আমাকে গিয়ে ফুলফুলিয়াকে বলতে হবে যে, তোমার নামে আজ-কালের ভেতর একটা চিঠি আসবে। চিঠিটা তুমি না পড়েই নষ্ট করে ফেলবে।
ঠিক ধরেছ ভাইজান। এই কাজটা তোমাকে করতে হবে।
কোনো মেয়ের পক্ষে চিঠি না পড়ে নষ্ট করে ফেলা তো অসম্ভব ব্যাপার।
এই জন্যেই তো তোমাকে যেতে বলছি। তুমি বললেই অসম্ভব সম্ভব হবে। এই ক্ষমতা তোমার আছে।
আচ্ছা দেখি।
দেখাদেখি না। তুমি আজই যাবে এবং চিঠিটা না পড়ার কথা এমন ভাবে বলবে যেন সে চিঠি না পড়ে। একটা বিবাহিতা মেয়ে যখন দেখবে কেউ তাকে তখন তার ঘেন্না লাগবে। ভাইজান চিঠিটা ফেরত আনতে পারবে না?
চেষ্টা করব।
ভাইজান উঠি?
যা হাঁটা শুরু কর। খালি পায়ে না হেঁটে ভালো কেডস এর জুতা কিনে নে। আমি ঠিক করেছি খালি পায়েই হাঁটব। সঙ্গে টাকা-পয়সা কাপড় চোপড় কিছুই থাকবে না। ক্ষিধে লাগলে মানুষের বাড়ি গিয়ে খাওয়া চাইব। খেতে দিলে খাব। খেতে না দিলে খালি পেটেই হাঁটব। সন্ন্যাসীদের মতো জীবন।
নাগা সন্ন্যাসীদের মতো পুরোপুরি নগ্ন হয়ে তুই যদি হাঁটতে পারিস তাহলে কিন্তু খাওয়ার অভাব হবে না। একজন নগ্নমানুষ কোনো বাড়িতে খেতে চাইছে আপদ বিদেয়। করার জন্যেই তারা তাড়াতাড়ি খাবার দেবে। টাকা-পয়সা চাইলে টাকা-পয়সা দেবে।
নগ্ন হয়ে হাঁটতে পারব না ভাইজান, লজ্জা লাগবে।
লজ্জা লাগলে তো কিছু করার নেই। তোকে বুদ্ধি শিখিয়ে দিলাম। যদি দেখিস মহাবিপদে পড়ে গেছিস, খাওয়া জুটছে না— তখন নাগা সিস্টেম।
জহির উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, শুভ দেশ হন্টন।
বিকেল তিনটায় খালু সাহেব চলে এলেন। তাঁর মুখ গভীর। কপালের চামড়া কুঁচকে আছে। চোখ ছোট ছোট। সুপ্ত অগ্নিগিরি টাইপ ভাব ভঙ্গি। বিস্ফোরণের আগে আগ্নেয়গিরি অতিরিক্ত শান্ত থাকে। খালু সাহেবও অতিরিক্ত শান্ত।
কেমন আছ হিমু?
জ্বি ভাল।
তোমাকে পাওয়া যাবে ভাবি নি। তুমি তো ঘরে বসে থাকার লোক না। শুয়ে আছ যে, শরীর খারাপ না-কি?
জ্বি না। শরীর ভালো।
অফিস থেকে বাসায় যাবার পথে ভাবলাম তোমার সঙ্গে বসে এক কাপ চ খেয়ে যাই। জহিরকে নিয়ে কিছু কথা ছিল। কথাও বলি।
আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম— আমি চায়ের কথা বলে আসি।
খালু সাহেব বললেন, চায়ের কথা বলতে হবে না। আমি ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছি। অফিসের পিওনের কাছে ফ্লাস্ক। কাপ আনতে ভুলে গেছি। ওকে দুটা মগ কিনতে পাঠিয়েছি।
আমার কাছে কাপ ছিল।
তোমারটা তোমার কাছে থাকুক। মগ দুটা তোমাকে দিয়ে যাব। অফিস ফেরত মাঝে মধ্যে যদি চা খেতে আসি মাগে করে চা খাওয়া যাবে।
আপনি কি প্রায়ই আসবেন?
খালু সাহেব আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চেয়ারে বসলেন। টেবিলে রাখা ফুলফুলিয়ার ছবি দুটা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
কার ছবি?
রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের ছবি।
সে তো বুঝতেই পারছি। মেয়েটা কে?
ওর নাম ফুলফুলিয়া।
ফুলফুলিয়া? নামটা পরিচিত লাগছে কেন?
খালার কাছে তার নাম মনে হয় শুনেছেন।
ও আচ্ছা— দ্যাট ফুলি ফুলিয়া? রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের সঙ্গে তার ছবি কীভাবে এলো।
এটা ফটোগ্রাফিক ট্রিক। ফটোশপ নামের একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামে এই কাজটা সহজেই করা যায়।
জহির করেছে?
জ্বি।
পড়াশোনা বাদ দিয়ে সে ট্রিক ফটোগ্রাফ করছে? তুমি নিশ্চয়ই জানো আজ সে পরীক্ষা দিতে যায় নি।
জানি। আমার কাছে এসেছিল।
তোমার কাছে যে আসবে এটা আমি ধরেই নিয়েছি।
খালু সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরালেন। তাঁর কপালের চামড়ায় আরেকটা ভাঁজ পড়ল। চোখ দুটা আরো ছোট হয়ে গেল। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি এখন গা ঝাড়া দিচ্ছে। যে-কোনো সময় লাভা বের হতে শুরু করবে। খালু সাহেবের পিওন দুটা মগ এবং ফ্লাস্ক নিয়ে ঢুকেছে। লোকটা অতি দ্রুত মাগে চা ঢেলে দিল। সে চায়ের সঙ্গে কেকও এনেছে। এক বাক্স টিসু পেপার এনেছে। টিসু পেপার, কেক রেখে অতিদ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মনে হয় তার ওপর এ রকম নির্দেশই ছিল।
হিমু।
জ্বি।
জহিরের পরিকল্পনা কী তা তুমি জানো?
জানি। আমাকে বলে গেছে। আপাতত সে হাঁটবে।
হাঁটবে মানে?
প্ৰথমে যাবে তেতুলিয়া, সেখান থেকে হাঁটা শুরু করবে। হাঁটা বন্ধ হবে শাহপরী দ্বীপে। শাহপরী দ্বীপ হলো বাংলাদেশের শেষ সীমানা। শাহপরী দ্বীপে পৌঁছার পর সে সমুদ্র স্নান করবে। দাড়ি কামাবে।
দাড়ি কামাবে মানে?
এই কদিন সে দাড়ি গোঁফ কামবে না। ছয় মাসে দাড়ি গোঁফ অনেক বড় হয়ে যাবে। কামানো ছাড়া গতি কী?
সে ছয় মাস ধরে হাটবে। এটাই তার পরিকল্পনা?
জ্বি।
সে যে বর্তমানে মানসিক রোগী এটা কি সে জানে?
জ্বি না জানে না। মানসিক রোগী কখনোই বুঝতে পারে না যে সে মানসিক রোগী।
তোমাকে যখন সে তার পরিকল্পনার কথা বলল, তখন তুমি তাকে কী বললে?
আমি তাকে ভালো কেডস জুতা কিনতে বললাম। খাওয়া দাওয়ার সমস্যা যদি হয়। তখন একটা বুদ্ধি বলে দিয়েছি। এই বুদ্ধিমতো কাজ করলে খাওয়া দাওয়ার সমস্যা হবে না। যে-কোনো বাড়িতে খাবার চাইলেই খাবার দেবে।
কী বুদ্ধি?
খালু সাহেব সেটা আপনাকে বলব না। বললে আপনি রাগ করতে পারেন।
রাগ করব না, বলো। আমি হতভম্ব অবস্থায় আছি। হতভম্ব মানুষ রাগ করতে পারে না।
আমি জহিরকে বলেছি। যদি সে দেখে কেউ তাকে খেতে দিচ্ছে না। তাহলে সে যেন নাগা সন্ন্যাসী টাইপ হয়ে যায়। কাপড় চোপড় সব খুলে ফেলে পুরো নগ্ন হয়ে যাওয়া।
শুধু পায়ে থাকবে কেডস জুতা। এই অবস্থায় কোনো বাড়িতে খাবার চাইলে অবশ্যই খাবার দেবে।