ফুপু এবং ইরার বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে বাদল কাপড়-চোপড় পড়ে ইউনির্ভাসিটিতে চলে গেল।
ইরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি যা করেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ। এখন দয়া করে এ বাড়িতে আর আসবেন না।
আমি বললাম, যদি সম্ভব হয় আপনি দয়া করে নিজেকে বদলাবার চেষ্টা করবেন। আপনাকে আমি কোন উপদেশ দিতে চাই না। অপাত্রে উপদেশ দেয়ার অভ্যাস আমার নেই। তার পরেও একটা কথা না বলে পারছি না—হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় হাঁটলেই প্রকৃতিকে জানা যায় না। প্রকৃতিকে জানার পথ হল বিজ্ঞান। বুঝতে পারছেন?
‘পারছি।’
‘পারলে ভাল। না পারলেও ক্ষতি নেই।’
ফুপু বললেন, ওর সঙ্গে কথা বলিস না ইরা। টেলিফোনটা এনে দে। টেলিফোন করে বিদেয় হোক।
ইরা টেলিফোন এনে দিল।
‘হ্যালো রূপা। আমি হিমু।’
‘বুঝতে পারছি।’
‘কেমন আছ, রূপা?’
‘আমি কেমন আছি সেটা জানার জন্যে তুমি আমাকে টেলিফোন করোনি। তোমার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। সেটা বলে ফেল।’
‘রাগ করছ কেন?’
‘রাগ করছি না। তোমার উপর রাগ করা অর্থহীন। যে রাগ বোঝে না তার উপর রাগ করে লাভ কি?’
‘রাগ হচ্ছে মানব চরিত্রের অন্ধকার বিষয়ের একটি। রাগ না বোঝাটা তো ভাল।’
‘যে অন্ধকার বোঝে না, সে আলোও ধরতে পারে না।’
‘রূপা, তোমার লজিকের কাছে সারেন্ডার করছি।’
‘কি জন্যে টেলিফোন করছ বল।’
‘আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দাও রূপা। এমন একটা চাকরি যেন ভদ্রভাবে খেয়ে-পরে ঢাকা শহরে ছোটখাট একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকা যায়। জোগাড় করে দিতে পারবে?’
‘এমন কি কখনো হয়েছে যে তুমি আমার কাছে কিছু চেয়েছ আর আমি বলেছি—না?’
‘হয়নি।’
‘এবারো হবে না।’
‘আজ দিনের ভেতর চাকরিটা জোগাড় করে দিতে হবে।’
‘সেটা কি করে সম্ভব?’
‘তোমার জন্যে কোন কিছুই অসম্ভব না।’
‘চাকরিটা কার জন্যে?’
‘আমার এক বন্ধুর জন্যে। অতি প্রিয় একজনের জন্যে।’
‘নাম বল। এপয়েন্টমেন্ট লেটারে তার নাম তো লাগবে।’
‘লিখো—বদরুল আলম। চাকরিটা কিন্তু আজকের মধ্যেই জোগাড় করতে হবে।’
‘চেষ্টা করব। এপয়েন্টমেন্ট লেটার কি তুমি এসে নিয়ে যাবে?’
‘হ্যাঁ, আমি এসে নিয়ে যাবে।’
‘তুমি কোথেকে টেলিফোন করছ? যদি বলতে তোমার কোন আপত্তি না থাকে।’
‘আমি বাদলের বাসা থেকে টেলিফোন করছি। এই নাম্বার তোমার কাছে আছে। এই নাম্বারে টেলিফোন করে আমাকে পাবে না। তারা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।’
‘সবাই তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়?’
‘হ্যাঁ দেয়। এই ভয়েই আমি তোমার কাছে যাই না। কাছে গেলে তুমিও হয়ত বের করে দেবে। রূপা, আমি টেলিফোন রাখি?’
‘না, আরেকটু কথা বল। প্লীজ, প্লীজ।’
‘কি বলব?’
‘যা ইচ্ছা বল। এমন কিছু বল যেন…’
‘যেন কি?’
‘না, থাক।’
আমার আগেই রূপা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। আমি ফুপুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ইরার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ইরা বলল, আপনাকে কঠিন কথা বলেছি—আপনি কিছু মনে করবেন না।
আমি বললাম, আমি কিছু মনে করিনি। আমি নানানভাবে আপনাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করেছি।আপনি কিছু মনে করবেন না।
আমার ক্ষীণ আশা ছিল, মেয়েটা হয়ত বাড়ির গেট পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দেবে। সে এল না। আশ্চর্য কঠিন এক মেয়ে!
আমি এবং বদরুল সাহেব পাশাপাশি বসে আছি। ইয়াকুব আলি আমাদের সামনেই আছেন। আমাদের মাঝখানে বিরাট এক সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলে দু’টা টেলিফোন। একটা শাদা, একটা লাল। ইয়াকুব আলি সাহেব রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। তিনি অসম্ভব ব্যস্ত। আমরা বসে থাকতে থাকতে তিন-চারটা টেলিফোন করলেন। তাঁর টেলিফোন করার ধরনটা বেশ মজার। স্থির হয়ে কথা-বলতে পারেন না। রিভলভিং চেয়ারে পাক খেতে খেতে কথা বলেন। বদরুল সাহেব খুব উসকুস করছেন। আমি চুপচাপ বসে আছি। ইয়াকুব আলি এক ফাঁকে আমাদের দিকে একটু তাকাতেই বদরুল সাহেব বললেন,ইয়াকুব,ইনি হচ্ছেন আমার ফ্রেন্ড, হিমু সাহেব, উনাকে সাথে করে এনেছি।
ইয়াকুব আলি আমার দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে হেসে বললেন, চা চলবে? বলেই ইন্টারকমে কাকে খুব ধমকাতে লাগলেন।
আমরা ধমকপর্ব শেষ হবার জন্যে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক সময় ধমকপর্ব শেষ হল। ইয়াকুব আলি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে কথা বললেন, এ কি, এখনো চা দেয়নি? বলেই কর্কশ শব্দে বেল বাজাতে লাগলেন। কিংবা কে জানে বেল হয়ত মধুর শব্দেই বাজল, তবে আমার কানে ককর্শ লাগলো।
বদরুল সাহেব বললেন, চা লাগবে না ইয়াকুব।
‘অবশ্যই চা লাগবে। তুমি তোমার বন্ধু নিয়ে এসেছ। ফাস্ট মিটিং, চা লাগবে না মানে? তারপর কি ব্যাপার?’
বদরুল সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বলল, তুমি আজ আসতে বলেছিলে।
‘ও আচ্ছা, আজকে আসতে বলেছিলাম?’
‘আমার একটা চাকরির ব্যাপারে। তুমি বলেছিলে ব্যবস্থা করবে।’
ইয়াকুব আলি হাসিমুখে বলল, বলেছি যখন তখন অবশ্যই করব। স্কুল-জীবনের বন্ধুর সামান্য উপকার করব না তা তো হয় না। বায়োডাটা তো দিয়ে গিয়েছ?’
‘হ্যাঁ। দু’বার দিয়েছি।’
‘আমি দেখেছি। দেখ বদরুল, আপাতত কিছু করা যাচ্ছে না। নো অপেনিং। যে সব অপেনিং আছে তোমাকে দেয়া যাবে না। তুমি নিশ্চয়ই পিয়নের চাকরি করবে না। হা হা হা।’
বদরুল সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, তুমি আজকের কথা বলেছিলে। আমার অবস্থা খুবই ভয়াবহ।
ইয়াকুব দাশনিক ভাব ধরে ফেলে বলল, অবস্থা তো শুধু তোমার একার ভয়াবহ না, পুরো জাতির অবস্থাই ভয়াবহ। বিজনেস বলতে কিছু নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান লসে রান করছে।বাইর থেকে সেটা বোঝা যায় না।’
‘ইয়াকুব আমি তোমার উপর ভরসা করে এসেছিলাম…’
‘ভরসা নিশ্চয়ই করবে। ভরসা করবে না কেন? আমি কি করব তোমাকে বলি—আমি আমার বিজনেস কসমেটিক্স লাইনে এক্সপান্ড করছি। আমি মনে মনে ডিসাইড করে রেখেছি—তোমাকে সেখানে ম্যানেজারিয়েল একটা পোস্ট দেব।’
‘সেটা কবে?’
‘একটু সময় নেবে। মাত্র জমি কেনা হয়েছে। লোনের জন্যে এপ্লাই করেছি। বিদেশী কোন ফার্মের সঙ্গে কোলাবরেশানে যাব। ফ্যাক্টরী তৈরি হবে—তারপর কাজ। তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। সবুরে মেওয়া ফলে। এটা মনে রাখবে।’
বদরুল সাহেবের হতভম্ব মুখ দেখে আমার নিজেরই মায়া লাগছে। আহা বেহারা। সে বোধহয় জীবনে এত অবাক হয়নি। এসি বসানো ঠাণ্ডা ঘরেও ঘামছে।
চা চলে এসেছে। ইয়াকুব সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সিগারেট কি চলে নাকি ভাই? তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সিগারেট কি চলে নাকি ভাই? তিনি আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। আমি সিগারেট নিতে নিতে বললাম, বদরুল সাহেবকে চাকরিটা জন্যে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?
ইয়াকুব সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন—এগজ্যাক্ট বলা মুশকিল। তিন-চার বছর তো বটেই। বেশিও লাগতে পারে।
আমি সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। হাসিমুখে বললাম, ভাই শুনুন, চাকরি আপনার পক্ষে দেয়া সম্ভব না এই কথাটা সরাসরি আপনার বন্ধুকে বলে দিচ্ছেন না কেন? বলতে অসুবিধা কি? চক্ষুলজ্জা হচ্ছে? আপনার মত মানুষের তো চক্ষুলজ্জা থাকার কথা না।
ইয়াকুব আলি চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে বোঝার চেষ্টা করছেন। আমার ক্ষমতা যাচাইয়ের একটা চেষ্টাও আছে।
বদরুল সাহেব বললেন, হিমু ভাই, চলুন যাই।
আমি বললাম, চা-টা ভাল হয়েছে, শেষ করে তারপর যাই।
ইয়াকুব আলি এখনো তাকিয়ে আছেন। তাঁর হাত টেলিফোনের উপর। আমি তাঁর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললাম, আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি নিরীহ একজন মানুষ। আমি যা করতে পারি তা হচ্ছে—আপনার মুখে থু থু ফেলতে পারি। এতে আপনার কিছু হবে না। কারণ প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আপনার মুখে অদৃশ্য থু-থু ফেলছে। আপনি এতে অভ্যস্ত। থু-থু না ফেললেই বরং আপনি অবাক হবেন।
বদরুল সাহেব হাত ধরে আমাকে টেনে তুলে ফেললেন। চাপা গলায় বললেন, হিমু ভাই, কি পাগলামি করছেন?
ইয়াকুব সাহেব তাকিয়ে আছেন। রাগে তাঁর হাত কাঁপছে। সম্ভবত কি করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম, ভাই, আপনি আমাকে ভাল করে চিনে রাখুন। আমার নাম হিমু। আমি কাউকে সহজে ছেড়ে দেই না। আপনাকেও ছাড়ব না।
বদরুল সাহেব আমাকে টেনে ঘর থেকে বের করে ফেললেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমি বললাম, বদরুল সাহেব, আপনি মেসে চলে যান। আমি একটা কাজ সেরে মেসে আসছি। তারপর দু’জন একসঙ্গে আপনার দেশে রওনা হয়ে যাব।
‘আমার সঙ্গে তো টাকাপয়সা কিছুই নেই।’
‘একটা ব্যবস্থা হবেই। আপনার কি মেসে ফিরে যাবার মত রিকশা ভাড়া আছে?
‘জ্বি না।’
‘রাত দশটার আগে আমি অবশ্যই পৌঁছে যাব।’
বদরুল সাহেব পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কি ইচ্ছা করছে জানেন হিমু ভাই? ইচ্ছা করছে একটা চলন্ত ট্রাকের সামনে লাফ দিয়ে পড়ে যাই।
‘ট্রাকের সামনে লাফ দিয়ে পড়তে হবে না। আপনি মেসে চলে যান, আমি আসছি।’
‘হিমু ভাই, আমার কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে না।’
আমি লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোক সত্যি হাঁটতে পারছেন না। পা কাঁপছে। মাতালের মত পা ফেলছেন।’
আমি বললাম, চলুন, আপনাকে মেসে পৌঁছে দিয়ে তারপর যাই, আমার কাজটা সেরে আসি। হাত ধরুন তো দেখি।
‘দেশে গিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে কি বলব? মেয়েগুলিকে কি বলব?’
‘কিছু বলতে হবে না।এদের জড়িয়ে ধরবেন। এতেই তারা খুশি হবে। ভাই, চোখ মুছুন তো।’
আমি বদরুল সাহেবকে মেসে নামিয়ে দিয়ে গেলাম রূপার কাছে। আমি নিশ্চিত সে একটা ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমি তার হাত থেকে এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা নেব। হাজারখানিক টাকা নেব। কিছু মিষ্টি কিনব। বদরুল সাহেবের ছোট মেয়েটার জন্যে একটা বাংলা ডিকশনারি কিনব। মেয়েটা বড্ড বানান ভুল করে। ‘মুখস্থ’-র মত সহজ বানান ভুল করলে চলবে কেন? এইসব উপহার নিয়ে রাতের ট্রেনে রওনা হব বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধু-পত্নীর মেথি দিয়ে রাঁধা মাংস খেতে হবে। মাছের পোনা পাওয়া গেলে সজনে পাতা এবং পোনার বিশেষ প্রিপারেশন।