পান ব্যবসায়ী কিছু পাবে না?
কিছু অবশ্যই পাবে। টাকা উদ্ধার করে দিব, সেই খরচ আছে না?
আছে।
একজন ওসি সাহেব লাঞ্চে আছেন তাকেও ভাগ দিতে হবে।
আমি বললাম, বেশি ভাগাভাগি করলে দেখা যাবে আপনার ভাগেই কিছু থাকল না।
শাকুর ভাই বললেন, আমি টাকা নিয়ে কী করব? নাটক বানাচ্ছি। টাকার প্রয়োজন আছে, তবে অন্যের টাকা কেন নিব? আমি ছাত্রলীগ বা জাতীয় ছাত্রদল করলেও একটা কথা ছিল। যে-কোনো টাকায় এদের হক আছে। সত্যু কথা বলছি না?
অবশ্যই।
নাটক করার অভ্যাস আছে?
না। তবে শখ আছে। শিখিয়ে দিলে পারব। আপনার মতো গুণী পরিচালকের হাতে পড়লে জীবনের একটা গতি হয়ে যাবে।
চোখ টেরা করতে পারেন?
চেষ্টা করলে পারব।
চোখ টেরা করে দেখান তো।
আমি চোখ টেরা করে দেখলাম। পরিচালক সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আপনাকে দিয়ে হবে। আমার একটা ক্যারেক্টার আছে, মেয়েছেলে দেখলেই ট্যারা হয়ে যায় এবং তোতলাতে শুরু করে। কমেডি ক্যারেক্টার। তোতলাতে পারেন?
সেইভাবে পারি না। তবে চেষ্টার ক্রটি হবে না।
তোতলাতে তোতলাতে বলুন তো, কেমন আছ রিনা?
কে কে কে মনআ ছরি না।
বাহ ভালো হয়েছে। হানড্রেড পারসেন্ট ok, আপনাকে নিয়ে নিলাম।
আমি পরিচালককে কদমবুসি করে ফেললাম। পরিচালক হৃষ্ট গলায় বললেন, ভিডিও ক্লিপ দেখতে চেয়েছিলেন, নেন আড়ালে নিয়ে দেখেন। পাটখেতের ভেতরে ভিডিও করা। ক্লিয়ার ভিউ পাবেন না। তারপরেও যা আছে যথেষ্ট। মেয়ের নাম সুলতানা, ক্লাস নাইনে পড়ে। এই বয়সেই পেকে ঝানু নারিকেল হয়ে গেছে। দেখেন কেমন খিলখিল হাসি। দেখলেন?
হুঁ।
কেউ খিলখিল করে হাসতে হাসতে নেংটি হতে পারে? তাও ক্যামেরার সামনে?
কাজটা কঠিন।
এলাকার সাংসদ লোকজন নিয়ে যখন আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন তাকেও আমি এই কথা বললাম। আমি ভদ্রভাবে বললাম, স্যার খিলখিল করে হাসতে হাসতে কোনো মেয়ের পক্ষে কি ক্যামেরার সামনে কাপড় খোলা সম্ভব?
সাংসদ বললেন, আজকালকার মেয়েদের পক্ষে সবই সম্ভব। আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাকশন চাই। আমার এলাকায় অনাচার হবে না।
আমি তখন ওসি সাহেবকে কুড়ি হাজার টাকা নজরানা দিলাম। ওসি সাহেব টাকা পকেটে রাখতে বললেন, ক্যামেরার সামনে এই অবস্থায় খিলখিল অসম্ভব। পুরো ঘটনা আপোষে ঘটেছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। সাংসদদের সব কথা শুনলে আমাদের চলে না। আমাদের ইনকোয়ারি করতে হবে। কঠিন তদন্ত হবে। তারপর ব্যবস্থা।
শাকুর ভাই আপনার নাটকের নাম কী?
নাটকের নাম কেঁদো না পারুল। রোমান্টিক অ্যাকশান এবং হাই ফ্যামিলি ড্রামা। নাম কেমন হয়েছে?
আমি বললাম, প্যান প্যানা নাম হয়েছে। কান্দিস না পারুল নাম হলে ভালো হতো।
দুই বন্ধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। মনে হয় নাম পছন্দ হয়েছে।
শাকুর ভাইয়ের বন্ধু বললেন, কান্দিস না পারুল নামের মধ্যে পাওয়ার আছে। এটা নিয়ে আরও চিন্তা করা প্রয়োজন। আপনি মোবাইলে ভিডিও ক্লিপিং দেখতে থাকুন। নাটকের নাম আজ রাতেই ফাইনাল হবে।
আমি বললাম, মোবাইল ফোন আপনার কাছে থাকুক। অবসর সময়ে আপনার সঙ্গে আরাম করে দেখব। এইসব জিনিস একা দেখা যায় না।
সত্যি কথা বলেছেন। যান কোথায় যাচ্ছেন, ঘুরে আসেন। তারপর তিন ভাই মিলে আরাম করে দেখব। দেখার মতো অনেক জিনিস আছে।
আমি দােতলার ডেকে চলে গেলাম। বৃদ্ধ আগের জায়গাতেই বসা। আমাকে দেখে করুণ গলায় বলল, বাজােন। চাদরটা কি দিবেন? আমার শীত লাগতেছে।
আমি বললাম, লঞ্চ বন্ধ। বাতাস নাই। শীত লাগবে কেন?
বৃদ্ধ চিন্তিত গলায় বলল, লঞ্চ বন্ধ কী জন্যে?
জানি না। খোঁজ নিব?
বাজান! খোঁজ নেন। জানি না। কী জন্যে যেন ভয় লাগতেছে।
লঞ্চের খোঁজ নিয়ে জানলাম, অবস্থা ভয়াবহ। একই সঙ্গে লঞ্চের হাল ভেঙেছে, ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছে। লঞ্চ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পানিতে ভাসছে। সারেঙের নাম খালেক। বাড়ি চট্টগ্রাম। তার জ্বর উঠেছে একশ পাঁচ। সে বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে। সকিনার মা নামে একজনকে চোখ বড় বড় করে খুঁজছে। যে পানি ঢালছে, কিছুক্ষণ পর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে, ও সকিনার মা, তুই কন্ডে? আঁর শরীর পুড়ি যার গৈ। তুই কডে?
লঞ্চ চাঁদপুরকে বাঁ-পাশে রেখে চলে যাচ্ছে। আব্দুল খালেক লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসল। ঝলমলে চাঁদপুরের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, যারগৈ! চানপুর যারগৈ। চাঁদপুর চলে যাওয়াতে তাকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে।
আতাহারের মা সালমা বানু
আতাহারের মা সালমা বানু গত এক মাস হল হাসপাতালে। তাঁর অসুখটা যে কি ডাক্তাররা ধরতে পারছেন না। শুরুতে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা হল। এখন সেই চিকিৎসা বন্ধ করে নানান ধরনের টেস্ট করানো হচ্ছে। একই টেস্ট কয়েক জায়গা থেকে করানো হচ্ছে। রেজাল্ট একেক জায়গা থেকে একেক রকম আসছে। ডাক্তাররা তাতে বিরক্ত বা বিস্মিত হচ্ছেন না। এটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছেন। দুজন ডাক্তারের ভেতর একজন মনে করছেন কিডনিঘটিত কোন জটিলতা। রক্তের দুষিত অংশ পরিষ্কার করার পর কিডনি আবার তা রক্তেই ফেরত পাঠাচ্ছে। অন্যজন বলছেন কিডনি খুব ভাল অবস্থায় আছে। সমস্যা অন্য কোথাও। সেই অন্য কোথাওটা কি তা বলতে পারছেন না।
সালমা বানু ঘোরের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন। আচ্ছন্ন অবস্থা। মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায়, তখন কৌতূহলী চোখে চারপাশে তাকান। লোকজনের কথা শুনেন। নিজেও কথা বলেন। এই সময় কথা শুনতে ও বলতে তাঁর ভাল লাগে। শব্দগুলি ঝন ঝন করে কানো বাজে। নিজের গলার শব্দও নিজে চিনতে পারেন না। মনে হয়। অন্য কেউ কথা বলছে। এই রকম সময় তার বেশি আসে না। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, যখন আসে তখন আশেপাশে কথা বলার মত কেউ থাকে না। তখন তিনি একা একাই কথা বলেন, শব্দ করে হাসেন। এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে পাগল ভাবতো। এখনো কেউ দেখেনি। শুধুমতির মা দেখেছে। মতির মা বুয়া আঠারো বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আছে। তার সুবিধা হচ্ছে সে কোন কিছুতেই বিস্মিত হয় না। সালমা বানুর একা একা কথা বলাটাকে সে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।