দরজা খুলে দিল ইরা। আমি অসম্ভব ভদ্র গলায় বললাম, কেমন আছেন?
ইরা কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। দিন শুরু হয়েছে গলাধাক্কায়, কাজেই যার সঙ্গেই দেখা হবে সেই কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকবে এত আর আশ্চর্য হবার কি আছে? আমাকে যে লাঠি দিয়ে মারছে না এই আমার তিনপুরুষের ভাগ্য।
‘বাদল আছে না-কি?’
‘আছে।’
‘ফুপা-ফুপু আছেন?’
‘সবাই আছেন। আপনি বসুন।’
ইরা কঠিন মুখে ভেতরে চলে গেল।
এমনভাবে গেল যেন বন্দুক আনতে গেছে। ফুপা অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, প্যান্ট পরেছেন, বোতাম লাগানো হয়নি, প্যান্টের বেল্ট লাগানো হয়নি। এই অবস্থাতেই চলে এলেন। আগুন আগুন চোখে তাকালেন। স্বামীর পেছনে পেছনে স্ত্রী—তাঁর চোখেও আগুন।
আমি হাসিমুখে বললাম, তারপর, খবর কি আপনাদের? সব ভাল?
ফুপা ক্রুদ্ধ গর্জন করলেন। গর্জন শুনেই মনে হচ্ছে খবর ভাল না।
‘আপনাদের আর কারো গলায় কাঁটা-টাঁটা বিঁধেছে?’
ফুপা এবারে হুংকার দিলেন, ইয়ারকি করছিস? দাঁত বের করে ইয়ারকি?
আমার অপরাধ কি বুঝতে পারছি না। তবে গুরুতর কোন অপরাধ যে করে ফেলেছি তা বোঝা যাচ্ছে। ইরাও এসেছে। তার চোখে আগে চশমা দেখেনি, এখন দেখি চশমা পরা।
ফুপু বললেন, তোকে যে এতবার খবর দেয়া হচ্ছে আসার জন্যে গায়ে লাগছে না? তোকে হাতি পাঠিয়ে আনতে হবে?
‘এলাম তো।’
‘এসে তো উদ্ধার করে ফেলেছিস।’
‘ব্যাপারটা কি খোলসা করে বলুন।’
কেউ কিছু বলছে না। ভাবটা এরকম—আমি বলব না। অন্য কেউ বলুক। আমি ইরার দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললাম, ইরা, চা খাব।
ইরা এমন ভাব করল যেন অত্যন্ত অপমানসূচক কোন কথা তাকে বলা হয়েছে।
আমি বললাম, তুমি যদি চা বানাতে না পার তাহলে লুৎফার মা’কে বল। ভাল কথা, লুৎফা মেয়েটা কোথায়?
এবারো জবাব নেই। ফুপা পেন্টের বোতাম লাগাচ্ছেন বলে অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকতে পারছেন না।তাঁকে বোতামের দিকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে, তবে ফুপু তাঁর দৃষ্টি দিয়ে স্বামীর অভাব পূরণ করে দিচ্ছেন। তাঁর চোখে ডাবল আগুন। কথা বলল ইরা। কাটা কাটা ধরনের কথা। তার কাছ থেকেই জানা গেল লুৎফা মেয়েটা চোরের হদ্দ। এসেই চুরি শুরু করেছে। বিছানার তল থেকে টাকা নিচ্ছে, মানিব্যাগ খুলে নিচ্ছে, সবশেষে যা করেছে তা অবিশ্বাস্য। ফুপুর কানের দুল চুরি করে নিজের পায়জামার ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছে। লাফালাফি করছিল, হঠাৎ পায়জামার ভাঁজ থেকে দুল বের হয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ মা-মেয়ে দু’জনকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। কাজেই বাড়িতে এই মুহূর্তে কোন কাজের মেয়ে নেই। আগের মত চাইলেই চা পাওয়া যাবে না।
বাদলের প্রসঙ্গে যা জানা গেল তা কানের দুলের চেয়েও ভয়াবহ। সে গত দশদিন হল ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না। দরজা বন্ধ করে ধ্যান করছে।
আমি মধুর ভঙ্গিতে ফুপার দিকে তাকিয়ে বললাম, ধ্যান করা তো গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। আপনারা এত আপসেট কেন?
ফুপা বললেন, মুগুড় দিয়ে এমন বাড়ি দেব যে সব কটা দাঁত খুলে চলে আসবে। ধ্যান করা শেখায়। সাহস কতবড়! যা, ধ্যান কিভাবে করছে নিজের চোখে দেখে আয়।
‘কিভাবে ধ্যান করছে?’
‘কাপড়-জামা খুলে ধ্যান করছে। হারামজাদা। দশ দিন ধরে বিছানার উপর নেংটো হয়ে বসে আছে।’
‘সে কি!’
‘আবার বলে সে-কি? তুই-ই না-কি বলেছিস নেংটা হয়ে ধ্যান করতে হয়। ধ্যান করা কাকে বলে তোকে আমি শেখাব। বন্দুক দিয়ে আজ তোকে আমি গুলি করে মেরে ফেলব। গুরুদেব এসেছে—ধ্যান শেখায়!’
ফুপু বললেন, তুমি এত হৈ-চৈ করো না। তোমার প্রেসারের সমস্যা আছে। তুমি অফিসে চলে যাও। যা বলার আমি বলছি।
‘অফিস চুলায় যাক। আমি হিমুকে সত্যি সত্যি গুলি করে মেরে তারপর অফিসে যাব। গুরুদেবগিরি বের করে দেব।’
ইরা বলল, হৈ-চৈ করে তো লাভ হবে না। ব্যাপারটা ভাল মীমাংসা হওয়া দরকার। উনি বাদলকে বুঝিয়ে বলবেন সে এসব না করে। তারপর এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। আর কখনো এ বাড়িতে আসবেন না। এবং বাদলের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ রাখবেন না।
ফুপা তীব্র গলায় বললেন, যোগাযোগ রাখবে কিভাবে? হারামজাদাকে আমি দেশছাড়া করবো না! এ ক্রিমিন্যাল! এ পেস্ট!
পরিস্থিতি ঠান্ডা হতে আধ ঘণ্টা মত লাগল। এর মধ্যে ইরা চা বানিয়ে আনল। ফুপার অফিসের গাড়ি এসেছিল—তিনি আমাকে গুলি করা আপাতত স্থগিত রেখে অফিসে চলে গেলেন। ফুপু ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে বসলেন। ফোঁসফোসানির মাঝখানে যা বললেন তা হচ্ছে—এত বড় ধামড়া ছেলে নেংটা হয়ে বসে আছে! কি লজ্জার কথা। তাকে ঘরে খাবার দিয়ে আসতে হয়। ভাগ্যিস বেশি লোকজন জানে না। জানলে নির্ঘাৎ পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আসতো।
ইরা আমার দিকে তাকিয়ে মোটামুটি শান্ত ভঙ্গিতেই বলল, আপনি চা খেয়ে দয়া করে বাদলের কাছে যান। তাকে বুঝিয়ে বলুন। সে বাস্তব এবং কল্পনা গুলিয়ে ফেলেছে।
আমি চায়ের কাপে হাতে বাদলের ঘরে গিয়ে টোকা দিলাম। বাদল আন্দদিত গলায় বলল, কে হিমু ভাই?’
‘হুঁ।’
‘আমি টোকা শুনেই টের পেয়েছি। তুমি ছাড়া এরকম করে কেউ টোকা দেয় না।’
‘তুই ধ্যান করছিস না-কি?’
‘হুঁ। হচ্ছে না।’
‘দরজা খোল দেখি।’
বাদল দরজা খুলল। সে যে নগ্ন হয়েই বসেছিল সেটা বোঝা যাচ্ছে। তার কোমরে তোয়ালে জড়ানো। মুখ আনন্দে ঝলমল করছে।
‘তোমাকে দেখে এত আনন্দ হচ্ছে হিমু ভাই। মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলব।’
‘তুই মনে হচ্ছে নাগা সন্ন্যাসীর পথ ধরে ফেলেছিস।’
‘তুমি একবার বলেছিলে না—সব ত্যাগ করতে হবে। আসল জিনিস পেতে হলে সর্বত্যাগী হতে হবে। পোশাক-পরিচ্ছদও ত্যাগ করতে হবে।’
‘বলেছিলাম না-কি?’
‘হ্যাঁ বলেছিলে।’
‘ঐ স্টেজে তো ঝপ করে যাওয়া যায় না। ধাপে ধাপে উঠতে হয়। ব্যাপারটা হল সিঁড়ির মত।লম্বা সিঁড়ি। সিঁড়ির ধাপ পার হয়ে উঠতে হয়। ফস করে জামা—কাপড় খুলে নেংটা হওয়াটা কোন কাজের ব্যাপার না।’
‘শার্ট-প্যান্ট পরে ফেলব?’
‘অবশ্যই পরে ফেলবি। ইউনিভাসিটি খোলা না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আজ ক্লাস আছে?’
‘আছে।’
‘জামা-কাপড় পড়ে ক্লাসে যা। সাবধানর প্রক্রিয়া শিখিয়ে দেব। আস্ত আস্তে উপরে উঠতে হয়। কাউকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। তুই নেংটা হয়ে বসে আছিস—আর এদিকে বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। এইভাবে সাধনা হয়?’
‘ঠিকই বলেছ। ইউনির্ভাসিটিতে যেতে বলছ?’
‘অবশ্যই।’
‘আমার ইউনির্ভাসিটিতে যেতে একেবারেই ইচ্ছা করে না।’
‘কি ইচ্ছা করে?’
‘সারাক্ষণ ইচ্ছা করে তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকি। তোমার সঙ্গে পথে পথে হাঁটি।’
‘পাশাপাশি দু’ভাবে থাকা যায়। স্থুলভাবে থাকা যায়। এই যেমন তুই আর আমি এখন পাশাপাশি বসে আছি। আবার সূক্ষ্মভাবে—চেতনার ভেতরও থাকা যায়। তুই যেই ভাববি আমার সঙ্গে আছিস, অম্নি তুই আমার পাশে চলে এসেছিস। সাধারণ মানুষ স্থুল অর্থেই জীবনকে দেখে। এতেই তারা সন্তুষ্ট। তুই নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ হতে চাস না?’
‘না।’
‘ভেরী গুড। যা, ইউনির্ভাসিটিতে চলে যা।’
‘আচ্ছা যাচ্ছি। হিমু ভাই, তুমি কি আমার একটা রিকুয়েস্ট রাখবে? জাস্ট ওয়ান।’
‘তোর একটা না, এক লক্ষ রিকোয়েস্ট রাখব। বলে ফেল।’
‘ইরা মেয়েটাকে একটা শিক্ষা দেবে? কঠিন একটা শিক্ষা!’
‘সে কি করেছে?’
‘তোমাকে নিয়ে শুধু হাসাহাসি করে। রাগে আমার গা জ্বলে যায়।’
‘সামান্য ব্যাপারে গা জ্বললে হবে কেন?’
‘আমার কাছে সামান্য না। কেউ তোমাকে কিছু বললে আমার মাথা খারাপের মত হয়ে যায়। হিমু ভাই, তুমি ইরাকে একটা শিক্ষা দাও। ওকে শিক্ষা দিতেই হবে।’
‘কি শিক্ষা দেব?’
‘ওকেও তুমি হিমু বানিয়ে দাও। মহিলা হিমু, যেন সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে।’
‘মেয়েমানুষ হয়ে রাত-বিরাতে রাস্তায় হাঁটবে।এটা ঠিক হবে না। তাছাড়া এমন একজন ভাল ছাত্রী!’
‘বেশ তাহলে তুমি তাকে এক রাতের জন্যে হিমু বানিয়ে দাও। জাস্ট ফর ওয়ান নাইট।’
‘দেখি।’
‘না, দেখাদেখি না। তোমাকে বানাতেই হবে ।তুমি ইচ্ছা করলেই হবে।’