পুঁই।
গ্রামের নাম মনে নাই?
নান্দিবাড়ি হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে রেললাইন গিয়েছে। একবার রেললাইনে একটা মহিষ কাটা পড়েছিল। বাপজানের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম। এইটা পরিষ্কার মনে আছে।
গ্রামের বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করে না?
আগে করত না। ইদানীং করে। মনে হয় আমার মৃত্যু ঘনায়ে এসেছে। মৃত্যুর সময় জন্মস্থানের মাটি ডাকাডাকি শুরু করে।… রাত মেলা হয়েছে এখন ঘুমাও। আগামীকাল ফুলফুলিয়ার মাকে কীভাবে বিবাহ করেছিলাম। সেই গল্প বলব। সেটা একটা ইতিহাস।
আপনি যা বলছেন সবই তো আমার কাছে মনে হচ্ছে ইতিহাস।
তাও ঠিক। আমার ইতিহাসের শেষ নাই। খুনের দায়ে জজকোটে আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ে ছাড়া পাই। ছবছর হাজত খেটেছি।
কাকে খুন করেছিলেন?
কাউরে খুন করি নাই। খুন করতে সাহস লাগে। আমার সাহস নাই। সাহস থাকলে দুই তিনটা খুন অবশ্যই করতাম।
এখনো খুন করার ইচ্ছা আছে?
না। বুড়ো হয়ে গেছি। রক্ত পানশা হয়ে গেছে। তাছাড়া মৃত্যু ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। এত দিন দরজার বাইরে ছিল, এখন ঘরে ঢুকে পড়েছে। এখন চারপায়ে মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করে। কোনো একদিন লাফ দিয়ে বুকের উপর উঠে পড়বে।
লাফ দিয়ে বুকের উপর উঠবে কীভাবে? মৃত্যু কি পশু?
অবশ্যই পশু। মৃত্যু দুই পায়ে হাঁটে না। চার পায়ে হাঁটে। পশুর শরীরে যেমন গন্ধ আছে মৃত্যুর শরীরেও গন্ধ আছে। যে মারা যায় সে মৃত্যুর ঘ্ৰাণ পায়। আমি পাই।
ঘ্রাণটা কেমন?
বুঝাতে পারব না। কষটা ঘাণ। ঘ্ৰাণে শরীর ভার হয়ে যায়। নিশার মতো লাগে।
ভাং-এর শরবত কখনো খেয়েছ?
জ্বি না।
ভাং-এর শরবতের ঘ্রাণের সাথে মিল আছে। যথাসময়ে মৃত্যুর গন্ধ তুমিও পাবে। আমার বলার প্রয়োজন নাই। থাক এইসব কথা। তোমার নিজের কথা কিছু শুনি। আমি একাই ভ্যাজর ভ্যাজর করি। অন্যের কথা শুনি না। বৃদ্ধ বয়সের ব্যাধি।
আমার নিজের কোনো কথা নাই।
অবশ্যই আছে। না থেকে পারে না। ফুলফুলিয়ার কাছে শুনেছি। তুমি নাকি সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় হাট। সত্য নাকি?
জ্বি।
হাঁট কী জন্যে?
অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য দেখি। দেখতে ভালো লাগে এই জন্যে হাঁটি।
অদ্ভুত দৃশ্যটা কী?
আছে অনেক কিছু।
একদিন নিয়ে যাবে তো আমাকে, দেখব।
জ্বি আচ্ছা।
কবে নিয়ে যাবে?
যেদিন আপনি বলবেন সেদিন। তোমার সঙ্গে যে-কোনোদিন বের হলেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখব?
অবশ্যই।
কাল সকালে যদি বের হই দেখব?
হ্যাঁ দেখবেন।
পরদিন আমি খাঁ সাহেবকে অদ্ভুত দৃশ্য দেখাতে নিয়ে গেছি। অতীশ দীপংকর রোডের পাশের গলিতে খোলামেলা জায়গায় বিশাল এক রাধাচুড়া গাছ। খাঁ সাহেব বললেন, এই তোমার অদ্ভুত দৃশ্য?
আমি বললাম, জ্বি।
এই দৃশ্য দেখার জন্যে দশ কিলোমিটার হেঁটেছ?
জ্বি।
রাধাচুড়া গাছ বাংলাদেশে এই একটাই?
না, প্রচুর আছে। তবে এটা বিশেষ এক রাধাচুড়া।
বিশেষ কেন?
গাছটার ভয়ঙ্কর কোনো ব্যাধি হয়েছে। মানুষের যেমন ক্যান্সার হয় গাছদেরও নিশ্চয়ই হয়। এরকম কিছু হয়েছে। ব্যথায় যন্ত্রণায় সে ছটফট করছে। গাছটার কাছে এসে দাঁড়ালে তার মৃত্যু-যন্ত্রণা টের পাওয়া যায়।
তুমি গাছটার মৃত্যু-যন্ত্রণা টের পাচ্ছ?
জ্বি পাচ্ছি। শুধু আমি একা না, পাখিরাও টের পাচ্ছে। আমরা অনেকক্ষণ হলো গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এই সময়ের মধ্যে কোনো পাখিকে কি গাছের ডালে বসতে দেখেছেন?
ঢাকা শহরে পাখি কোথায় যে গাছের ডালে বসবে?
পাখি না থাকুক কাক তো আছে। গাছের ডালে কিন্তু কোনো কাকও বসে নেই। গাছটার গায়ে হাত দিয়ে দেখুন। তার যে জ্বর এসেছে হাত দিলেই টের পাওয়া যায়।
খাঁ সাহেব গাছে হাত রাখলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, জ্বর কোথায়?
আমি বললাম, গাছের জ্বর তো মানুষের জ্বরের মতো না যে গায়ের তাপ বাড়বে। তাদের জ্বর অন্য রকম।
তোমার যে মাথা খারাপ এটা কি তুমি জানো?
জ্বি না। জানি না।
তোমার মাথা খারাপ। সামান্য খারাপ না, বেশ ভালো খারাপ।
হতে পারে।
তুমি কি হেঁটে হেঁটে ক্যান্সার হওয়া গাছ খুঁজে বের করা?
তা না। আমি আমার মতো হাঁটি। হঠাৎ হঠাৎ এরকম গাছ চোখে পড়ে।
তখন কী করা? গাছের জুর কমাবার জন্যে মাথায় পানি ঢাল?
বেশির ভাগ সময় কিছুই করি না। গাছের মৃত্যু দেখি। মৃত্যু-যন্ত্রণা দেখি। দুএকটা ক্ষেত্রে গাছের মৃত্যু-যন্ত্রণা কমাবার চেষ্টা করি।
কীভাবে?
যেমন ধরেন এই গাছটার কী রোগ হয়েছে এটা ধরার জন্যে আমি নানান লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের এক রিসার্চ অফিসার বলেছেন, ফাংগাসের সংক্রমণ হয়েছে। তাঁর কথামতো গাছে ফাংগাসের ওষুধ দিয়েছি। বলধা গার্ডেনের একজন মালী বলল, গাছের নিচের মাটিতে উইপোকা বাসা বানিয়েছে। এরা গাছের শিকড় খেয়ে ফেলছে। মালীর কথামতো গর্ত খুঁড়ে উইপোকার ওষুধ দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির একজন শিক্ষক বলেছেন–গাছটার বিশেষ ধরনের রোগ হয়েছে। এই রোগের বৈজ্ঞানিক নাম হলো–এনথ্রাকনোস। তার কথামতো এর চিকিৎসা চলছে।
কোনো পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ এনে দিচ্ছে না কেন?
তাবিজের কথা মাথায় আসে নি। তবে স্থানীয় মসজিদের মোয়াজেন্ম সাহেবের সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়েছে। উনি প্রতিদিন বাদ আছর গাছটার জন্যে দোয়া করেন।
ঠাট্টা করছ?
না, ঠাট্টা করছি না। মানুষের জন্যে যদি দেয়া করা যায় তাহলে গাছের জন্যেও দোয়া করা যায়। গাছেরও প্ৰাণ আছে। জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কার।