স্নামালিকুম, খালা আমি হিমু।
বুঝতে পারছি। কী চাস?
টাকা চাই খালা। আজ ছাব্বিশ হাজার দিলেই হবে। স্টুডিও এবং হ্যান্ডস-এর খরচ।
কীসের স্টুডিও, কীসের হ্যান্ডস?
আমাদের সিডি বের হবে। শুক্রবারে রেকর্ডিং। প্ৰধান অতিথিকে দাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে। তিনি এপয়েন্টমেন্ট ডায়রিতে দিন এবং সময় লিখে রেখেছেন। ঐ দিন তাকে গাড়ি করে আনতে হবে এবং বাসায় দিয়ে আসতে হবে। খালা, শুক্রবারে তোমার গাড়িটাও লাগবে।
হিমু, তুই পুরো ব্যাপারটা ভুলে যা। আমি এর মধ্যে নেই।
সে-কী?
সে-কী ফে-কী বলে। লাভ নেই। তোর খালু আমার উপর খুব রাগ করেছে।
লোকে গাছে তুলে মই কেড়ে নেয়। তুমি তো আমাকে চাঁদে পাঠিয়ে রকেট কেড়ে নিয়েছ।
কেড়ে নিয়েছি। ভালো করেছি— তুই থাক চাঁদে বসে। আমার ছেলের কোনো খোঁজ নেই। আর আমি খুলবা সিডি কোম্পানি!
এইগুলো তো তোমার কথা না। খালু সাহেবের কথা।
যার কথাই হোক সত্যি কথা। হিমু আমার মাথা ধরেছে— আমি তোর সঙ্গে গজগজ করতে পারব না।
আমি খাঁ সাহেবকে কী বলব?
তুই তাকে কী বলবি সেটা তুই জানিস। উনি বিখ্যাত মানুষ, অন্য সিডি কোম্পানি তাঁকে লুফে নেবে। এটা নিয়ে তোর সঙ্গে আমি আর কথা বলব না।
আচ্ছা বেশ কথা শেষ। শুক্রবারটা ফ্রি রেখা।
কেন?
বললাম না। শুক্রবারে সিডির রেকর্ডিং। তুমি অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি।
আরো গাধা আমি এক কথা কতবার বলব! আমি সিডির মধ্যে নেই।
সিডিতে তো থাকতে বলছি না। বিশেষ অতিথিতে থাকতে বলছি। তোমার কাজ হবে সঙ্গীতের উপর একটা বক্তৃতা দেবে, তারপর খাঁ সাহেবের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেবে।
জীবনে আমি বক্তৃতা দেই নি।
বক্তৃতা না দিতে পারলে নাই। ফুলের তোড়াটা দিতে পারবে। না কি সেটাও পারবে না?
আসুক শুক্রবার। তারপর দেখা যাবে।
খালা খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। আমি টেলিফোনওয়ালার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাই কত হয়েছে?
টেলিফোনওয়ালা ঐ দিনের মতো বলল, স্যার আপনার কাছ থেকে পয়সা নেব না।
আমি বললাম, কেন?
আপনি একবার আমাকে খুব বড় একটা উপকার করেছিলেন। মানুষ উপকারের কথা মনে রাখে না। আমি দরিদ্র মানুষ কিন্তু আমি উপকারের কথা মনে রাখি।
কী উপকার করেছিলাম?
সেটা আপনাকে বলব না। আপনার যেহেতু মনে নাই আমি মনে করায়ে দিব না।
শুক্রবার কি আপনার কাজকর্ম আছে?
দোকানে বসে থাকা— এছাড়া আর কাজকর্ম কী!
শুক্রবারে তাপনার দাওয়াত। বাজনা শোনার দাওয়াত। ব্যাঞ্জো বাজনা!
গান বাজনা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু আপনি দাওয়াত দিয়েছেন। আমি অবশ্যই যাব। শুক্রবার আমার দোকান থাকবে বন্ধ।
গ. রাধাচুড়া গাছের সঙ্গে শেষ দেখা।
যা মনে মনে ভেবেছিলাম। তাই। রাধাচুড়া গাছের নিচে গম্ভীর মুখে খাঁ সাহেব বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখে সামান্য লজ্জা পেলেন বলে মনে হলো। খুকধুক করে। শুকনা কাশি কাশতে লাগলেন। আমি বললাম, কখন এসেছেন?
খাঁ সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, এই তো কিছুক্ষণ আগে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম গাছটা দেখে যাই।
কী দেখলেন?
অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আগে তিনটা ডালে পাতা ছিল। এখন মাত্ৰ দুটা ডালে আছে। তার মধ্যে একটার পাতা হলুদ হওয়া ধরেছে। আমি কোনো আশা দেখছি না।
আপনার মনে হয় মন খারাপ।
মন খারাপ টারাপ না, এতগুলা মানুষ গাছটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। চেষ্টা কাজে লাগছে না। এইটা দেখে খারাপ লাগছে। রুগ্ন গাছের গোড়ায় তুতে দিলে উপকার হয়। শুনেছি। আজ কিছু তুতে দিয়েছি। আর কী করা যায় মাথায় আসছে না।
আপনি কি রোজই এখানে আসেন?
রোজ না হলেও প্রায়ই আসি।… কথাটা ঠিক বললাম না, রোজই আসি। কী জন্যে জানি গাছটার উপর মায়া পড়ে গেছে।
আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে গাছের উপর মায়া পড়ে যাওয়াতে আপনি লজ্জা পাচ্ছেন। লজ্জা পাচ্ছেন কেন?
মানুষের উপর কোনোদিন মায়া পড়ল না। গাছের উপর মায়া। এই জন্যেই লজ্জা লাগে। আচ্ছা হিমু, কয়েকদিন থেকে একটা ব্যাপার। আমার মাথার মধ্যে ঘুরছে। ঐটা করলে কেমন হয়?
ঐটা মানে কী?
মোঘল সম্রাট বাবরের ব্যাপারটা।
খুলে না বললে বুঝতে পারছি না।
ঐ যে সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ূন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জীবন সংশয়। চিকিৎসকরা জবাব দিয়ে দিয়েছেন। তখন এক গভীর রাতে সমাট বাবর তার ছেলের বিছানার চারদিকে ঘুরতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, হে আল্লাহপাক, আমার জীবনের বিনিময়ে আমার পুত্রের জীবন রক্ষা কর। সকালেই ছেলে সুস্থ হতে শুরু করল আর সম্রাট বাবর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কয়েকদিনের মধ্যেই হুমায়ূন সুস্থ হয়ে উঠলেন, সম্রাট বাবর মারা গেলেন।
আপনার মাথায় কি এরকম কিছু আছে নাকি? নিজের জীবন দিয়ে গাছের জীবন রক্ষা করা।
আরে না। কথার কথা বলেছি। আমার তো মাথা খারাপ হয় নি।
চলুন বাসায় যাই।
তুমি যাও। মওলানা সাহেব আছর ওয়াক্ত আসবেন। দরুদে শেফার খতম তিনি শেষ করেছেন। আজ দোয়া হবে। দোয়ায় সামিল হব।
ঠিক আছে আপনি থাকুন। আমি রাধাচুড়া গাছের দিকে তাকিয়ে বললাম, হে বৃক্ষ বিদায়।
ঘ. জহিরের সঙ্গে কথা বলা।
কথা বলা সম্ভব হলো না। সে কোথায় আছে কে জানে। হাঁটো পথিক হাঁটো।
হন্টন শুধু হন্টন
নিজ দুঃখ
পথ মাঝে
করিও বণ্টন।
ঙ. ফুলফুলিয়া।
মেয়েটার কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যা ধরতে পারছি না। সে যে মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদে তা তার চোখ দেখে বোঝা যায়। আমার প্রতি তার ব্যবহার খুব আন্তরিক ছিল, সেই আন্তরিকতায় ভাটা পড়েছে। এখন মনে হয় সে বিরক্তও হয়। ঐ দিন জিজ্ঞেস করলাম, জহিরের চিঠিটা কি এসেছে? সে তার জবাবে কঠিন গলায় বলেছে, আপনার কথা আমার মনে আছে। চিঠি তুলে রেখেছি। যেদিন পড়তে বলবেন—পড়ব।