শমসের উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, পোলাও রাধার ব্যবস্থা কর। পোলাও, মুরগির কোরমা, গরুর ঝাল মাংস। মিহি রাতে খাবে।
ফুলফুলিয়া বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। শমসের উদ্দিন বিরক্ত গলায় মেয়েকে বললেন, হা করে তাকিয়ে থাকিস না তো— রান্নাবান্নার জোগাড় কর। টক দৈ এর ব্যবস্থা রাখিস। গুরু ভোজনের পরে টক দৈ। হজমের সহায়ক।
ফুলফুলিয়া ঘর থেকে বের হতেই শমসের উদ্দিন আমার দিকে ঝুকে এসে গলা নামিয়ে বললেন, মিহি এই যে আমার ব্যাঞ্জোর সিডি বের হচ্ছে। কেন বের হচ্ছে জানো?
আমি বললাম, না।
শমসের উদ্দিন বললেন, গত মাসে সিলেটে গিয়েছিলাম। শাহজালাল সাহেবের দরগায় গিয়ে কান্নাকাটি করেছি। বলেছি আমার বড় শখ আমার বাজনা দেশের মানুষকে শোনাই। আল্লাহপাক, শাহজালাল সাবের উছিলায় তুমি বান্দার মনের বাসনা পূর্ণ করা। আল্লাহপাক যে তখনই মঞ্জুর করে দিয়েছেন বুঝতে পারি নাই। এখন বুঝলাম। ঠিক করেছি। গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়ব। মিহি, তুমি ফুলফুলিয়াকে বলো গোসলের জন্যে গরম পানি করতে। যাও রান্নাঘরে চলে যাও। কোনো অসুবিধা নাই। আমার এই বাড়ি এখন থেকে তুমি নিজের বাড়ি মনে করবে।
আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। ফুলফুলিয়া কুলায় চাল বাছছিল। আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে মোটেই অবাক হলো না। শুধু বলল, সব মানুষকেই কি আপনি মুহুর্তের মধ্যে হাতের মুঠোয় নিতে পারেন? আমাকে পারবেন?
আমি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, গরম পানি করা তো। খাঁ সাহেব গোসল করবেন।
ফুলফুলিয়া বলল, খাঁ সাহেব কে?
তোমার বাবা।
ও আচ্ছা।
আমি হাসিমুখে বললাম, আরেকটা জরুরি কথা। জহির তোমাকে একটা চিঠি লিখেছে। পোষ্ট করেছে। এক দুদিনের মধ্যে চিঠিটা তোমার হাতে চলে আসবে। চিঠি তুলে রাখবে। এখন পড়বে না। যখন আমি তোমাকে পড়তে বলব। তখন পড়বে। ঠিক আছে?
ফুলফুলিয়া বেশ কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর চোখ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, ঠিক আছে।
ব্যাঞ্জোর আসর বসল। রাত বারোটায়। বাড়িওয়ালা না ঘুমানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। দরজা-জানালা বন্ধ করতে হলো যেন শব্দ বাইরে না যায়।
বাজনা শুরু হলো। আমি চমকে উঠলাম— এ-কী? মনে হচ্ছে বাজনার তালে তালে। বাতাস কাঁপতে শুরু করেছে। শুধু বাতাস না, এখন মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি দুলছে। বুকের ভেতরের হৃৎপিণ্ড দুলছে। এ যেন অলৌকিক অপার্থিব সঙ্গীতের ঝড়। আমি ভদ্রলোকের আঙুলের দিকে তাকালাম। আঙুল সত্যি সত্যি দেখা যাচ্ছে না। যে-কোনো মহৎ সঙ্গীত বুকের ভেতরে তীব্ৰ বেদনা তৈরি করে। আমার সে-রকম হচ্ছে। বুক টনটন করছে।
এক সময় বাজনা থামল। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখি আপনার পা-টা একটু এগিয়ে দিন তো। আপনার পায়ের ধুলা কপালে মাখব।
আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই ভদ্রলোক দুহাতে আমার হাত ঝাপ্টে ধরে তাঁর বুকে লাগালেন এবং ব্যাকুল হয়ে শিশুদের মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন।
ওপাশ থেকে যে টেলিফোন ধরেছে
ওপাশ থেকে যে টেলিফোন ধরেছে তার গলা আমি চিনতে পারছি না। প্রচুর চিৎকার চোঁচামেচির পর গলা ভেঙে গেলে যে আওয়াজ বের হয়। সে রকম আওয়াজ হচ্ছে। গলাটা পুরুষের না মহিলার তাও বুঝতে পারছি না। আন্দাজের ওপর বললাম, মাজেদা খালা?
হুঁ।
ফজলামি করবি না।
ঘটনা কী?
জানি না ঘটনা কী। তুই কোথায়?
এই মুহুর্তে আমি একটা টেলিফোনের দোকানে।
মেস ছেড়ে দিয়েছিস?
হ্যাঁ। খালু সাহেব জহিরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। চব্বিশ ঘণ্টায় কিছু করতে পারি নি। কাজেই ভাবলাম পালিয়ে যাওয়াই ভালো। যা পলায়তি স জীবতি।
আমার সঙ্গে সংস্কৃত কপচাবি না। তোর নামে পুলিশের ওয়ারেন্ট বের হয়েছে।
বলো কী?
তোর খালু খুবই রেগেছে। তার বন্ধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব। সে তাকে বলে এই কাজটা করিয়েছে।
চার্জ কী? আমি অপরাধটা কী করেছি?
জানি না চার্জ কী! তুই পালিয়ে থাক, সেটাই ভালো। এদিকে তোর খালুকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা আমি চালিয়ে যাচ্ছি।
আমাকে জেলে না ঢুকানো পর্যন্ত খালু ঠাণ্ডা হবেন বলে মনে হচ্ছে না।
আমার ওপর তার অনেক দিনের রাগ। প্রাচীন কাল হলে দ্বন্দ যুদ্ধে আহবান করতেন। একালে তো আর এটা সম্ভব না। এখন আসল কথা বলো–জহিরের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়েছে?
হয়েছে। তেতুলিয়া রওনা হবার আগে টেলিফোন করেছিল।
তেতুলিয়া রওনা হয়ে গেছে?
হুঁ।
তেতুলিয়া থানার ওসি সাহেবের কাছে জহিরের ছবি দিয়ে লোক পাঠানো হয়েছে। জহিরকে দেখলেই সে এরেস্ট করবে। আচ্ছা হিমু শোন, তোর খালু সাহেব বলছিল তুই নাকি জহিরকে বুদ্ধি দিয়েছিস তেতুলিয়া থেকে সে যেন নেংটো হয়ে হাঁটা ধরে। এমন ভয়ঙ্কর পরামর্শ তুই কীভাবে দিলি? তোর খালু যে তোকে জেলে ঢুকাতে চায় শুধু শুধু তো ঢুকাতে চায় না। আমার নিজেরও ধারণা তোকে অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও সোসাইটি থেকে দূরে রাখা উচিত। তুই উপদ্রবের মতো।
খালা তোমার ভাঙা গলা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এখন পরিষ্কার আওয়াজ আসছে।
হিমু তুই কথা ঘুরাবার চেষ্টা করছিস। আমার গলা আগে যেমন ছিল এখনো সেরকমই আছে।
তাহলে মনে হয় ফ্যাসফ্যাসে গলা শুনে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যাই হোক আগে কাজের কথা সেরে নেই।
তোর আবার কাজের কথা কী?
কাজের কথা তো বেকারদেরই জিনিস। যারা বেকার না তাদের হলো কাজ। কাজের কথা বলে তাদের আলাদা কিছু নেই।