কাস্টমারকে নিজেই ছুটে গিয়ে কফি দিচ্ছে। আদুরে গলায় বলছে— কফি কেমন হয়েছে খেয়ে বলুন তো? ভালো হলে কিন্তু আরেক মগ খেতে হবে।
মাজেদা খালার দুশ্চিন্তা দূর করার জন্যে না, ফুলফুলিয়ার ব্যাপারে কৌতূহলী হয়েই খালার ধানমণ্ডির বাসায় গেলাম। খালু সাহেব আমাকে দেখে প্রথম কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে থাকলেন যেন চিনতে পারছেন না। তারপর শুকনো গলায় বললেন, কী ব্যাপার?
আমি বললাম, কোনো ব্যাপার না, আপনাদের দেখতে এসেছি।
খালু সাহেব ও বলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনে মুখ ঢেকে ফেললেন। খালু সাহেব আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। মাজেদা খালা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, তোর খালুর সামনে ঐ প্রসঙ্গ তুলবি না।
আমি বললাম, Ok.
খালা বললেন, জহিরের কাছ থেকে কায়দা করে ব্যাপারটা আগে জেনে নে। আমি যে ঘটনা জানি এটা যেন জহির টের না পায়।
আমি আবারো বললাম, Ok.
খালা বিরক্ত গলায় বললেন, Ok ok করিস না তো। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই ব্যাপারটা হাসি তামাশা হিসেবে নিচ্ছিস। মোটেই হাসি তামাশা না।
অবশ্যই হাসি তামাশা না। জহির কোথায়? এক্ষুণি সাঁড়াশি দিয়ে জহিরের পেট থেকে সব কথা বের করে ফেলব। শুরু হবে সাঁড়াশি আক্রমণ।
খালা বললেন, আজ রাতে তুই আমার বাড়িতে থাকিবি।
আমি বললাম, কথা বের করে তোমাকে দিয়ে যাই। থাকার দরকার কী?
থাকলে সমস্যা কী?
বড়লোকের বাড়িতে আমার ঘুম হয় না খালা।
কমুনিস্টদের মতো কথা বলবি না। তুই কমুনিষ্ট না। তুই হিমু। তোকে যেখানে ঘুমুতে বলা হবে তুই সেখানেই ঘুমাবি। রাতে কী খাবি?
যা খাওয়াবে তাই খাব ৷
নতুন একটা বাবুর্চি রেখেছি, খুব ভালো মোগলাই রাধে। তোর কপাল খারাপ বাবুর্চি ছুটিতে আছে। অসুবিধা নেই পোলাও খা। পোলাও আর ঝাল মুরগির ঝোল, হবে না।? ফ্রিজে ইলিশ মাছ আছে, ইলিশ মাছ ভেজে দিতে বলব।
আচ্ছা।
গ্রামের বাড়ি থেকে সরবাটা ঘি এনেছি। খেয়ে দেখ ঘি কাকে বলে।
ঠিক আছে, খাব সরবাটা ঘি।
মাজেদা খালা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ঘর ভরতি খাবার। কেউ খায় না।
খায় না কেন?
তোর খালুর ডিসপেপসিয়া হয়েছে— কিছুই হজম হয় না। পানি খেলেও নাকি টক ঢেকুর উঠে। আর জহিরও খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। গত এক মাস ধরে শুধু ডাল ভাত খাচ্ছে। ঐ দিন বলল শুকনা মরিচ। আর রসুন পিষে ভর্তা বানিয়ে দিলে ভর্তা দিয়ে খাবে। আর কিছু খাবে না।
বলো কী?
খালা হতাশ গলায় বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ফুলফুলিয়া মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় হবার পর জহির এই পাখনা করছে। ঐ মেয়ে যেহেতু শুকনা মরিচের ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছে, এর বেশি কিছু খাবার মুরাদ নাই কাজেই জহিরকেও তাই খেতে হবে।
তাহলে তো ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে। তুমি চিন্তা করো না। আমি টেককেয়ার করছি। হয় জহিরের স্ত্রু টাইট দিয়ে দেব আর নয়তো নাট খুলে স্ক্রু বের করে নিয়ে আসব।
তুই একটা কাজ করবি?
অবশ্যই করব। কাজ করে ভাত খাব। ফুড ফর ওয়ার্ক।
একটা ডিজিটাল রেকর্ডার পকেটে করে নিয়ে যা। জহিরের সঙ্গে কথাবার্তা যা হবে। রেকর্ড করে ফেলবি।
মা হয়ে ছেলের গোপন কথা রেকর্ড করা ঠিক হবে?
অবশ্যই ঠিক হবে। মা ছেলের ভবিষ্যৎ দেখবে না? সে মাতারির সঙ্গে প্ৰেম করবে। আমি আটকাব না?
তাহলে দাও তোমার ডিজিটাল রেকর্ডার।
আসল কথা যখন শুরু হবে তখন কায়দা করে রেড বাটন পুশ করবি। পনেরো মিনিট রেকর্ড হবে।
আমি গলা নামিয়ে বললাম, নিজেকে কেমন যেন স্পাই স্পাই লাগছে। খালু সাহেবের তো একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। পিস্তলটিও দাও। পকেটে করে নিয়ে যাই। স্পাই যখন হয়েছি পুরোপুরি হই। একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দাও। স্পাইদের সঙ্গে ম্যাগনিফাইং গ্রাস থাকে।
ফাজলামি করিস না হিমু। তোকে ফাজলামি করার জন্যে ডাকি নি। তোর সব ভালো ফাজলামিটা ভালো না। তুই তোর খালুর সঙ্গে গল্প কর, আমি ডিজিটাল রেকর্ডারটা রেডি করে দেই। ব্যাটারি। আনতে হবে। ব্যাটারি নেই।
আমি খালু সাহেবের (রহমতউল্লাহ তালুকদার) সামনে বসে আছি। কতক্ষণ বসে থাকতে হবে বুঝতে পারছি না। ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারের ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে চোখ তুলছেন না। তিনি হাটুর উপর পা তুলে দিয়েছেন। পায়ের পাতা নাড়ছেন। পাশে বসে থাকা মানুষকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার চেষ্টা। চেষ্টা সফল হচ্ছে না। আমি বরং তার কর্মকাণ্ডে মজা পাচ্ছি। আমি তাকিয়ে আছি টিভির দিকে। টিভিতে সিএনএন চলছে। শব্দহীন টিভি। খালু সাহেব ইদানীং শব্দহীন টিভি দেখেন।
হিমু।
জ্বি।
খালু সাহেব ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বন্ধ করে আমার দিকে তাকালেন। তার ভুরু কুঁচকে আছে। নাকিও খানিকটা কুঞ্চিত। গরম মাড়ে ছাল পুড়ে ঘা হয়ে যাওয়া নেড়ি কুত্তার দিকে মানুষ এইভাবেই তাকায়।
কী করছি আজকাল?
কিছু করছি না।
কিছু করছি না বাক্যটা যেভাবে বললে তাতে মনে হচ্ছে কিছু না করাটা খুব মহৎ কিছু।
খারাপ কিছু করার চেয়ে কিছু না করা তো অবশ্যই মহৎ। চুরি-ডাকাতি তো …
আমার সঙ্গে বাজে তর্ক করবে না।
জ্বি আচ্ছা।
ব্যক্তিগতভাবে তোমার প্রতি আমার কোনোই বিদ্বেষ নেই। কিন্তু আমি অকৰ্মণ্য অলস মানুষ সারাজীবন অপছন্দ করেছি, আমৃত্যু করব বলে ধারণা। তুমি যদি কিছু মনে না কর, অন্য কোথাও গিয়ে বস। তুমি আমার পাশে বসে আছ বলেই পড়ায় মন দিতে পারছি না। কিছু মনে করছ না তো?