প্রথম কিছুক্ষণ বুঝতেই পারলাম না। আমি কোথায়। ঘুম ভাঙার পর নিজের অবস্থান বুঝতে দশ সেকেন্ড সময় লাগে। নিয়ম হচ্ছে এই দশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে থাকা। তারপর চোখ মেলে নিজের অবস্থান বুঝে নেওয়া। আমি তাই করলাম। অবস্থান জানা গেল।
আমি শুয়ে আছি দোতলা লঞ্চের ডেকে। অন্ধকারে লঞ্চ চলছে। ইঞ্জিনের ধক ধক শব্দ হচ্ছে। একজন বৃদ্ধ ছাড়া আমার আশপাশে কেউ নেই। বৃদ্ধের চেহারা হোচিমিনের মতো। বয়স সত্তরের বেশি। পিঠ ধনুকের মতো খানিকটা বেঁকেছে। বৃদ্ধের চোখে মোটা কাচের চশমা। কাচ এতই মোটা যে পেছনের চোখ দেখা যাচ্ছে না। হাতে বেতের বাঁকানো লাঠি। শুনেছি হযরত মুসা আলায়হেস সালামের লাঠি নাকি বাঁকা ছিল। লাঠির মাথায় চোখ আঁকা ছিল। এই বৃদ্ধের লাঠিতে চোখ নেই। চশমা এবং লাঠিতে বৃদ্ধকে মানিয়েছে। লঞ্চে কোনো শখের ফটোগ্রাফার থাকলে তাঁর অনেকগুলি ছবি উঠত। এই বৃদ্ধই কি আমাকে ডাকছিলেন? সম্ভাবনা ক্ষীণ। বৃদ্ধের আমার নাম জানার কথা না।
বাজানের ঘুম ভাঙছে?
হুঁ।
শীতে কষ্ট পাইতেছিলেন, এজন্যে আমার চাদরটা আপনার গায়ে দিছি। নয়া চাদর, আমার মেয়েজামাই খরিদ করে দিয়েছে।
এখন কি চাদর ফেরত চান?
বৃদ্ধ কিছু বলল না, অবাক হয় তাকিয়ে থাকল। সে নিশ্চয়ই আমার কাছে ধন্যবাদসূচক কথাবার্তা আশা করছিল। নিজের গায়ের চাদর অন্যকে দিয়ে বৃদ্ধ কিছু প্রশংসা আশা করতেই পারে মানুষ প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে।
আমি শোয়া থেকে বসলাম। আয়োজন করে হাই তুলতে তুলতে বৃদ্ধিকে বললাম, দুটা টাকা দিন তো। ময়লা নোট দিবেন না। ময়লা নোট ভর্তি থাকে জীবাণু। এখন জীবাণু ছানাছানি করতে পারব না। হাতের কাছে লাইফবয় সাবান নেই যে হাত ধুয়ে জীবাণুর কাছ থেকে সুরক্ষা নিব।
বাজান, আপনার কথা কিছু বুঝতেছি না।
আরও সহজ করে বলি, দুটা টাকা দেন চা খাব।
চা খাওয়ার টাকা দিব?
হ্যাঁ। টাকা ছাড়া ওরা চা দিব কোন দুঃখে!
আমি দিব?
হ্যাঁ, আপনি দিবেন। গায়ে চাদর দিয়েছেন, এখন চা খিলান।
দুই টাকা ভাংতি নাই।
ভাংতি না থাকলে পাঁচ টাকার একটা নোট দেন। তিন টাকা ফেরত দিব।
বৃদ্ধ অসহায় ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করতে করতে বলল, গায়ের চাদরটা ফিরত দেন।
আমি বললাম, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। হাত থেকে কিছু বের হয়ে গেলে আর ফেরত আসে না। কাজেই খামাখা চাদর চাদর করে মুখে ফেনা তুলবেন না। চাদরের ব্যাপারটা ভুলে যান।
বৃদ্ধ হতাশ গলায় বলল, বাজান এইসব কী কন?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সহজ কথা দিয়ে শুরু করেছি। আরও কঠিন কথা শুনতে হবে। রাতে লঞ্চের হোটেলে খানা খাব। খানার টাকা দিবেন। লঞ্চের টিকিট কাটি নাই। টিকিটের টাকা দিবেন। হাংকি পাংকি করবেন না। হাংকি পাংকি বোঝেন তো?
বাজান! আমি তো বিরাট বিপদে পড়লাম।
বিপদে তো অবশ্যই পড়েছেন। মানুষ খালি কেটে কুমির আনে, আপনি চাদর বিছিয়ে বাঘ নিয়ে এসেছেন। হালুম।
আমার বিকট হালুম শুনে বৃদ্ধ চমকে খানিকটা পিছলেন। তাঁর চোখে সংশয়। তিনি ধরে নিয়েছেন চাদর ফেরত পেতে তাঁর ঝামেলা হবে। আমি বৃদ্ধের হাত থেকে টাকা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বৃদ্ধ চোখ বড় বড় করে আমার দিকে কিংবা আমার গায়ে তাঁর চাদরটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দূর থেকে দেখলাম তাঁর ঠোঁট নড়ছে। সম্ভবত দোয়া পাঠ করছেন।
তিনতলা লঞ্চের দুতলায় চায়ের দোকান। এখানে শুধু চা বিক্রি হয় না, ভাতও বিক্রি হয়। অ্যালুমিনিয়ামের বিশাল সাইজের বেশ কয়েকটা ডেগা সাজানো আছে। ভাত বিক্রি শুরু হয় নি। দোকানের এক কোনায় সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা—চানপুর ক্রস করিবার পর খানা দেওয়া হইবে। খানার তালিকা দেওয়া আছে। ছোট ব্ল্যাকবোর্ডে চিক দিয়ে লেখা——
ইলিশ মাছ
ইলিশ মাছের ডিম
সবজি
ডাল-খাসি
মসুর ডাল
(মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করিবেন।)
কোন খাবারের কী মূল্য তা লেখা ছিল; এখন মুছে গেছে, কিংবা মুছে ফেলা হয়েছে।
দোকানের সামনে বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চে যুবক বয়সী দুইজন উদাস ভঙ্গিতে চা খাচ্ছে। দুজনের গলাতেই লাল রঙের মাফলার। দুজনের গায়ের শার্টের রঙ হলুদ। তাদের চোখে চশমার ফ্রেমও একই। বোঝাই যাচ্ছে এরা কঠিন বন্ধু। বিয়ে করার সময়ও এরা চেষ্টা করবে। একই পরিবারের দুই বোনকে বিয়ে করতে। একজনের হাতে মোবাইল। মোবাইলে নোংরা কোনো ভিডিও ক্লিপিং আছে। দুজনই আগ্রহ নিয়ে দেখছে এবং খ্যাকশিয়ালের মতে খিকখিক করে হাসতে গিয়েও হাসছে না। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
দোকানের মালিক কাঠের উচু চেয়ারে বসা। মাথাভর্তি ঘন চুল ছোট ছোট করে কাটা। ডাকাতের মতো চেহারা। এই লোকের দৃষ্টি ক্রমাগত ঘুরছে, কোথাও স্থির হচ্ছে না। আমি চায়ের কাপ নিয়ে দুই যুবকের মাঝখানে বসলাম। তারা সহজেই জায়গা ছাড়ল। বিরক্ত হলো না। যদিও বিরক্ত হওয়ার কথা। দুই বন্ধুর মাঝখানে হাইফেন হয়ে থাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য না। তাদের ভিডিও দেখা কিঞ্চিৎ বাধাগ্রস্ত হলো! চায়ে চুমুক দিয়ে ডানপাশের যুবককে বললাম, চায়ে কর্পুরের গন্ধ পাচ্ছেন?
যুবক তার কাপে চুমুক দিয়ে বলল, হুঁ!
কড়া গন্ধ না?
হুঁ।
চায়ে কর্পুরের গন্ধ কেন পাওয়া যায় জানেন?
না।
জানতে চান? অবশ্যি না-জানাই ভালো। জেনে ফেললে কাপের বাকি চাটা খেতে পারবেন না। দুই টাকার চা নষ্ট হবে।