চাই–কিন্তু এখন না। বাজনা শুরু হবে।
মেয়েটা কোথায় লুকিয়ে আছে?
রেকর্ডিং-এর কয়েকটা স্টুডিও আছে, ওর একটাতে লুকিয়ে রেখেছি। তুমি এক কাজ কর, তোমাকেও সেখানে লুকিয়ে রাখি। তুমি স্পাইয়িং করে ঘটনা বের করে ফেল।
তুই আমাকে ভাবিস কী? আমার কি স্পাইগিরি করা স্বভাব? আমি যদি ঐ ঘরে থাকি মেয়েটাকে সান্তুনা দেবার জন্যে থাকব। এত মানুষের সামনে অপমানিত হয়েছে। একটা মেয়ে মানুষ।
প্রফেশনাল একজন সভাপতিকে আসতে বলা হয়েছিল। (অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা রাজনীতিতে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দৌড় এলেবেলে অনুষ্ঠানের সভাপতি পর্যন্ত।) গাড়ি না পাঠানোয় তিনি আসেন নি। তবে আমার টেলিফোনওয়ালা এসেছে। নিজের লোকের মতো ছাটোছুটি করে চা খাওয়াচ্ছে। পানি খাওয়াচ্ছে।
মাইক অনা হয়েছে। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ওকে সিগন্যাল দিয়েছে। লালবাতি জ্বলেছে। ওস্তাদ শমসের উদ্দিন খাঁ এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম, কিছু বলবেন?
শমসের উদ্দিন বিব্রত গলায় বললেন, ফুলফুলিয়া কি সত্যি চলে গেছে? আমি বললাম, না। আপনার পাশের ঘরেই লুকিয়ে আছে। আপনার বাজনা না শুনে সে যাবে না।
শমসের উদ্দিন বললেন, আপনি কি দয়া করে আমার মেয়েটাকে বলবেন, সে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। আমি অনেক অপরাধ অনেকবার করেছি, কখনো তার জন্যে ক্ষমা চাই নাই। আজ আমি আমার মেয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এইটা তাকে জানিয়ে আসুন, তারপর বাজনা শুরু করব।
আপনার মেয়েকে কিছু বলতে হবে না। মাইক অন করা আছে। আপনার কথা সবাই শুনতে পাচ্ছে।
ও আচ্ছা, ঠিক আছে।
আপনার কি শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
শরীর খারাপ লাগছে। কিন্তু অসুবিধা নাই। বিসমিল্লাহ।
শমসের উদ্দিন খাঁ ব্যাঞ্জোর উপর বুকে পড়লেন। প্ৰথমে টুং করে একটা শব্দ হলো। তারপরে দুবার টুং-টাং! তারপরই মনে হলো টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। একেকবার দমকা হাওয়া আসছে বৃষ্টি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে— আবার ফিরে আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। না, এখন আর বৃষ্টির শব্দ বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে শিকলপরা বন্দিনী রাজকন্যা কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ আসছে একই সঙ্গে তার পায়ের শিকলের শব্দও আসছে। মায়া ধর্ম গ্রন্থে ঈশ্বর বলেছেন।–
হে পতিত মানবসন্তান। তোমরা ভুল জায়গায় আমাকে অনুসন্ধান করো না। আমাকে অনুসন্ধান করা সঙ্গীতে। আমি ছন্দময় সঙ্গীত। আমার সৃষ্টি ছন্দময় সঙ্গীত। আমার ধ্বংস ছন্দময় সঙ্গীত।
বাজনা শেষ হলো। ফুলফুলিয়ার ঘরে ঢুকে দেখি সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। খালা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখেই খালা বললেন, ওস্তাদজীকে এ রকম মন খারাপ করা বাজনা বাজাতে নিষেধ করা। মেয়েটা কোঁদে অস্থির হচ্ছে। গান বাজনা মানুষকে আনন্দ দেবার জন্যে। কাদাবার জন্যে তো না। তুই এক্ষুণি গিয়ে উনাকে আমার কথা বলে নিষেধ করবি। আমার কথা উনাকে শুনতে হবে। আমি প্রডিউসার। টাকা আমি দিচ্ছি।
টাকা তুমি দিচ্ছ?
অবশ্যই। কত টাকা দিতে হবে বল। চেক বই সঙ্গে আছে। চেক লিখে দিচ্ছি। বাজনার দ্বিতীয় অংশ শুরু হয়েছে। ফুলফুলিয়ার কান্না থেমেছে। সে মন্ত্ৰমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে। যেন সে এই ভুবনে নেই। তার যাত্রা শুরু হয়েছে। অন্য কোনো ভুবনের দিকে। খালার চোখে পানি টলমল করছে। আমার সামনে তিনি যদি চোখের পানি ফেলেন তাহলে খুব লজ্জায় পড়বেন। আমি ঘরের বাইরে চলে এলাম।
হে মানবসন্তান আমি নানান রূপে তোমাদের সামনে নিজেকে উপস্থিত করেছি। চোখ মেললেই আমাকে দেখবে। কান পাতিলেই আমাকে শুনবে। কেন তোমরা চোখ ও কান দুই-ই বন্ধ করে রেখেছ?
হিমু ভাইজান
হিমু ভাইজান,
এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছবে কি-না। আমি বুঝতে পারছি না। আমার হাতে এখন কোনো টাকা-পয়সা নেই। চিঠিটা লিখে খামে ভরে, খামের উপর তোমার মেসের ঠিকানা লিখে এক মুদির দোকানির হাতে দিয়েছি। সে যদি পাঠায় তাহলে হয়তো পাবে। মুদি দোকানির চেহারাটা সরল টাইপ। সে বিনে পয়সায় আমাকে একটা গায়ে মাখা সাবান দিয়েছে। তার দেয়া সাবান দিয়ে অনেক দিন পর সাবান মেখে গোসল করেছি। দোকানির নাম কুদ্দুস মিয়া। বাড়ি রংপুর। বিয়ে করেছে খুলনায়। এই চিঠি তোমার হাতে পৌছবে এটা ভেবেই লিখছি। শুরুতে আমার খবর সব দিয়ে নেই।
প্রথম খবর আমি নর্থ বেঙ্গল হাঁটা শেষ করেছি। এখন আছি। যমুনা নদীর পড়ে। পা ফুলে গেছে বলে হাঁটতে পারছি না। এক দুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করব। ঠিক করেছি। ঢাকা হয়ে যাব। আমাকে দেখলে এখন তুমি চিনতে পারবে না। দাড়ি গোঁফ গজিয়ে বিন লাদেনের মতো চেহারা হয়ে গেছে। শরীরের রঙও জ্বলে গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে খুবই মজা লাগে। সমুদ্রে ড়ুব দিয়ে দাড়ি গোঁফ কামিয়ে ফেলব বলেছিলাম— এখন আর কামাতে ইচ্ছা! করছে না। মায়া পড়ে গেছে। দাড়ির জন্যে একটা অসুবিধা শুধু হচ্ছে। উকুন। চিরুনি দিয়ে আচড়ালেই পুট পুট করে উকুন পড়ে। মাথার চুলের উকুন এবং দাড়ির উকুন কিন্তু আলাদা। দাড়ির উকুন সাইজে ছোট, একটু সাদাটে রঙ আছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত কোনো গবেষণা হয়েছে কি-না কে জানে। গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। দাড়ির উকুন মাথায় যায় না। মাথার উকুন দাড়িতে আসে। না। তাদের সীমানা নির্দিষ্ট। যেন উকুনরা দুটা আলাদা দেশের অধিবাসী। কেউ বর্ডার ক্রস করে না।