ভাইজান আমি কোনো কথা না বলে আইসক্রিম নিলাম। পাথরের মূর্তির মতো আইসক্রিম হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা বলল, খান আইসক্রিম খান। আমি সঙ্গে সঙ্গে আইসক্রিমে কামড় দিলাম। যেন জীবনে এই প্ৰথম আইসক্রিম খাচ্ছি। ভাইজান গল্পটা কেমন?
ভালো। মেয়েটা দুটা আইসক্রিম নিয়ে যাচ্ছিল কেন?
সে আর তার বাবা তাদের বাসার দিকে যাচ্ছিল। তারা বাবা আইসক্রিম খেতে চাইল বলেই দুটা আইসক্রিম কেনা হলো। তখন বাবা হঠাৎ কী কারণে মেয়ের ওপর রেগে উল্টো দিকে চলে গেল। মেয়েটা দুটা আইসক্রিম নিয়ে বাসায় ফিরছে। মনে মনে ঠিক করেছে। পথে টোকাই শ্রেণীর কাউকে দেখলে একটা আইসক্রিম দিয়ে দেবে। আমাকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আইসক্রিমটা আমাকে দিয়ে দিল।
তুই কি করলি? আইসক্রিম খেতে খেতে ফুলফুলিয়ার বাসা পর্যন্ত গেলি?
হ্যাঁ ভাইজান। সে আমাকে যেতে বলে নি। হ্যামিলনের বংশীবাদকের পেছনে পেছনে ছেলেপুলেরা যেভাবে গিয়েছে। আমি ঠিক সেইভাবেই গিয়েছি। একসময় মেয়েটা বলল, এই বাড়িতে আমরা থাকি। এখন আপনি বাসায় যান। আমাকে আমার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ। ঘটনাটা কেমন ভাইজান? ইন্টারেস্টিং না?
হুঁ।
ভাইজান আমি ঠিক করেছি। এই ঘটনা নিয়ে একটা ছোটগল্প লিখব। গল্পের নামসবুজ আইসক্রিম। আমি যে আইসক্রিমটা খেয়েছিলাম সেটার রঙ ছিল সবুজ। গল্পে ছেলেটার নাম থাকবে টগর। মেয়েটার নাম থাকবে বেলী। দুটাই ফুলের নাম।
গল্পের নামটা খারাপ না। তবে পাত্র-পাত্রীর নাম ভালো হয় নি।
গল্পের শেষটা ভেবে রেখেছি। গল্পের শেষে টগর এবং বেলী কাজির অফিসে গিয়ে বিয়ে করবে। বিয়ের পর পরই দুজন দুটা সবুজ আইসক্রিম খেতে খেতে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবে। মিলনাত্মক গল্প।
মিলনাত্মক গল্প না লিখে বিয়োগান্তক লেখা। বাস্তবের সঙ্গে মিলবে। যেমন ধরা এক পর্যায়ে ছেলেটা জানতে পারল যে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। সে খুব মনে কষ্ট পেল। একবার ভাবল সারাজীবন বিয়ে করবে না। সারাজীবন একা থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে করল। তিন বছরের মাথায় তাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো। বেলী বলল, ওগো মেয়েটার সুন্দর একটা নাম রাখো তো। আনকমন নাম। টগর বলল, ওর নাম রাখলাম আইসক্রিম।
জহির বলল, বিয়োগান্তক গল্পটাও খারাপ না। দেখি দুভাবেই লিখব। এখন তোমাকে জরুরি কাজের কথাটা বলেই চলে যাব।
যাবি কোথায়?
এখনো ঠিক করিনি কোথায় যাব। বাড়িতে তো যাওয়াই যাবে না। কোনো এক বন্ধুর বাসায় উঠব। তারপর ডিসিসান নেব। ফুলফুলিয়াকে একবার দেখে আসতে পারলে ভালো হতো। সেটা মনে হয় ঠিক হবে না। তুমি কী বলো? ঠিক হবে?
না।
ওর ছবিগুলি তো ওকে ফেরত দেয়া দরকার। ছোটবেলার ছবি দিয়ে দুটা প্রিন্ট বের করেছি। একটা আইনষ্টাইনের সঙ্গে আরেকটা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার ছবিটা ভালো হয়েছে। ছবি দেখে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ তার নাতনির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
চা খাবি?
না ভাইজান, চা খাব না। এখন বিদেয় হব। বেশিক্ষণ থাকলে বাবার হাতে ধরা পড়ে যাব। আমি মোটামুটি নব্বই দশমিক পাঁচ ভাগ নিশ্চিত যে বাবা খবর পেয়েই সরাসরি তোমার কাছে চলে আসবে।
আমারও তাই ধারণা।
বাবার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের দুজনকেই পালিয়ে যেতে হবে। আমি কোথায় যাব এটা এই মুহুর্তে ঠিক করে ফেললাম।
কোথায় যাবি?
কোথাও যাব না। শুধু হাঁটব।
শুধুই হাটবি মানে?
ভাইজান, তুমি ফরেস্টগাম্প ছবিটা দেখছ?
না।
ফরেস্টগাম্প ছবিতে অভিনেতা টম হ্যাংকস হাঁটা শুরু করে। দিনের পর দিন কোনো কারণ ছাড়াই হাটে। হাঁটতে হাঁটতেই তার দাড়ি গোঁফ গজিয়ে যায়। আমিও টম হ্যাংকস এর মতোই হাঁটব। তবে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা না। আমি হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করব।
কী চিন্তা করবি?
পৃথিবীতে যে মানুষের মতো ইন্টেলিজেন্ট প্রাণী এসেছে, এরা কেন এসেছে? কেন প্রকৃতি এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি করল? প্রকৃতি মানুষের কাছে কী চাচ্ছে?
হেঁটে হেঁটে এমন জটিল চিন্তা করবি?
হুঁ। ভাইজান আমি হাঁটা শুরু করব তেতুলিয়া থেকে। হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশের শেষ সীমানা টেকনাফের শাহপরীতে যাব। সেখানে সমুদ্রে নেমে গোসল করব। গোসল করে উঠে এসে দাড়ি গোঁফ কমাব। আইডিয়াটা কেমন ভাইজান?
আইডিয়া খারাপ না।
এখন তোমাকে জরুরি কথাটা বলি। জরুরি কথাটা হচ্ছে ফুলফুলিয়াকে তুমি ছবি দুটা দিয়ে আসবে। আমি যাব না। এখন আমার আর যেতে ইচ্ছা করছে না।
খামে ভরে বাইপোস্ট পাঠিয়ে দিলেও তো হয়।
না ভাইজান, তোমাকেই যেতে হবে। আমি তো জানতাম না মেয়েটা বিবাহিতা। গতকাল রাতে মার কাছ থেকে জেনেছি। কিন্তু তার আগেই একটা ভুল করে ফেলেছি। পরশু দুপুরে ফুলফুলিয়াকে একটা চিঠি লিখে পোষ্ট করেছি। বত্ৰিশ পৃষ্ঠার চিঠি। আমি চাই না। এই চিঠিটা সে পড়ুক।
বত্রিশ পৃষ্ঠার চিঠি লিখেছিস কষ্ট করে, আরো কয়েক পৃষ্ঠা লিখলে তো উপন্যাস হয়ে যেত।
আমিও পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লিখব ঠিক করেছিলাম। এ4 সাইজ কাগজ শেষ হয়ে গেল। আমি যে-ধরনের চিঠি লিখেছি সে-ধরনের চিঠি লিখতে কষ্ট হয় না। দুই হাজার তিন হাজার পৃষ্ঠাও লেখা যায়। একটা বাক্যই বারবার লিখি–আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, পবিত্ৰ গাভী।
জহির বলল, চিঠি তোমাকে ফেরত নিয়ে আসতে হবে ভাইজান।