আমি বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, পবিত্ৰ গাভী।
ফুলফুলিয়া বলল, পবিত্ৰ গাভী মানে কী?
হলি কাউ। ঐটাই বাংলা করে বললাম— পবিত্ৰ গাভী।
ফুলফুলিয়া বলল, পবিত্ৰ গাভী তো আপনার আগে আমার বলা উচিত।
বলো। ফুলফুলিয়া খুব গম্ভীর গলায় বলল, পবিত্ৰ গাভী। বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল।
আমি বললাম, যাও রুটি বানিয়ে নিয়ে এসো। বেশি রাত করা যাবে না। মাজেদা খালার কেয়ারটকার অপেক্ষা করছে। তোমার উপর প্রতিবেদনটা হাতে হাতে নিতে যাবে।
মাজেদা খালাটা কে?
মাজেদা খালা হচ্ছেন তোমার হলেও হতে পারত শাশুড়ি। খুবই ইন্টারেস্টিং মহিলা। লোকজন গাছের ওপর ভূত বসে থাকতে দেখে। উনি একমাত্র মহিলা যিনি তাঁর শোবার ঘরের মশারির ভেতর ভূত বসে থাকতে দেখেন। বৃদ্ধ ভূত। old man and the sea-এর মতোই Old man and the mosquito net.
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
কথা বোঝার দরকার নেই। তুমি তোমার কাজ কর। আমি এখানে বসেই প্রতিবেদনটা লিখে ফেলি। দীর্ঘ প্রতিবেদনের দরকার নেই। ঘটনা যা দাঁড়িয়েছে সংক্ষিপ্ত চিঠি দিয়েই কাজ। সারা যায়। মাজেদা খালাকে সংক্ষেপ করে আমি লিখলাম প্রিয় মাখালা। অন্যরকম একটা অর্থ দাঁড়িয়ে গেল। চিঠির শুরুই হলো রহস্যময়।
প্রিয় মা-খালা,
ফুলফুলিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছে। এই মুহুর্তে আমি ফুলফুলিয়ার বাবার শোবার ঘরে বসে আছি। ফুলফুলিয়া রুটি সেঁকতে গিয়েছে। চা-রুটি খেয়ে চলে আসব। ফুলফুলিয়া মেয়েটার বায়োডাটা আলাদা একটা কাগজে লিখে দিলাম। ওজন এবং উচ্চতা অনুমানে লিখলাম। এই দুটি তথ্যে কিছু ভুল থাকতে পারে।
মেয়েটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত না হবার একশটি কারণ আছে। আমি শুধু একটা কারণ উল্লেখ করব। কারণটা হলো— বারুদ ভেজা।। মনে হচ্ছে তুমি কিছু বুঝতে পারছি না? আমি ব্যাখ্যা করে বলি। একবার যুদ্ধের সময় এক গোলন্দাজ সেনাপতির দায়িত্ব ছিল পাহাড়ের ওপর অবস্থান নেওয়া। সেখান থেকে যখন সে দেখবে শক্ৰ আসছে তখন সে গোলাবর্ষণ করবে।
শক্ৰ এলো ঠিকই কিন্তু গোলন্দাজ সেনাপতি গোলাবর্ষণ করল না। তাকে কোর্টমার্শাল করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে বলা হলো গোলাবর্ষণ না করার পেছনে তোমার কি কোনো বক্তব্য আছে?
সেনাপতি বলল, গোলাবর্ষণ না করার পেছনে আমার একশ দুটা যুক্তি আছে। তার প্রথমটা হলো–আগের রাতে প্ৰচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। সব বারুদ গেছে ভিজে।
বিচারপতি বললেন, বাকি একশ একটা যুক্তি বলতে হবে না। বারুদ ভেজা এই একটাই যথেষ্ট। যাও তুমি খালাস।
ফুলফুলিয়ার ব্যাপারে বারুদ ভেজার অর্থ হলো— মেয়েটা বিবাহিতা। তার স্বামী নাইক্ষ্যংছড়িতে আছে। পোস্টমাস্টার। পাহাড়ি-বাঙালি সমস্যার কারণে স্ত্রীকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারছে না ঠিকই কিন্তু পোস্টমাস্টার হবার সুবাদে প্রতিদিনই একটা করে চিঠি লিখে পাঠাচ্ছে।
আশা করি ফুলফুলিয়ার ব্যাপারে তোমার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হয়েছে। এখন বলো তোমার বৃদ্ধ ভূতের খবর কী? তাকে কি আবারো দেখেছি? আগেরবার সে বিছানায় বসে ছিল। এখনো কি বসা অবস্থায় পেয়েছ? বসতে পেলেই শুতে চায় এই প্রবচন ভুতদের বেলাতেও যদি খাটে তাহলে এর পরের বার শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখার কথা। তুমি ভালো থেকো।
জহির বসে আছে
আমার সামনে জহির বসে আছে। তার গায়ে হালকা কমলা রঙের গেঞ্জি। কী সুন্দর তাকে মানিয়েছে। গেঞ্জির কমলা রঙের আভা তার গালে পড়েছে, খানিকটা পড়েছে তার চোখে— গাল এবং চোখে কমলা রঙ চকচক করছে। আমি বললাম, জহির তোকে সুন্দর লাগছে রে! প্যাকেজ নাটকের নায়কের মতো লাগছে। পার্কে গানের দৃশ্যের শুটিং করার জন্যে নায়ক প্ৰস্তুত। নায়িকা এখনো আসে নি। নায়িকার জন্যে অপেক্ষা।
জহির হাসল। মিচিকা ধরনের হাসি।
আমি বললাম, তুই হাসছিস কেন? মিচিকা টাইপ হাসি?
জহির বলল, পরীক্ষার হলে যাবার কথা বলে এখানে চলে এসেছি। এটা ভেবে কেন জানি মজা লাগছে।
পরীক্ষা দিচ্ছিস না?
না।
পরীক্ষা যে দিচ্ছিস না খালা-খালু কি জানেন?
এতক্ষণে সম্ভবত জেনে গেছেন। আমি এক ওষুধের দোকান থেকে টেলিফোন করে মা-কে বলেছি।
খালা কী বললেন?
কিছু বললেন না। প্রথমে কোঁ করে একটা শব্দ হলো –তারপর ধপাস শব্দ শুনলাম। মনে হয় মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন। মা খুব সহজে অজ্ঞান হতে পারেন। একবার কী হয়েছে শোন, খাটের উপর বাবার প্যান্টের কালো বেল্ট পড়েছিল। মা সেই বেল্ট দেখে সাপ সাপ বলে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
এবার অজ্ঞান হয়েছে তোর পরীক্ষার হলে না যাওয়ায়?
মনে হয় হয়েছে। আমি ধপাস শব্দ শুনলাম, আমি যতই হ্যালো হ্যালো করি ওপাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না।
তুই মনে হয়। মজা পাচ্ছিস?
পাচ্ছি। ভাইজান শোন, তোমার কাছে আমি খুব জরুরি একটা কাজে এসেছি।
বল শুনি।
একটু পরে বলি? প্রথমে শোন ফুলফুলিয়ার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হলো সেই গল্প।
না প্রয়োজন নেই। তবু গল্পটা বলি? খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প। আমি লেখক হলে একটা গল্প লিখে ফেলতাম। হয়েছে কী ভাইজান— বিকাতলা স্টাফ কোয়াটারে আমার এক বন্ধু থাকে। দুপুরবেলা ওর কাছে গিয়েছি। একটা বই নিতে। ও বাসায় ছিল না। চৈত্র মাস, দুপুরে ঝাঝা রোদ। রিকশা পাচ্ছি না। রিকশার খোঁজ করছি–হঠাৎ দেখি একটা মেয়ে দুহাতে দুটা আইসক্রিম নিয়ে আসছে। দামি কোনো আইসক্রিম না। সস্তার জিনিস— ললিপপ। এমন কোনো অদ্ভুত দৃশ্য না যে আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু ঐ দিন আমি হা করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি দাঁড়িয়ে আছি সে এগিয়ে আসছে। আমাকে ক্রস করে চলে গেল— তারপরেও আমি তাকিয়ে রইলাম। তারপর হঠাৎ দেখি মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেছে। আমার দিকে ফিরে আসছে। সে এসে আমার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আইসক্রিম খাবেন? নিন। আইসক্রিম খান।