাচ্ছেন কেন?
আপনারা চাচ্ছেন, কাজেই আমি চাচ্ছি। আমি স্টেটমেন্ট দিতে রাজি না হলে তো মারধর করে রাজি করবেন। খামাখা মার খেয়ে লাভ কী?
ভালো লজিক। হিমু সাহেব শুনুন –উপরের নির্দেশে আমাদেরকে মাঝে মাঝে কিছু অন্যায় করতে হয়।
খারাপ লাগে না।
প্রথম দুই বছর খারাপ লাগে, তারপর আর খারাপ লাগে না। অভ্যাস হয়ে যায়। মানুষ অভ্যাসের দাস। আপনার চাকরি কত দিন হয়েছে?
পাঁচ বছর।
অনেক দিন তো হয়ে গেল। আপনার খারাপ লাগার কথা না। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগছে কেন?
ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আমি ওসি সাহেবের দিকে ঝুকে এসে বললাম, যে আব্দুর রহমান সাহেবের গায়ে ক্ষুর দিয়ে আমি টান দিয়েছি, তার সঙ্গে কি কথা বলতে পারি?
না।
না কেন?
সে গুরুতর আহত। হাসপাতালে আছে। জ্ঞান নেই।
মরে যাবে না তো?
মরে যেতেও পারে। অবস্থা ভালো না।
মরে গেলে তো আমি খুনের দায়ে ফেঁসে যাব।
তা যাবেন।
ফাঁসিতে বুলতে হবে?
ওসি সাহেব ফাইল থেকে মুখ তুলে আমাকে আশ্বস্ত করার মতো গলায় বললেন, ফাঁসি হবে না। প্রত্যক্ষদশী কেউ নেই। যাবজীবন হবে। এখনো ভেবে বলুন। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্টেটমেন্ট দেবেন? আমার উপর নির্দেশ আছে আপনাকে কোনো কঠিন মামলায় ফাঁসানো। যাতে চার-পাঁচ বছর আপনি জেলে থাকেন। আমি সেই ব্যবস্থা ভালোমতো করেছি।
প্রমোশন নিশ্চয়ই পাবেন?
ওসি সাহেব সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সিগারেট টানতে লাগলেন। তাকে সামান্য চিন্তিত মনে হলো।
সকাল দশটায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে লিখিত স্টেটমেন্টে দস্তখত করলাম। অল্পবয়েসী ম্যাজিস্ট্রেট। বিসিএস পাশ করে সদ্য জয়েন করা তরুণ। সে আমার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, তুমি যখন মানুষটাকে ক্ষুর দিয়ে পোচ দিচ্ছিলে তখন তোমার একটুও খারাপ লাগে নি?
আমি হাসি মুখে বললাম, জ্বি না। স্যার।
একবারও ভাবলে না লোকটা মরে যেতে পারে?
মরে তো সবাই যাবে। মানুষ মরণশীল।
মানুষ মরণশীল। এই ফ্রেজিও জান?
জ্বি জানি।
পড়াশোনা কতদূর?
পড়াশোনা বেশিদূর না। আমি স্বশিক্ষিত।
শিক্ষা তো ভালোই পেয়েছ। মানুষ মেরে ব্যাগ নিয়ে দৌড় দিয়েছ। এই শিক্ষা কার
কাছে পেয়েছ?
এই শিক্ষা স্যার পুলিশের কাছ থেকে পেয়েছি। শিক্ষক হিসাবে পুলিশ খারাপ না।
মাস্তান হয়েছ না?
মাস্তান হওয়া তো স্যার খারাপ কিছু না। মাস্ত থেকে মাস্তান। মাস্ত মানে হলো মত্ত। ঈশ্বরপ্রেমে যে মত্ত সে মাস্ত। সেই মাস্ত থেকে মাস্তান। মাস্তান হতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার।
তোমার গলার কাছে ফাঁসির দড়ি ঝুলছে এটা জানো? ফাঁসির দড়ি তো স্যার সবার সামনেই বুলিছে। আপনার সামনেও ঝুলছে। ওসি সাহেবের সামনেও ঝুলছে। তবে আপনাদের দড়ি দৃশ্যমান না। দেখা যাচ্ছে না। আমারটা দেখা যাচ্ছে।
ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, যাকে তুমি ক্ষুর দিয়ে আহত করেছ সে অজ্ঞান অবস্থায় আছে। জ্ঞান যদি কিছুক্ষণের জন্যে ফেরে তাহলে তার ডেথ বেড স্টেটমেন্ট নেব। ডেথ বেড কনফেসনের ওপর ফাঁসি হয়ে যায়–এটা জানো?
জানতাম না। এখন জানলাম।