মেয়েটার কি তার স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না? স্বামীর প্রসঙ্গে ফুলফুলিয়া কখনো কিছু বলে না। প্রবাসী স্বামীর প্রসঙ্গ একবারও আসবে না— সেটা কেমন কথা? একবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফুলফুলিয়া স্বামীর কাছে কবে যাবে?
ফুলফুলিয়া বলল, কেন জানতে চাচ্ছেন?
আমি বললাম, পাহাড় জঙ্গলের দেশ আমার কখনো দেখা হয় নি। ঠিক করেছি আমিও তোমার সঙ্গে যাব। পাহাড় জঙ্গলে ঘুরব।
ফুলফুলিয়া বলল, ঠিক আছে।
সে মুখে বলল, ঠিক আছে, কিন্তু আমার মনে হলো ঠিক নেই। সব কিছুই এলোমেলো। ফুলফুলিয়ার বাবার গানের সিডি বের হচ্ছে। এ বিষয়েও তার কোনো উৎসাহ নেই, অথচ মেয়েটা এমন ছিল না। ফুলফুলিয়ার সঙ্গে একদিন বসতে হবে। প্রাইভেট সিটিং। অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে ফুলফুলিয়ার মনের চারদিকে যে শক্ত আবরণটি তৈরি হয়েছে সেটা ভেঙে দিতে হবে। পাঁচ প্রশ্নের খেলা, খেলা যেতে পারে। পাঁচটি প্রশ্ন করে উত্তর বের করতে হবে। উত্তর বের করতে না পারলে আমার যেকোনো পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ভালো না লাগলেও উত্তর দিতে হবে।
বলো তো ফুলি জিনিসটা কী? সে ঝিকমিক করে। তাকে দেখা যায় প্রবল শোকে ও প্ৰবল আনন্দে।
সে দেখতে কেমন?
তার কোনো আকৃতি নেই, কিন্তু সে ঝিকমিক করে।
তার বর্ণ কি?
তার কোনো বর্ণ নেই, কিন্তু সে ঝিকমিক করে।
সে কোথায় থাকে?
সে সব জায়গায় নানান ভঙ্গিমায় আছে। আকাশে আছে বাতাসে আছে, সমুদ্রে আছে, মরুভূমিতে আছে। আর মাত্র দুটি প্রশ্নের সুযোগ আছে। দুটি প্রশ্ন করে জেনে নাও জিনিসটা কী।
পারছি না।
জিনিসটা— চোখের জল। এখন আমার পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দাও। পাঁচটা প্রশ্নের একই উত্তর হলে চলবে না। পাঁচ ধরনের উত্তর হতে হবে।
প্ৰথম প্রশ্ন— মন বিষণ্ণ কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন— মন বিষণ্ণ কেন?
তৃতীয় প্রশ্ন—মন বিষণ্ণ কেন?
চতুর্থ প্রশ্ন— মন বিষণ্ণ কেন?
পঞ্চম প্রশ্ন— মন বিষণ্ণ কেন?
বিখ্যাত ওস্তাদ
মাজেদা খালা বলল, ঐ বুড়োই কি তোর বিখ্যাত ওস্তাদ?
আমি বললাম, হুঁ। ব্যাঞ্জোরাজ ওস্তাদ শমসের উদ্দিন খাঁ।
খাঁ সাহেব রেকর্ডিংরুমে কার্পেটের উপর মাথা নিচু করে বসে আছেন। তাঁর ডানপাশে ফুলফুলিয়া। খাঁ সাহেব কিছুক্ষণ পরপর কাশছেন। জটিল ধরনের কাশি। কাশির সময় ফুলফুলিয়া বাবার পিঠে হাত রাখছে। রেকর্ডিংরুমের বিশাল জানালাটা কাচের। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। আমি বললাম, খালা ভালো করে দেখ। ইনিই তোমার বিছানায় বসে ছিলেন না?
খালা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, মানুষটাকে তো দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ।
বকর বকর করে কাশছে।
হুঁ। কাল রাত থেকেই কাশছে। জ্বরও আছে। থার্মেমিটার ধরলে একশ দুই টুই পাওয়া যাবে বলে ধারণা। আমি বলেছিলাম আজকের রেকর্ডিং শিডিউল বাতিল করতে, বুড়ো রাজি হয় নি।
বকর বকর কাশি নিয়ে গান-বাজনা করবে। কীভাবে?
গান তো করবে না। যন্ত্র বাজাবে।
কোন যন্ত্ৰ— হাতে যেটা নিয়ে বসে আছে সেটা?
হুঁ।
খেলনা খেলনা মনে হচ্ছে।
বাজনা শুরু হলে বুঝবে খেলনা না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা—
এত ক্ষুদ্র যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়।
দেখিয়া জগতের লাগে পরম বিস্ময়।
খালা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, হিমু তোর সঙ্গে একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে নেইআমি কিন্তু বক্তৃতা দেব না। হাতে ফুলটুলও তুলে দিতে পারব না। আচ্ছা দিতে হবে না।
তুই আবার কায়দা করে টাকা পয়সার ব্যাপারে আমাকে ফাঁসাবি না। আমি একটা পয়সাও দেব না।
আচ্ছা দিও না। তুই তো টাকা পয়সার জোগাড় করেছিস?
এখনো করি নি। তবে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এসো তোমার সঙ্গে ওস্তাদজীর পরিচয় করিয়ে দেই।
কোনো দরকার নেই। আমি কিন্তু দশ পনেরো মিনিট থেকেই চলে যাব। বাজনা ফাজনা আমার ভালো লাগে না। এখানে এসেছি। জানতে পারলেও তোর খালু রাগ করবে।
ঠিক আছে। চলে যেও।
ওস্তাদজীর পাশে যে মেয়েটা বসে আছে সে কে?
উনার মেয়ে। দেখতে সুন্দর না?
খুবই সুন্দর। মেয়েটাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?
জানি না। জিজ্ঞেস করে আসব?
তুই কী যে কথা বলিস। কী জিজ্ঞেস করবি?
জিজ্ঞেস করব যে, আমার খালা জানতে চাচ্ছেন–তুমি এত চিন্তিত কেন? তুই কি মেয়েটাকে চিনিস?
সামান্য চিনি। কোনো মেয়েকেই পুরোপুরি চেনা সম্ভব না। সেই চেষ্টাও করা উচিত না। একমাত্র রবীন্দ্রনাথই মেয়েদের পুরোপুরি চিনতেন। তাও দেশী মেয়ে না। বিদেশী মেয়ে।
তাই না-কি?
উনার গান শুন নি।
চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।
হিমু আমার সঙ্গে ফাজলামি করবি না। ওস্তাদজীর মেয়েটার কি বিয়ে হয়েছে?
হুঁ।
হাসবেন্ড কী করে?
ডাক বিভাগে কাজ করে।
মেয়েটার চুল সুন্দর না। কোঁকড়ানো চুলে মেয়েদের ভালো লাগে না। পার্লারে গিয়ে কোঁকড়ানো চুল ঠিক করা যায়।
মেয়েটার সঙ্গে কি কথা বলতে চাও?
কী উল্টাপাল্টা কথা বলছিস? আমি কী কথা বলব?
পার্লারে গিয়ে চুল ঠিক করার কথা বলবে।
হিমু তুই খুবই বিরক্ত করছিস। আমার সামনে থেকে যা। বাজনা ফাজনা কী করার শুরু কর, ঘড়ি ধরে দশ মিনিট থাকব। তারপর চলে যাব। আমাকে শিকল দিয়ে বেঁধেও রাখতে পারবে না।
আমি ওস্তাদজীর কাছে গেলাম।
ওস্তাদজীর শরীর যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, দেখা গেল শরীর তার চেয়েও খারাপ। চোখের মণি ছোট হয়ে গেছে এবং মণি চকচক করছে। হাত কাঁপছে। তার হাতে এক লিটারের পানির বোতল। একটু পর পর গ্লাসে পানি ঢেলে পানি খাচ্ছেন। ফুলফুলিয়া চিন্তিত গলায় বলল, বাবার শরীর বেশি খারাপ। উনার বিছানায় শুয়ে থাকা দরকার। শমসের উদ্দিন খাঁ সাহেব জ্বলজ্বলে চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, যন্ত্রণা করিস না। আমার যন্ত্রণা ভালো লাগে না।