যুবক তীক্ষ্ণ গলায় বলল, বলেন তো কী ঘটনা।
আমি বললাম, ডেডবডি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে হলে চা পাতা দিয়ে মুড়ে নিতে হয়। চা-পাতার সঙ্গে থাকে কপুর। চা-পাতার ভেষজগুণের কারণে ডেডবডিতে পচন ধরে না। ঐ চা-পাতা পরে খুবই সস্তাদরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ডেডবিডির চা-পাতায় বানানো চায়ে থাকে কাপুরের গন্ধ। এখন বুঝেছেন?
পরিষ্কার বুঝেছি। আর বলতে হবে না।
যুবক চায়ের কাপ নামিয়ে আঙুল ফুটাতে লাগল। যুবকের চোখমুখ শক্ত! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যুবক একটা ঘটনা ঘটাবে। বাঘ শিকারের ওপর লাফ দিয়ে পড়ার আগে মাটিতে লেজ দিয়ে বাড়ি দেয়। মানুষের লেজ না থাকার কারণে সে আঙুল ফুটায়। অনেকে থুথু ছিটায়।
এই যুবকের বন্ধু ভীতু প্ৰকৃতির। সে চাপা গলায় বলল, বাদ দে দোস্ত। বাদ দে।
বাদ দিব কেন?
ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী?
ঝামেলার প্রয়োজন আছে। এই হারামজাদার নাকটা আমি যদি না ফাটাই আমার নাম শাকুর না। আমার নাম কুকুর।
আমি গলা নামিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, শাকুর ভাই, ভিডিওতে কী দেখাচ্ছেন, আমাকে দেখাবেন?
আমার কথা বলার ভঙ্গিতে হোক বাঁ অন্য কোনো কারণেই হোক, শাকুর ভাই আমার দিকে বন্ধু-ভঙ্গিতে তাকালেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, প্রাইভেট জিনিস দেখছি! আপনার দেখা ঠিক না। দেখলে লজ্জা পাবেন।
দেশি মেয়ে না বিদেশি?
দেশি।
মডেলকন্যা?
না, আমাদের অঞ্চলের মেয়ে। নিজে ইচ্ছা করে তুলেছে, এখন আমাদের দুইজনকে দোষ দেয়। আমরা নাকি ফান্দে ফেলে ছবি তুলেছি। আপনি বলেন, মেয়েছেলে কি ফান্দে পড়ার জিনিস? ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে—এই গান শোনা যায়। কিন্তু ফান্দে পড়িয়া বগী কান্দে এমন গান নাই।
আমি বললাম, অতি সত্য কথা বলেছেন। এ রকম সত্য কথা সচরাচর শোনা যায় না।
তাহলেই বোঝেন।
আপনাদের ভিডিওর দোকান আছে?
হুঁ। আমাদের ভিডিওর ব্যবসা। ভিডিও ফিল্ম বানাব। আমি পরিচালক। আমার প্রথম কাজ। নায়িকার সন্ধানে ঢাকা গিয়েছিলাম।
নায়িকা পেয়েছেন? একজন পেয়েছি। হাইট খুবই কম। এইটাই সমস্যা। কায়দা করে ক্যামেরা ধরতে হবে। অর্ডার দিয়ে এক ফুট হাইটের জুতা বানাতে হবে।
ভালো ঝামেলায় আছেন বুঝতে পারছি। আপনি কি চায়ের দোকানিকে সত্যি মারবেন?
অবশ্যই। না মারলে বাপ-মায়ের দেওয়া আকিকা করা নাম চেঞ্জ করতে হবে। এটা ঠিক না।
মারামারি শুরু হবে কখন?
রাগ উঠাচ্ছি। রাগ এখনো উঠে নাই। আমার রাগ উঠতে দেরি হয়। এমনও হয়েছে রাগ উঠতে দেড়-দুই ঘণ্টা লেগেছে।
আমি উঠে পড়লাম। শাকুর ভাইয়ের রাগ উঠুক, তারপর দেখা যাবে কতদূর কী হয়। আপাতত লঞ্চ ঘুরেফিরে দেখা যাক। ভূ-পর্যটক রমানাথ। লঞ্চ-পর্যটক হিমু। আমার পর্যটন শুরু হলো লঞ্চের পেছন থেকে।
দুই হাত হাতকড়ায় আবদ্ধ একজনকে দেখা গেল। কোমর দড়ি দিয়ে বাঁধা। পায়ে ডাপ্তাবেড়ি। মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় বাবরি চুল। সাদা লুঙ্গির ওপর মাওলানা ভাসানী টাইপ সাদা পাঞ্জাবি। তার সঙ্গে চারজন রাইফেলধারি পুলিশ। সবাই পা লেপ্টেট মেঝেতে বসে আছে। তাদের কাছাকাছি লাল প্লাষ্টিকের চেয়ারে একজন সাব-ইন্সপেক্টর বাসা। শার্টের পকেটে নাম লেখা—জাকির হোসেন।
উৎসুক কিছু মানুষ দূর থেকে দেখছে। কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না। আমি এগিয়ে গেলাম। বিনীত গলায় বললাম, জাকির ভাই, আপনাদের কিছু লাগবে? চা-সিগারেট? লাগলে বলেন, এনে দিব।
জাকির হোসেন বিরুস গলায় বললেন, কিছু লাগবে না। তিনি ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকাচ্ছেন। কাঠির যে অংশে বারুদ সেই অংশই ক্যানের ভেতর ঢুকানো। তাকিয়ে থাকতে অস্বস্তি লাগে। মনে হয় এই বুঝি কাঠিতে আগুন ধরে যাবে।
আমি বললাম, স্যার হাতকড়া পরা মাওলানা সাহেবের ঘটনাটা কী?
ঘটনা তোমার জানার প্রয়োজন নাই।
আমি পত্রিকার লোক। ঘটনা জানলে নিউজ করে দিতাম। ছবিসহ নিউজ। সঙ্গে আপনার মিনি ইন্টারভিউ।
কোন পত্রিকা?
আমি কালের চিৎকার পত্রিকার ভ্ৰাম্যমাণ লঞ্চ-সাংবাদিক। লঞ্চে ঘুরে ঘুরে নিউজ সংগ্ৰহ করি।
হাতকড়া পরা মানুষটি আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সাংবাদিক ভাই বসেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বসলাম। এইসব ক্ষেত্রে দেরি করতে নাই। জাকির হোসেন কঠিন চোখে তাকালেন তবে কিছু বললেন না। তিনি কাঠি দিয়ে কান চুলকিয়েই যাচ্ছেন। মনে হয়। কাঠিতে আগুন না। ধরা পর্যন্ত তিনি থামবেন না।
আমি হাতকড়া বাধা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার নাম কী?
আমি পীর হাবিব কুতুবি।
আপনি পীর নাকি?
জি। আমার হাজারের ওপর মুরিদ আছে। মুরিদানদের মধ্যে জজ আছে, উকিল আছে, সাংসদ আছে। একজন প্রতিমন্ত্রী আছে।
বলেন কী!
সবই আল্লাহর লীলা, আমার কিছু না। সুবাহানাল্লাহে ওয়াল হামদু লিল্লাহে ওয়া-লা-ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবর। অর্থ-আমি আল্লাহতালার পবিত্রতা বর্ণনা করিতেছি এবং সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহতালার জন্যে। আর তিনি ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নাই এবং আল্লাহতালাই সর্বশ্ৰেষ্ঠ।
আপনার এই অবস্থা কেন?
পীর হাবিব কুতুবি হাসিমুখে বললেন, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ছিলাম। এখন আমাকে বরিশাল সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানেই ফাঁসি দিবে।
ফাঁসি?
জি। বরিশাল হলো মফস্বল শহর। সেখানে ফাঁসির ব্যবস্থা কেমন কে জানে! ভালো থাকার কথা না। সরকারের কাজকর্ম কিছুই বুঝি না। তাদের উচিত ছিল আমাকে ঢাকায় ফাঁসি দেওয়া। তাদের খরচ বঁচিত। সাংবাদিক ভাই, আমার এই কথাটা মনে করে লিখবেন।