দ্বিতীয় খবর, এই খবরটা মজার। চুল দাড়ির কারণে অনেকেই আমাকে পীর ফকির ভাবতে শুরু করেছে। কোনো বাড়িতে খেতে চাইলে আগ্রহ করে খাওয়াচ্ছে। গত বুধবার রাতে কী হয়েছে শুনলে তুমি খুবই মজা পাবে। আমি এক বাড়িতে রাতে থাকার জন্যে জায়গা চেয়েছি, তারা সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাঘরে আমার থাকার জায়গা দিয়েছে। গোসল করার জন্যে গরম পানি। যেন অনেক দিন পরে বাড়িতে মেহমান এসেছে। গোসল শেষ করে। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমুতে যাব এমন সময় চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কোলে নিয়ে তার বাবা-মা উপস্থিত। বাচ্চাটা পেটের ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছে। বাবা মা চাচ্ছে। আমি যেন মেয়েটার পেটে একটা ফুঁ দিয়ে দেই। চিন্তা কর কী অবস্থা। আমাকে কে ফুঁ দেয়। তার নাই ঠিক। শেষে দাঁত মুখ খিচিয়ে দিলাম। একটা ফু। আমার দাঁত মুখ খিচানো দেখে মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়েছে। ভয়েই তার ব্যথা কমে গেল। মেয়ের বাবা-মা যত না অবাক আমি তার চেয়েও অবাক। মেয়ের বাবা একটা বিশ টাকার নোট আমাকে দিতে গেল। আমি গম্ভীর গলায় বললাম–টাকা দিয়ে কী হয়? টাকা দিয়ে তুমি কি চাঁদের আলো কিনতে পারবে? খুবই ফিলসফি মার্ক কথা। নিজের কথা শুনে আমি নিজেই মুগ্ধ! ঐ বাড়ি থেকে মোটামুটি আমি একজন পীর সাহেব হিসেবে বের হলাম। বাড়ির মানুষ খুবই অবাক, যখন আমি সকালের নাশতা খেলাম না। আমি বললাম, দিনে আমি কিছু খাই না। সূর্য ডোবার পর একবেলা খাই। ঘটনা অবশ্যি এ রকমই। ভরপেটে হাঁটতে কষ্ট হয়। তবে ঐ বাড়ির লোকজন ভেবেছে আমি সারাদিন রোজা রাখি। আমি কারো ভুল ভাঙ্গাচ্ছি না। নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পীর ভাবতে ভালো লাগছে। কেউ যখন আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করে তখন বলি–পরিচয় তো ভাই জানি না। পরিচয়ের খোঁজেই পথে পথে হাঁটছি। খুবই উচ্চমার্গের কথা।
এখন তোমাকে জরুরি একটা কথা বলি। ফুলফুলিয়ার সঙ্গে তোমার কি কোনো যোগাযোগ আছে? এক রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম ফুলফুলিয়ার বাবা খুবই অসুস্থ। তাকে খোলা মাঠে শুইয়ে রাখা হয়েছে। গাছের পাতা দিয়ে তার সারা শরীর ঢাকা। ফুলফুলিয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিজেকে বোরকায় ঢেকে বাবার চারদিকে ঘুরছে। স্বপ্নটা দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। যদিও জানি স্বপ্ন কোনো ব্যাপার না। সারাক্ষণ ফুলফুলিয়ার কথা ভাবি বলেই এমন স্বপ্ন দেখছি।
ভাইজান, আমি তোমাকে নিয়েও একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম পুলিশ এসে তোমাকে ধরেছে এবং জেলখানায় নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের হাতে ধরা খাওয়া তোমার জন্যে নতুন কিছু না। প্রায়ই তো তুমি থানা হাজতে রাত কাটাও। আমি এটা নিয়ে ভাবছি না। শুধু ফুলফুলিয়ার স্বপ্নটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা লাগছে। ভাইজান শোন, ঢাকায় এসে আমি যদি ফুলফুলিয়ার সঙ্গে দেখা করি। সেটা কি খুব খারাপ হবে? তুমি যা বলবে তাই করব।
তুমি ভালো থেকো।
হ্যান্ডস আপ
ভোর পাঁচটায় পুলিশ আমাকে এ্যারেস্ট করল। টিভি নাটকের মতো দৃশ্য। একজন পুলিশ অফিসার পিস্তল হাতে ঢুকলেন। তাঁর পিছনে দুই দুবলা পুলিশ। রাইফেলের ভারে মাথা ঘুরে যে-কোনো সময় পড়ে যাবে এমন অবস্থা। পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকেই হুঙ্কার দিলেন–হ্যান্ডস আপ।
আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, স্যার ভালো আছেন?
পুলিশ অফিসার আগের মতোই হুঙ্কার টাইপ গলায় বললেন, ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট।
কিছু কিছু বাক্য আছে ইংরেজিতে না বললে ভালো শুনায় না। ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট এরকম একটি বাক্য। বাংলায় যদি বলা হয়, তোমাকে গ্রেফতার করা হলো। তা হলে পানশে শুনাবে। হুমকি ধমকির জন্য এবং কুকুরের সঙ্গে কথা বলার জন্যে ইংরেজি ভাষার কোনো তুলনা হয় না।
পুলিশ অফিসার এখনো পিস্তল উচিয়ে আছেন। ভাবখানা এরকম যে আমি ভয়ঙ্কর কোনো সন্ত্রাসী। আমার নাম হিমু না। আমার নাম মুরগি হিমু কিংবা সুইডেন হিমু।
স্যার আমার অপরাধটা কী?
সেটা থানায় গিয়ে জানবে। ততক্ষণে দুবলা পুলিশের একজন আমার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়েছে। কোমরে দড়ি বাঁধার চেষ্টা করছে। গিট দিতে পারছে না। আসামির কোমরে দড়ির গিট দেয়ার বিশেষ পদ্ধতি আছে। আন্ধা গিন্টু দিলে হবে না।
স্যার দুটা মিনিট সময় যদি দেন। বাথরুমে যাবার প্রয়োজন ছিল।
অ্যাগে থানায় চল। তারপর বাথরুম। বদমায়েশ কোথাকার!
কোমরে দড়িবাঁধা অবস্থায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। অন্য একজন পুলিশ আমার বিছানা উল্টাচ্ছে। চৌকির নিচে উকিঝুকি দিচ্ছে। পুলিশ অফিসার চোখে কী একটা ইশারা করলেন— আমি আমার বালিশ ছুড়ে তুলা বের করে চারদিক ছড়িয়ে দিল।
মেসের লোকজন। এরমধ্যে খবর পেয়ে গেছে। তারা সবাই বারান্দায় ভিড় করেছে। পুলিশ অফিসার তাদের দিকে তাকিয়েও হুঙ্কার দিলেন— ভিড় করবেন না। খবরদার ভিড় করবেন না। তার হাতে এখনো পিস্তল ধরা। মনে হচ্ছে তিনি টিভি প্যাকেজ নাটকের অভিনতা। দুর্দান্ত পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। পরিচালকের নির্দেশে প্রতিটি ডায়ালগ পিস্তল নাচিয়ে বলতে হচ্ছে।
অনুসন্ধান করে কিছু পাওয়া গেল না। পুলিশ অফিসার ছোটখাট একটা প্রসেশন করে আমাকে নিয়ে গাড়িতে তুললেন। তাঁর মুখে বিমলানন্দ। মনে হয় এই প্রথম তিনি কাউকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পেয়েছেন। আজ রাতে স্ত্রীর সঙ্গে মজা করে। গল্প করবেন–জীবনবাজি রেখে এ্যারেষ্ট করেছি। অন্ধকার থাকতেই ক্রিমিন্যাল কর্ডন করে ফেললাম। দরজা ভেঙে কেউ ঢুকতে চায় না। রিসকি ব্যাপার তো। এরা বিছানার পাশে কাটা রাইফেল নিয়ে ঘুমায়। এদের হাতের নিশানাও থাকে ভালো। কেউ যখন দরজা ভাঙতে রাজি হচ্ছে না। তখন আমিই এগিয়ে গেলাম। হাতে খোলা পিস্তল নিয়ে দরজা ভেঙে হারামীটার উপর লাফিয়ে পড়লাম। সে তোষকের নিচে রাখা কাটা রাইফেলে হাত দিয়ে ফেলেছিল— তার আগেই হাতে হ্যান্ডকাফ।