ইরা বাদলকে নিয়ে ঢুকল। আমি বললাম, বাদল, তুই স্থির হয়ে আমার সামনের চেয়ারটায় বোস। মিস ইরা, আপনিও বসুন। তবে আপনাকে স্থির হয়ে না বসলেও চলবে। আপনি ইচ্ছা করলে নড়াচড়া করতে পারেন।
ইরা তাকাচ্ছে তীব্র চোখে। আমি তার সেই চোখ সম্পৃণ অগ্র্যহ্য করে বাদলের দিকে তাকিয়ে বললাম, বাদল শোন, তুই যদি ভেবে থাকিস আমি আমার মহা ক্ষমাতবলে তোর গলার কাঁটা গলিয়ে পেলেছি, তাহলে তুই বোকার স্বর্গে বাস করছিস। কি ভাবে সেই ঘটনা ঘটল তা ইরা খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে দেবে। ব্যাখ্যা শূনে তারপর ঘুমাতে যাবি। তার আগে না। মনে থাকবে?
‘থাকবে।’
‘যা ভাগ।’
বাদল হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়েছে। ইরা এখনো তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে খুব অপমানিত বোধ করছে। মেয়েটা সুন্দর। এরকম সুন্দর একটা মেয়ে ফিজিক্স পড়ছে কেন? ফিজিক্স পড়বে শূকনা রস কষহীন মেয়েগুলি। ইরার পড়া উচিত ইংরেজি কিংবা বাংলা সাহিত্য।
আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শূয়ে পড়লাম। ফোম বিছানো গদি—আরামের বিছানা। এত আরামের বিছানায় কি ঘুম আসবে?
‘হিমু, হিমু।’
‘জ্বি।’
‘তোর সঙ্গে কিছু গল্প গুজব করা যাক—ম্যান টু ম্যান টক। তু্ই আজ ভালই ভেল্কি দেখালি। দরজা খোল। হিমু, হিমু।’
মাতাল দরজা খোলাতে চাইলে খুলিয়ে ছাড়ব। ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকবে। কাজেই দরজা খুললাম। বড় ফুপা গ্লাস এবং বোতল হাতে ঢুকে পড়লেন।
‘তোর ফুপু ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব টেনশনে গেছে তো, এখন আরামে ঘুমুচ্ছে। আমি ভাবলাম ‘কন্টক-মু্ক্তিটা’ সেলিব্রেট করা যাক। কন্টক-মু্ক্তি শব্দটা কেমন লাগছে?
‘ভাল লাগছে।’
‘কন্টক মুক্তির ইংরেজী কি হবে?“Freedom from thorn?”
ফুপা আপনি দ্রুত চালাচ্ছেন। আমার মনে হয় এখন উচিত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া।’
‘তোর সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। গল্প করতে ভাল লাগছে। আমার ধারণা তোর উপর ইনজাসটিস করা হয়েছে। তোকে যে আমি বা তোর ফুপু দেখতে পারি না এটা অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়। তোর অপরাধ কি? আমি পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ভেবেছি। তোর নেগেটিভ দিকগুলো কি—
এক. তোর চাকরি বাকরি নেই। এটা কোন ব্যাপার না, পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ লোক পৃথিবীর সব পযটকরাই অপরাধি।
‘আর খাবেন না ফুপা।’
‘কথার মাঝখানে কথা বলিস না হিমু। আমি কি যেন বলছিলাম?’
‘পযটকদের সম্পর্কে কি যেন বলছিলেন।’
‘কোন পযটক? হিউয়েন সাং? হিউয়েন সাং এর কথা খামাখা বলব কেন?’
‘আর না খেলে হয় না ফুপা?’
‘হয়। হবে না কেন? তবে আনন্দ পরিপৃর্ণ হয় না। হিউয়েন সাং-এর কথা কি বলছিলাম?’
‘আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’
‘শোন হিমু, তুই লোক খারাপ না। এবং তোর ক্ষমতা আছে। বাদল যে তোর নাম বলতে অজ্ঞান হয়ে যাব, বদলের কোন দোষ নেই। I Like You Himu.’
থ্যংক ইউ ফুপা।’
‘তোর একটাই অপরাধ তুই শুধু হাঁটিস। এই অপরাধ ক্ষমা করা যায়। হিউয়েন সাংওতো হেঁটেছে। এই দেখ আবার হিউয়েন সাং-এর কথা চলে এসেছে। বারবার এই নাক চ্যাপ্টা চাইহীজটার কথা কেন বলছি কিঝুই বুঝতে পারছি না।’
ফুপা চোখ মুখ উল্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপড় হড়হড় শব্দ হতে লাগল। র্দীঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার কিছু করার নেই। ফুপা বিছানাতে বসেছিলেন। বিছানা এবং আমার শরীরের এক অংশ তিনি ভাসিয়ে ফেলেছেন। বিড় বিড় করে বলছেন,“ Iam a dead man, Iam a dead man,”
কানের কাছে কেউ একজন বলছে
উৎসর্গ
একজন মানুষকে চেনা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে এবং ছবির আউটডোর শুটিং-এ। নিষাদের প্রিয় দাড়িওয়ালা মামাকে।
তারিক আনাম খাঁন।
ভূমিকা
হিমুর পায়ের নিচে সবসময় মাটি থাকে। সে হেঁটে বেড়ায় বিষগ্ন ঢাকা নগরীর পথে পথে। আচ্ছা, তার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরিয়ে নিলে কেমন হয়? সে থাকুক। কিছু সময় পানির উপরে। দেখা যাক তার চিন্তা-ভাবনায় কোনো পরিবর্তন আসে। কি না।
ও আচ্ছা! এবার তাকে তার কাছাকাছি চরিত্রের তরুণীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটির নাম তৃষ্ণা। তৃষ্ণা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, চক্ষে আমার তৃষ্ণা, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে। সেখানে সম্পূর্ণ তৃষ্ণামুক্ত (?) হিমু কী বলবে।
হুমায়ূন আহমেদ
দখিন হাওয়া
ধানমণ্ডি
০১.
কানের কাছে কেউ একজন বলছে, হিমু, চোখ মেল!
আমি চোখ মেলতে পারছি না। চোখের পাতা সীসার মতো ভারী। ভারী প্রসঙ্গে চোখের পাতাকে সীসার সঙ্গে তুলনা করা হয় কেন? অনেক ধাতু আছে সীসার চেয়ে ভারী, যেমন লোহা। আমরা কখনো বলি না, চোখের পাতা লোহার মতো ভারী। লেখকরা এক একটা জিনিস চালু করেন, সেগুলি চালু হয়ে যায়। প্রাচীনকালে বাতাসে প্ৰদীপ নিভত, তখন ধাপ করে শব্দ হতো। লেখকরা লিখলেন, দপ করিয়া প্ৰদীপ নিভিয়া গেল। তা-ই চালু হয়ে গেল। ইলেকট্রিক বাতি নেভা প্রসঙ্গেও এখনকার লেখকরা লিখেছেন, দিপ করে বান্ধ নিভে গেল।
আমি ডান পায়ে ঝাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ঘুম তাড়ানোর সহজ উপায় পা দিয়ে ঝাকি দেওয়া। পারলাম না। হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেছে। গায়ের ওপর দিয়ে ঠান্ডা হওয়া বইছে। ভালোই ঠান্ডা লাগছে। এতে ঘুম আরও গাঢ় হচ্ছে। হাত-পা গুটিয়ে কুকুরুকুণ্ডলি নিদ্ৰা। মাছের তোলে মাছ ভাজার মতো নিজের ওমে নিজে গরম হওয়া।
হিমু, চোখ মেল!
আবার শুনলাম। কোনো একজন আমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেই কোনো একজনের গলা ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফতের মতো ভাৱী। উনি আমাকে কেন ডাকবেন বুঝতে পারছি না। ক্রিকেটের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? মনে হয় না। স্বপ্নদৃশ্য হলে যে ডাকছে তাকে দেখা যেত। চৌধুরী জাফরুল্লাহ সাহেবকে স্বপ্নে দেখারও কিছু নেই। আমি বিড়বিড় করে বললাম, আপনি যে-ই হোন, ক্যানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবেন না। বলতে বলতে ঘুম ভেঙে গেল।