খালু সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। হাত বাড়িয়ে চায়ের মগ নিয়ে মাগে চুমুক দিলেন। সিগারেট ধরলেন। আমি নিজেই মাগে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চা-টা খুবই ভালো হয়েছে। খালু সাহেবের ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি দেখা গেল।
হিমু!
জ্বি।
তুমি তাকে নেংটো হয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার ভিক্ষা করে খেতে বলেছ?
তেমন ইমার্জেন্সি যদি হয় তাহলেই এই পথে যেতে বলেছি। তবে সে যাবে না। সে বলেছে তার লজ্জা করে।
তুমি একটা কথা বলবে। আর তা সে করবে না এটা কখনো হবে না। ঠিকই সে নেংটো হয়ে পথে পথে হাঁটবে। হিমু শোন, আমার ধারণা— না ধারণা না আমার দৃঢ় বিশ্বাস পুরো ব্যাপারটার আর্কিটেক্ট হচ্ছে তুমি। কফির দোকান, ফুলফুলিয়া, পরীক্ষা না। দেয়া, নেংটো হয়ে হাঁটাহাঁটি সব কিছুর মূলে আছ তুমি। আমার ছেলে গোল্লায় গেছে যাক–আমি তোমাকে ছাড়ব না। আমি তোমার হিমুগিরি বের করে দেব। তোমার খালা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তোমাকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর তুমি আমার ছেলেকে আমার সামনে হাজির করবে। যদি করতে পার তাহলেই তোমাকে ক্ষমা করব। আর নয়তো না।
খালু সাহেব সময় আরেকটু বাড়ানো যায় না? বাহাত্তর ঘণ্টা করা যায়?
চব্বিশ ঘণ্টা মানে চব্বিশ ঘণ্টা। এখন বাজে দুটা একুশ। আমি আগামীকাল দুটা একুশে তোমার এখানে আসব। তখন যেন জহিরকে দেখতে পাই।
খালু সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
আমি বললাম, জহির কোথায় আছে আমি জানি না। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। টেলিপ্যাথিক পদ্ধতিতে। একটু সময় তো লাগবেই।
খালু সাহেব আগুন কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এখন ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। রাগ সামলাবার চেষ্টা। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। স্ট্রোক ফোক না। হয়ে যায়। আমি বললাম, চলুন আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসি।
ধন্যবাদ। তোমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। I know the way.
খালু সাহেবের রাগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। রাগ এবং টেনশনের সময় তিনি বাংলা ভুলে যান। তাঁকে আর ঘাটানো ঠিক হবে না। আমিও খালু সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, এখন বসে পড়লাম। আমার হাতে চব্বিশ ঘণ্টা সময়। এই চব্বিশ ঘণ্টায় কিছু করা যাবে না। ফুলফুলিয়ার কাছ থেকে অবশ্যি টেলিপ্যাথিক পদ্ধতিতে মানুষকে ডাকার কৌশল শিখে আসা যায়। খালার সঙ্গেও কথা বলা দরকার। খালার বাসায় যাবার প্রশ্নই উঠে না। কথা বলার কাজটা সারতে হবে টেলিফোনে। কোনটা আগে করব বুঝতে পারছি না খালার সঙ্গে কথা বলব, না ফুলফুলিয়ার সঙ্গে দেখা করব? আশ্চর্য ব্যাপার খালু সাহেব এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো কথা বলতে চান। কথা বলাটা ঠিক হবে কিনা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। আমি বললাম, খালু সাহেব কিছু বলবেন?
চব্বিশ ঘণ্টা যাক তারপর যা বলার বলব।
খালু সাহেব দরজার দিকে রওনা হলেন। ফ্লাস্কটা ফেলে যাচ্ছেন। নিয়ে যেতে হবে। বলব কিনা বুঝতে পারছি না। বললে হয়তো আরো রেগে যাবেন। থাকুক ফ্লাস্ক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দামি জিনিস। বরং এক কাজ করা যেতে পারে, ফ্লাঙ্ক ভর্তি চা নিয়ে ফুলফুলিয়ার সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে। ঐ দিন তাঁর গরম রুটিগুলো ভালো ছিল। চা ভালো ছিল না।
কলিং বেলে হাত রাখার আগেই দরজা খুলে গেল এবং দরজা পুরোপুরি খোলার আগেই ফুলফুলিয়া বলল, ভাইজান আসুন। চমৎকৃত হবার মতো ঘটনা। দরজায় কোনো পিপ হোল নেই যে ফুলফুলিয়া আগে থেকে দেখবে আমি এসেছি। যেহেতু চমৎকৃত হবার ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই, আমি চমৎকৃত হলাম না। খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, কেমন আছ?
ফুলফুলিয়া বলল, ভালো।
তোমার দুটা ছবি আছে আমার কাছে। ছবি দুটা দিতে এসেছি।
ফুলফুলিয়া বলল, রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে ছবি?
তুমি ব্যাপারটা জানো না-কি?
উনি বলেছেন। উনি আসলে হঠাৎ করে ছবি দেখিয়ে আমাকে বিস্মিত করতে চেয়েছিলেন। পেটে কথা রাখতে পারেন নি। আগেই বলে দিয়েছেন। ভাইজান শুনুন, আমার বাবা বাসায় আছেন। উনার শরীর সামান্য খারাপ। আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে কিছু মনে করবেন না।
উনি কি সব সময় খারাপ ব্যবহার করেন?
কী করলে উনি খুশি হন?
কোনো কিছুতেই খুশি হন না। তবে তার ব্যাঞ্জো বাজনার প্রশংসা করলে তিনি মনে মনে খুশি হন।
কী বাজনা বললে–ব্যাঞ্জো?
জ্বি।
চল, তোমার বাবার কাছে আমাকে নিয়ে চল। উনার নাম কী?
শমসের উদ্দিন।
খাটের ওপর এই গরমের ভেতর কথা গায়ে দিয়ে জবুথবু হয়ে এক বৃদ্ধ বসে। আছে। নেশাগ্ৰস্ত মানুষের লাল চোখ। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কিছু মানুষ আছে সপ্তাহে একদিন শেভ করেন। উনি মনে হয় সেই দলের। ভদ্রলোকের মুখ ভর্তি দাড় গোঁফের জঙ্গল থাকলেও মাথা চুল শূন্য। টাক মাথা মানুষেরও কিছু চুল থাকে। উনার তাও নেই। তবে তার টাকে বিশেষত্ব আছে। টাকা চকচক করছে না। ম্যাট ফিনিশিং। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন।
আপনে কে?
আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, আমার নাম হিমু।
চান কী?
বসে তারপর বলি। বসতে পারি?
শমসের উদ্দিন লাল চোখে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। আমার দিকে না। তাঁর মেয়ের দিকে। আমি ফুলফুলিয়াকে বললাম, এই মেয়ে তুমি আমাদের দুজনকে চা দাও। আমি ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছি। চা খেতে খেতে আমি তোমার বাবার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলি। জরুরি কথা বলার সময় তোমার না থাকাই ভালো।