শমসের উদ্দিন আমার দিকে ফিরলেন। আগের মতোই খ্যাক খ্যাক করে বললেন, মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসছেন? এই এক যন্ত্রণায় পড়েছি। দুই দিন পরে পরে যন্ত্রণা। বাংলাদেশে মনে হয় বিবাহযোগ্য মেয়ে এই একটা। প্ৰস্তাব দেয়ার আগে শুনে রাখেন— আমার মেয়ের দুই বছর আগে বিবাহ হয়েছে। জামাই পোষ্টমাস্টার।
এটা কোনো ব্যাপার না?
কী বললেন, এটা কোনো ব্যাপার না?
জ্বি না। মোঘল ইতিহাস পড়লে দেখবেন মোঘল সম্রাটদের কোনো একটা মেয়েকে পছন্দ হলো। দেখা গেল সেই মেয়ে বিবাহিতা। কোনো অসুবিধা নেই। হাসবেন্ড মেরে ফেলা। নতুন করে বিয়ের ব্যবস্থা কর।
চুপ!
আমাকে চুপ করতে বলছেন?
হ্যাঁ চুপ। আর কোনো কথা না। এখন গেট আউট। এই মুহুর্তে গেট আউট।
আসল কথাটা তো এখনো বলতে পারি নি।
আসল কথা নকল কথা কোনো কথা না। তুমি ভদ্রলোকের ছেলে। মারধোর করব না। মানে মানে বের হয়ে যাও।
আপনার ব্যাঞ্জো বাজনা বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম। আপনার মেয়ের বিবাহের বিষয়ে না। মোঘল সাম্রাজ্যও তো এখন নাই যে স্বামী খুন করে আবার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
ব্যাঞ্জো বিষয়ে তোমার কী কথা?
একটা সিডি কোম্পানি আপনার ব্যাঞ্জো নিয়ে সিডি বের করতে চায়। আমি তাদের এজেন্ট। এই বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।
আমার ব্যাঞ্জো বাজনার সিডি বের করতে চায়?
জ্বি।
তুমি আমার নাম জানো?
নাম কেন জানব না? আপনি হলেন ওস্তাদ শমসের উদ্দিন খাঁ।
খাঁ পেলে কোথায়? নামের শেষে খাঁ নাই।
খাঁ নাই, এখন লাগায়ে দিব। ওস্তাদের নামের শেষে খাঁ না থাকলে মানায় না। আপনি আগ্রহী হলে বলেন। টার্মস এন্ড কন্ডিশন ঠিক করি।
আমার ব্যাঞ্জো বাজনা তুমি শুনেছ?
আমি শুনি নি। শোনার ইচ্ছাও নাই। গান বাজনা আমার পছন্দের জিনিস না। আমি এজেন্ট। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছে, করলাম। বাকি আপনার ইচ্ছ। শুনেছি ব্যাঞ্জো যন্ত্রটা আজকাল বাজানো হয় না। লোকজন এই যন্ত্রটার কথা ভুলেই গেছে। আর আপনি নাকি মোটামুটি বাজাতে পারেন।
মোটামুটি বাজাই? আমি মোটামুটি বাজাই? আমি মোটামুটি বাজালে সিডি কোম্পানি তোমাকে আমার কাছে পাঠাতো সিডি বের করার জন্য? এরা তো তোমার মত ঘাস খায় না।
তাও ঠিক। আপনি কি রাজি?
ফট করে রাজি অরাজি কী? জিনিসটা ভালো মতো বুঝে নেই। চা খাও। কী ধরনের বাজনা এরা চায়? রাগ প্ৰধান?
সেটা আপনার ইচ্ছা। রাগ-প্রধান বাজাতে চাইলে রাগ-প্রধান বাজাবেন। ভালোবাসা-প্রধান বাজাতে চাইলে ভালোবাসা-প্রধান বাজাবেন।
ভালোবাসা-প্রধান কী?
আপনারা সঙ্গীতের লোক। আপনারা জানবেন ভালোবাসা-প্রধান কী?
তুমি তো দেখি গান বাজনা লাইনের কিছুই জানো না।
আগেই তো বলেছি কিছু জানি না। আপনি কী বাজাবেন আপনি ঠিক করুন। আপনার সঙ্গে কি তবলা ফ বলা লাগবে?
ফবলা কী? এইভাবে কথা আমার সঙ্গে বলবে না।
জ্বি আচ্ছা বলব না।
শমসের উদ্দিন সাহেবের চোখ মুখ কোমল হয়ে গেল। তিনি এই প্রথম স্নেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কী?
হিমু।
ভালো নাম কী?
ভালো নাম, খারাপ নোম একটাই— হিমু।
সত্যি সত্যি ব্যাঞ্জোর সিডি বের করবে?
অবশ্যই।
এই উপমহাদেশে আমার চেয়ে ভালো ব্যাঞ্জো কেউ বাজায় না। এটা জানো?
জ্বি না।
তোমাকে তুমি তুমি করে বলছি, মনে কিছু নিও না।
আপনি ওস্তাদ মানুষ আপনি তো তুমি তুমি করে বলবেনই। তাহলে কথাবার্তা ফাইন্যাল?
শমসের উদ্দিন নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন, বত্ৰিশ মাত্রা, সঙ্গে তেহাই— রাগ কাফি যখন ধরব ঝড় তুলে দিব। ব্যাঞ্জোর উপর দিয়ে যখন আঙুল চলবে। আঙুল দেখা যাবে না। যদি আঙুল দেখা যায়–আল্লাহর কীরা আঙুল কেটে তোমাকে দিয়ে দিব।
কাটা আঙুল দিয়ে আমি কী করব?
তুমি আঙুল কেটে কী করবে। সেটা তোমার বিবেচনা। আমার আঙুল কেটে দেয়ার কথা আমি দিলাম।
ধন্যবাদ!
তোমার নামটা যেন কী আরেকবার বলো তো। মিহি? আজকাল মানুষের নাম মনে থাকে না।
আমার নাম হিমু। তবে আপনার যদি মিহি ডাকতে ইচ্ছা হয় ডাকবেন।
রাতে আমার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করি। আজ বাসায় মাংস রান্না হবে। ঝোল দিয়ে গো মাংস, সঙ্গে চালের আটার রুটি। রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাংসের ঝোলের মধ্যে ফেলবে। রুটি নরম হবে। মুখের মধ্যে ফেলবে। আর গিলে ফেলবে।
কবুল।
কবুল মানে কী?
কবুল মানে আমি রাজি।
খাওয়া দাওয়ার পরে রাগ কাফির একটা বন্দীশ শোনাব। তিন তাল শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
মাথা তো আমার এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। দিন আরো খারাপ করে।
ঠিক করে বলো তো চালের আটার রুটি করবে না পোলাও রাধবে? অনেক দিন পোলাও খাই না। দরিদ্র মানুষ, ইচ্ছা করলেও সম্ভব হয় না।
আপনার কি পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে?
তুমি মেহমান মানুষ এই জন্যে বলছি। আর ফুলফুলিয়া সে-রকম ভালো রাধাতেও পারে না। আমার স্ত্রী পারতেন। আফসোস তার হাতের পোলাও তোমাকে খাওয়াতে পারলাম না।
উনি কোরমা কেমন রাঁধতেন?
কোরমার কথা বলে দিলে তো মনটা খারাপ করে। শহরের লোকজন তো কোরমা রাঁধতেই পারে না। মুরগির রোস্ট, দোপেয়াজা, ঝালফ্রাই। বাঙালি কোরমার কাছে কিছু লাগে? তোমার কি কোরমা খেতে ইচ্ছা করছে?
জ্বি। আপনার কি করছে?
আমার তো মুখে পানি চলে আসছে। বয়স হয়েছে তো, সুখাদ্যের কথা মনে হলে মুখে পানি চলে আসে। সামলাতে পারি না। দেখি ব্যবস্থা করা যায় কি না।
ফুলফুলিয়া এতক্ষণ পরে চা নিয়ে ঢুকেছে। তার দেরির কারণ বোঝা যাচ্ছে। সিঙ্গাড়া ভেজে এনেছে।