ফুলফুলিয়া বলল, যন্ত্রণা আমারও ভালো লাগে না। আমি সারাজীবন তোমার যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করেছি। এখন তুমি কিছুক্ষণ আমার যন্ত্রণা সহ্য করবে।
তুই কী করবি?
আমি তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব।
জোর করে বাসায় নিয়ে যাবি?
হ্যাঁ জোর করে বাসায় নিয়ে যাব।
খাঁ সাহেবের দুটা চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠল। তিনি স্টুডিওর সবাইকে চমকে এলিয়ে পড়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। নিজেকে সামলাবার জন্যে কিছুটা সময় নিল। তারপর শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে তুলতে সহজ গলায় বলল, বাবা রেকর্ডিং শেষ করে চলে এসো। আমি বাসায় যাচ্ছি।
খাঁ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, রেকর্ডিং-এর সময় তুই থাকিবি না?
ফুলফুলিয়া বলল, না। আমি না থাকলে তোমার জন্যে ভালো আমার জন্যেও ভালো।
খাঁ সাহেব বললেন, যেখানে ইচ্ছা যা। আমি বাকি জীবন তোর মুখ দেখতে চাই না।
ফুলফুলিয়া কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল।
গল্প উপন্যাসে প্রায়ই পাওয়া যায়–এমন প্রচণ্ড চড় দেয়া হয়েছে যে গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। এই ব্যাপার বাস্তবে ঘটে না। বাস্তবে যা হয় তা হচ্ছে লাল হয়ে গাল ফুলে যায়। সমস্ত মুখে লাল আভা ছড়িয়ে যায়। যে গালে চড় দেয়া হয়েছে সে দিকের চোখ খানিকটা ছোট দেখা যায়। চোখে পানি ছলছল করতে থাকে। ফুলফুলিয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যাপারটা ঘটছে না। তার চোখে ছলছলানি নেই। বাবার চড় খেয়ে মেয়েটা হয়তো অভ্যস্ত।
আমি ফুলফুলিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাসায় যাবে তো? এসো রিকশা করে। দিচ্ছি। ফুলফুলিয়া বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে এলো। তাকে নিয়ে রাস্তায় চলে এলাম। লোকজনদের কৌতূহলী চোখের আড়াল থেকে যত দ্রুত তাকে সরিয়ে দেয়া যায় ততই ভালো। রাস্তায় নেমে ফুলফুলিয়া বলল, ভাইজান আমি বাসায় যাব না। স্টুডিওর কোথাও লুকিয়ে থাকব যাতে বাবা আমাকে দেখতে না পান। বাবার বাজনা রেকর্ড হবে, আমি শুনব না–এটা কেমন কথা?
আমি বললাম, অবশ্যই তুমি শুনবে। তোমাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করছি।
বাবার শরীরটা অসুস্থ। মেজাজও খারাপ। কাজেই বাবা আজ চমৎকার বাজাবে। শরীর খারাপ থাকলে এবং মেজাজ খারাপ থাকলে বাবা ভালো বাজায়।
তাই না-কি?
জ্বি। আপনি দেখবেন— এখানে যারা আছে। বাবা তাদের সবার আক্কেল গুড়ুম করে দেবেন।
তোমার গালগুড়ুম করে শুরু, শেষ হবে। আক্কেলগুড়ুমে। ফুলফুলিয়া শোন— চা খাবে? আমাদের চিফ সাউন্ড রেকডিস্ট এখনো এসে পৌঁছায় নি। কাজেই হাতে সময় আছে। ফুলফুলিয়া ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি আমার মন ভালো করার চেষ্টা করছেন। তার দরকার নেই। বাবার চড় খেয়ে আমার অভ্যাস আছে।
চড়ের পর চা খেতে কিন্তু খারাপ লাগে না। রাস্তার পাশের দোকানগুলি খুব ভাল চা বানায়। খেয়ে দেখ।
চলুন যাই।
ফুলফুলিয়া শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়েছে। আচল এমন সাবধানে গালের উপর টেনেছে যে ফুলে উঠা গাল দেখা যাচ্ছে না। তাকে বউ বউ লাগছে। ফুলফুলিয়া বলল, বাবার শরীর হঠাৎ কেন খারাপ করেছে জানেন?
আমি বললাম, না।
ফুলফুলিয়া বলল, আপনার জানার কথা না। বাবা পুরো ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছে। আমি খুব কায়দা করে বের করেছি।
বল শুনি।
ফুলফুলিয়া ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা ঢাকা শহরের কোথায় যেন অসুস্থ একটা গাছ দেখেছেন। বাবা ঐ গাছকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন— গাছের অসুখটা যেন তার শরীরে চলে আসে। গাছ যেন বেঁচে যায়। এখন না-কি গাছের অসুখ তার কাছে চলে এসেছে। বাবার মাথা শুরু থেকেই খারাপ ছিল। যত দিন যাচ্ছে ততই খারাপ হচ্ছে।
সে-রকমই তো মনে হচ্ছে।
কিছু কিছু মানসিক রোগী আছে যাদের দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে তারা মানসিক রোগী। সহজ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। অসুখের খবরটা টের পাচ্ছে শুধু তাদের অতি কাছের মানুষজন।
তুমি নিশ্চিত তোমার বাবা একজন মানসিক রোগী?
হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। আমি আরো একটা ব্যাপার নিশ্চিত, সেটা কি বলব?
বলো।
অসুস্থ গাছের ব্যাপারটার সঙ্গে আপনার যোগ আছে। বাবার মাথায় জিনিসটা আপনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আপনার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে কি-না। আমি জানি না, তবে মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে যাবার ক্ষমতা যে আছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমার কথাগুলি কি ঠিক?
ফুলফুলিয়ার দিকে আমি হাসিমুখে তাকালাম। ফুলফুলিয়া কঠিন গলায় বলল, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট চলে এসেছে। এসো তাড়াতাড়ি যাই, তোমাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করি।
দশ মিনিটের ভেতর খালার চলে যাবার কথা, তিনি যাচ্ছেন না। এখানকার কর্মকাণ্ডে মজা পেয়ে গেছেন। খাঁ সাহেবের মেয়ের গালে চড় মারাটা তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। কী কারণে মেয়ে চড় খেয়েছে এটা না জেনে তিনি নড়বেন না। প্রয়োজনে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন। খালা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, মেয়েটা চলে গেছে না কি?
আমি বললাম, না। লুকিয়ে আছে। বাবার বাজনা না শুনে সে নড়বে না।
এত লোকের সামনে এত বড় অপমান। তারপরও মেয়ে বসে আছে। তার কি আত্মসম্মান নেই?
আত্মসম্মানের চেয়ে বেশি আছে বাবার প্রতি মমতা।
কী জন্যে মেরেছে গুছিয়ে বল তো।
জানি না তো কী জন্যে মেরেছে।
অবশ্যই জানিস, তুই তো তখন আশেপাশেই ছিলি। কথাবার্তা শুনেছিস।
আশপাশে থাকলেও কিছু শুনতে পাই নি। হঠাৎ চড়ের শব্দ শুনলাম। তুচ্ছ কোনো কারণ হবে।
তুচ্ছ কারণ তো অবশ্যই না। তুচ্ছ কারণে এত লোকের সামনে এত বড় মেয়েকে বাবা মারে না। অবশ্যই জটিল কিছু আছে। আমি একটা সন্দেহ অবশ্যি করছি। শুনতে চাস?