দুপুরের দিকে আমি আমার পুরানো মেসে গেলাম। বদরুল সাহেবের খোঁজ নেয়া দরকার। চাকরির কিছু হয়েছে কি—না।হবার কোন সম্ভাবনা আমি দেখছি না, তবে বদরুল সাহেবের বিশ্বাস থেকে মনে হচ্ছে, হয়ে যেতেও পারে। মানুষের সবচে’ বড় শক্তি তার বিশ্বাস।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর বদরুল সাহেব দরজা খুললেন। তাঁর হাসি-খুশি ভাব আর নেই। চোখ বসে গেছে। এই দুদিনেই মনে হয় শরীর ভেঙে পড়েছে। তাঁর গোলগাল মুখ কেমন লম্বাটে দেখাচ্ছে।
‘বদরুল সাহেবের খবর কি?’
‘খবর বেশি ভাল না, হিমু ভাই।’
‘কেন বলুন তো?’
‘আমার স্ত্রীর শরীরটা খুব খারাপ। ছোট মেয়ের চিঠি গত পরশু পেয়েছি। চিঠি পাওয়ার পর থেকে খেতেও পারছি না, ঘুমুতেও পারছি না।’
‘ঢাকায় পড়ে আছেন কেন? আপনার চলে যাওয়া উচিত না?’
‘ইয়াকুব আগামীকাল বিকেলে দেখা করতে বলেছে, এই জন্যেই যেতে পারছি না।’
‘শেষ পর্যন্ত তাহলে আপনাকে চাকরি দিচ্ছে?’
‘জ্বি।চাকরিটাও তো খুব বেশি দরকার। চাকরি না পেলে সবাই না খেয়ে মরব। আমি খুবই গরিব মানুষ, হিমু ভাই।কত শখ ছিল স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে একসঙ্গে থাকব। অর্থের অভাবে সম্ভব হয় নাই। একবার মালীবাগে একটা বাসা প্রায় ভাড়া করে ফেলেছিলাম। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট। বারান্দা আছে। রান্নার একটা জায়গা আছে। সামনে বড় আমগাছ। ডালে দোলনা বাঁধা। এত পছন্দ হয়েছিল। ভেবেছিলাম কষ্ট করে কোনমতে থাকব। এরা ছয় মাসের ভাড়া এ্যাডভান্স চাইল। কোথায় পাব ছয় মাসের এ্যাডভান্স, বলুন দেখি।’
‘তা তো বটেই।’
‘হিমু ভাই, ছোট মেয়ের চিঠিটা একটু পড়ে দেখেন।’
মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে। কিন্তু চিঠি পড়লে মনে হয় না। মনে হয় কলেজে পড়া মেয়ের চিঠি। দু’টা বানান অবশ্য ভুল করেছে।
চিঠি পড়লাম।
আমার অতি প্রিয় বাবা,
বাবা, মা’র খুব অসুখ করেছে। প্রথমে বাসায় ছিল, তারপর পাশের বাড়ির মজনু ভাইয়া মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ডাক্তাররা বলেছে ঢাকায় নিয়ে যেতে। বাসায় সবাই কান্নাকাটি করছে।
তুমি কোন টাকা পাঠাও নাই কেন বাব? মা প্রথম ভেবেছিল পোস্টপিসে টাকা আসেনি। রোজ পোস্টপিসে খোঁজ নিতে যায়। তারপর মা কোথকে যেন শুনল তোমার চাকরি চলে গেছে।
বাবা, সত্যি কি তোমার চাকরি চলে গেছে? সবার চাকরি থাকে, তোমারটা চলে গেলো কেন? তোমার চাকরি চলে যাবার কথা শুনে মা বেশি কান্নাকাটি করেনি, কিন্তু বড় আপা এমন কান্না কেঁদেছে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। বড় আপা কাঁদে আর বলে—“আমার এত ভাল বাবা! আমার এত ভাল বাবা!” আমি বেশি কাঁদিনি, কারণ আমি জানি, তুমি খুব একটা ভাল চাকরি পাবে। কারণ আমি নামাজ পড়ে দোয়া করছি।বাবা, আমি নামাজ পড়া শিখেছি। ছোট আপা বলেছে আত্তাহিয়াতু ছাড়া নামাজ হয় না। ঐ দোয়াটা এখনো মুখস্থ হয় নাই। এখন মূখস্থ করছি। মূখস্থ হলে আবার তোমার চাকরির জন্যে দোয়া করব।
বাবা, মা’র শরীর খুব খারাপ। এত খারাপ যে তুমি যদি মাকে দেখ চিনতে পারবে না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো বাবা।
ইতি তোমার অতি আদরের ছোট মেয়ে
জাহেদা বেগম
ক্লাস সিক্স
রোল নং ১
‘চিঠি পড়েছেন হিমু ভাই?’
‘জ্বি।’
‘মেয়েটা পাগলী আছে; চিঠির শেষে সব সময় ক্লাস, রোল নং কত লিখে দেয়। ফার্স্ট হয় তো, এই জন্যে বোধহয় লিখতে ভাল লাগে।’
‘ভাল লাগারই কথা।’
‘দু্’টা বানান ভুল করেছে লক্ষ্য করেছেন? খোঁজ আর মুখস্থ। মুখস্থ দীর্ঘ উকার দিয়ে লিখেছে। কাছে থাকি না, কাছে থাকলে যত্ন করে পড়াতাম। সন্ধ্যাবেলা নিজের ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসার আনন্দের কি কোন তুলনা আছে? তুলনা নাই। সবই কপাল।’
‘বদরুল সাহেব।’
‘জ্বি হিমু ভাই।’
‘আগামীকাল পাঁচটায় সময় আপনার ইয়াকুব সাহেবের কাছে যাবার কথা না?’
‘জ্বি।’
‘আমি ঠিক চারটা চল্লিশ মিনিটে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। আমিও যাব আপনার সঙ্গে। আপনার বন্ধু আবার আমাকে দেখে রাগ করবে না তো?’
‘জ্বি না, রাগ করবে না। রাগ করার কি আছে। সে যেমন আমার বন্ধু, আপনিও সে রকম আমার বন্ধু। আপনি সঙ্গে থাকলে ভাল লাগবে। চাকরির সংবাদ একসঙ্গে পাব। দুঃখ ভাগাভাগি করতে ভাল লাগবে। চাকরির সংবাদ একসঙ্গে পাব। দুঃখ ভাগাভাগি করতে ভাল লাগে না ভাই সাহেব, কিন্তু আনন্দ ভাগাভাগি করতে ভাল লাগে।’
‘ঠিক বলেছেন। দুপুরে কিছু খেয়েছেন?’
‘জ্বিনা।’
‘আসুন, ভাত খেয়ে আসি।’
‘কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না, এম্নিতেই মেয়ের চিঠি পড়ে মনটা খারাপ, তার উপরে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে—মনটা ভেঙে গেছে।’
‘কি ঘটনা?’
‘বলতে লজ্জা পাচ্ছি, হিমু ভাই।’
‘লজ্জা পেলে বলার দরকার নেই।’
‘না, আপনার কাছে কোন লজ্জা নেই। আপনি শুনন—ফার্মগেটে গিয়েছি—হঠাৎ দেখি রশিদ। আবদুর রশীদ। নগ্ন। শুধু কোমরে একটা গামছা। এর-তার কাছে যাচ্ছে আর বলছে—একটা লুঙ্গি কিনে দিতে।’
‘আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘জ্বি-না। ও যেন আমাকে দেখতে না পায় এই জন্যে পালিয়ে চলে এসেছি। তারপর নিজের একটা লুঙ্গি, একটা শার্ট নিয়ে আবার গেলাম। তাকে পাইনি। মানুষের কি অবস্থা দেখেছেন হিমু ভাই?’
‘জ্বি দেখলাম!’
‘ইয়াকুবের কাছ থেকে ও চাকরির কথা বলব বলে ভাবছি।’
‘আগে নিজেরটা হোক তারপর বলবেন।’
‘রশীদকে দেখে এত মনটা খারাপ হয়েছে।’
‘আপনি তাহলে দুপুরে কিছু খাবেন না?’
‘জ্বি না।’
‘তাহলে আমি উঠি। আগামী কাল চাকরির খবরটা নিয়ে আমার এক কাজ করব। সরাসরি আপনার দেশের বাড়িতে চলে যাব।’
‘সত্যি যাবেন হিমু ভাই?’
‘যাব।’
‘আপনার ভাবীর শরীরটা খারাপ, আপনাকে যে চারটা ভাল-মন্দ রেঁধে খাওয়াবে সে উপায় নেই।’
‘শরীর ঠিক করিয়ে ভাল-মন্দ রাঁধিয়ে খেয়ে তারপর আসব। ভাবী সবচে’ ভাল রাঁধে কোন জিনিসটা বলুন তো?’
‘গরুর গোশতের একটা রান্না সে জানে। অপূর্ব! মেথিবাটা দিয়ে রাঁধে। পুরো একদিন সিরকা-আদা-রসুনের রসে মাংস ডুবিয়ে রাখে, তারপর খুব অপ্ল আচেঁ সারদিন ধরে জ্বাল হয়। বাইরে থেকে এক ফোঁটা পানি দেয়া হয় না…কি যে অপূর্ব জিনিস ভাই সাহেব!’
‘ঐ মেথির রান্নাটা ভাবীকে দিয়ে রাঁধতে হবে।’
‘অবশ্যই অবশ্যই। পোনা মাছ যদি পাওয়া যায় তাহলে আপনাকে এমন এক জিনিস খাওয়াবো, এই জীবনে ভূলবেন না। কচি সজনে পাতা বটে পোনা মাছের সৃঙ্গে রাঁধতে হয়। কোন মসলা না, কিছু না, দু’টা কাঁচামরিচ, এক কোয়া রসুন, একটু পেয়াজ। এই দেখুন বলতে বলতে জিবে পানি এসে গেলো।’
‘জিবে পানি যখন এসে গেছে চলুন, খেয়ে আসি।’
‘জ্বি আচ্ছা, চলুন। আপনি দেশে যাবেন ভাবতেই এত ভাল লাগছে।’
মেস থেকে বেরুবার মুখে ম্যানেজার হায়দার আলী খাঁ বললেন, স্যার, আপনি মেসে ছিলেন না, আপনার কাছে ঐ মেয়েটা দু’বার এসেছিল।
‘ইরা?’
‘জ্বী, ইরা। উনার বাসায় যেতে বলেছে। খুব দরকার।’
‘জানি। আমার ঐ মেয়ের দেখা হয়েছে। ঐ মেয়ে যদি আবার আসে বলবেন get lost.’
‘স্যার, কি বলব?’
‘বলবেন get lost.কঠিন গলায় বলবেন।’
‘জ্বি, আচ্ছা।’
হায়দার আলী খাঁ পিরিচে চা খাচ্ছিল: আবারো সারা শরীরে চা ফেলে দিল। এই মানুষটা আমাকে এত ভয় পায় কেন কে জানে।
এবং হিমু – ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ (শেষ)
রাতের অনিদ্রাজনিত ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা ও আতংক ভোরবেলা একটা ‘হট শাওয়ার’ দিয়ে রেশমা খালা দুর করে দেন। গোসলের পর তিনি পরচুলাটা মাথায় দেন। খানিকটা সাজগোজ করে আমার ঘরে এসে বললেন, কি রে হিমু, জেগেছিস? গুড মর্নিং।
আমিও বলি, গুড মর্নিং খালা।
‘চা দিতে বলেছি। হাত-মুখ ধুয়ে আয়।’
‘তোমাকে তো আজ দারুণ লাগছে। কপালে টিপ দিয়ে বয়স দশ বছর কমিয়ে ফেলেছ। এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার বয়স বাহান্ন।’
খালা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, আমার বয়স তো আসলেই বাহান্ন।
‘ও সরি!’
‘হিমু, তোর ঠাট্টা-ফাজলামি আমার ভাল লাগে না। সাজগোজ সামান্য করি—তাতে কি? দু’দিন পরে তো মরেই যাব। কবরে গিয়ে তো সাজতে পারব না। কবরে তোরা তো আর ক্রীম, লিপস্টিক দিয়ে আসবি না।’
‘সেটা খাঁটি কথা।’
‘বয়সকালে সাজতে পারিনি। এমন এক লোকের হাতে পড়েছিলাম যার কাছে সাজা না-সাজা এক। তাকে একবার ভাল একটা ক্রীম আনতে বলেছিলাম, সে দেশী তিব্বত ক্রীম নিয়ে চলে এসেছে। তারপরেও আফসোস-এত নাকি দাম।’
‘এখন তো পুষিয়ে নিচ্ছ।’
‘তা নিচ্ছি। আয়, চা খাবি। আজ ইংলিশ ব্রেকফাস্ট।’
‘চমৎকার!’
চায়ের টেবিলে রেশমা খালাকে বললাম, খালা, অদ্য শেষ সকাল।
খালা বললেন, তার মানে কি?
‘তার মানে হচ্ছে নাশতা খেয়েই আমি ফুটছি।’
‘ফুটছি মানে কি?’
‘ফুটছি মানে বিদেয় হচ্ছি। লম্বা পা ফেলে পগারপার।’
‘আশ্চার্য কথা! চলে যাবি কেন? চলে যাবি কেন? এখানে কি তোর কোন অসুবিধা হচ্ছে?’
‘কোনই অসুবিধা হচ্ছে না। বরং সুবিধা হচ্ছে। আমার ভুড়ি গজিয়ে গেছে।
“মেদ-ভুড়ি কি করি”-ওয়ালাদের খুঁজে বের করতে হবে।’
‘ঠাট্টা করবি না হিমু।খবর্দার, ঠাট্টা না।’
‘আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না খালা। চা খেয়েই আমি ফুটব।’
খালা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আমার এই ভয়ংকর অবস্থা দেখেও তোর দয়া হচ্ছে না? রাতে এক ফোঁটা ঘুমুতে পারি না। ঐ বদমায়েশ লোকটার যন্ত্রনায় মাঝে মাঝে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে। আর তুই চলে যাবি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, খালু সাহেব কি কালও এসেছিল? গতকাল তো তার আসার কথা না।
‘আমার সঙ্গে কথা হয়েছে।’
খালা হতভম্ব হয়ে বললেন, তোর সঙ্গে কথা হয়েছে?
‘হুঁ।’
‘হুঁ-হ্যাঁ করিস না, ঠিকমত বল।তুই দেখেছিস?’
‘হুঁ।’
‘আবার হুঁ? আরেকবার হুঁ বললে কেতলির সব মাথায় ঢেলে দেব। কখন দেখা হল?’
‘কাল রাত ন’টার দিকে।’
‘বলিস কি!’
‘তুমি রাতে খাওয়ার জন্যে ডাকলে। আমি ঘর থেকে বেরুব। স্যান্ডেল খোঁজার জন্যে নিচু হয়ে দেখি, উনি ঘাপটি মেরে খাটের নিচে বসে আছেন।’
‘তোর খাটের নিচে ও বসবে কিভাবে? তোর খাটটা হল বক্স খাট। বক্স খাটের আবার নিচ কি?’
‘ঠিক নিচ না, বলতে ভুল করেছি। খাটের সাইডে।’
‘গায়ে কাপড়-চোপড় ছিল?
‘উহুঁ।’
‘তুই দেখে ভয় পেলি না?’
‘ভয় পাব কেন? জীবিত অবস্থায় উনার সঙ্গে আমার ভাল খাতির ছিল। একবার হেঁটে হেঁটে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছি। তিনি তাঁর প্রাইভেট রিকশায় যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে রিকশা থামিয়ে তুলে নিলেন।পথে এক জায়গায় আখের সরবত বিক্রি হচ্ছিল।রিকশা থামিয়ে আমরা আখের সরবত খেলাম। তারপর খালু সাহেব আইসক্রীম কিনলেন। খেতে খেতে আমারা তিনজন যাচ্ছিলাম।’
‘তিনজন হল কিভাবে?’
‘রিকশাওয়ালাও খাচ্ছিল। তিনজন মিলে রীতিমত এক উৎসব। বুঝলে খালা, তখনই বুঝলাম উনি একজন অসাধারণ মানুষ। প্রায় মহাপুরুষ পর্যায়ের। ব্যবসায়ীরাও মহাপুরুষ হতে পারে কোনদিন ভাবিনি।’
‘তুই এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে যাচ্ছিস। আসল কথা বল। খাটের নিচে ও বসেছিল?’
‘খাটের নিচে না, সাইডে।’
‘তারপর?’
‘আমি বললাম, খালু সাহেব, কেমন আছেন?’
‘সে কি বলল?’
‘কিছু বললেন না। মনে হল লজ্জা পেলেন। তখন আমি বেশ রাগ রাগ ভাব নিয়ে বললাম—আপনার মত একটা ভদ্রলোক…মেয়েছেলেকে ভয় দেখাচ্ছেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে? ভয় দেখানোর মধ্যেও তো শালীনতা, ভদ্রতা আছে। নেংটা হয়ে ভয় দেখানো। তাও নিজের স্ত্রীকে! ছিঃ ছিঃ।’
‘তুই কি সত্যি এইসব বলেছিস?’
‘হ্যাঁ বললাম। উনি আমার কথায় লজ্জা পেলেন খুব। মাথা নিচু করে ফেললেন। আমার তখন মনটা একটু খারাপ হল। আমি বললাম, এসব করছেন কেন?’
‘সে কি বলল?’
‘কথাবার্তা তাঁর খুব পরিষ্কার না। অস্পষ্ট। কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না। তবু যা বুঝেছি, উনি বললেন—তোর খালাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে এইসব করছি। শিক্ষা হয়ে গেলে আর করব না।’
রেশমা খালা ফস করে বললেন, শিক্ষা? কিসের শিক্ষা? আমি কি করেছি যে সে আমাকে শিক্ষা দেবে? সারাজীবন যন্ত্রণা করেছে। মরার পরেও যন্ত্রণা দিচ্ছে। আর কিছু না। লোকটা ছিল হাড় বদমাশ।
আমিও খালু সাহেবকে এই কথাই বললাম। শুধু বদমাশটা বললাম না। তখন খালু সাহেব বললেন, তুমি আসল ঘটনা জান না। তোমার খালা আমাকে বিষ খাইয়েছিল।
‘এত বড় মিথ্যা কথা আমার নামে? এত সাহস? ব্যথায় তখন ওর দম যায়-যায় অবস্থা। আমার মাথার নেই ঠিক—দৌড়ে অষুধ নিয়ে এনে খাওয়ালাম।’
‘ইচ্ছা করে তো খাওয়াইনি। ভয়ে আমার মাথা এলোমেলো।’
‘আমিও খালু সাহেবকে তাই বললাম। আমি বললাম—এটা অনিচ্ছাকৃত একটা ভূল। রেশমা খালা মানুষ খুন করার মত মহিলাই না। অতি দয়ার্দ্র মহিলা।’
‘এটা শুনে কি বলল?’
‘খিক খিক করে অনেকক্ষণ হাসল। তারপর আমি বললাম, এখনো তোমার প্রতি খালার গভীর ভালবাসা। তোমার স্মৃতি রক্ষার্থে “গনি মিয়া ইন্সটিটউট অব মর্ডান আট” করবে।’
‘শুনে কি বলল?’
‘শুনে বলল, এইসব যদি করে তাহলে লাথি মেরে মাগীর কোমর ভেঙে ফেলব। ভূত হবার পর খালু সাহেবের ভাষার খুবই অবনতি হয়েছে। স্ত্রীকে মাগী বলা জীবিত অবস্থায় উনার জন্যে অকল্পনীয় ছিল।’
রেশমা খালা এখন আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন না। স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন। চোখের দৃষ্টি আগের মত না—অন্যরকম। ‘আমি খালু সাহেবকে বললাম, যা হবার হয়েছে। মাফ করে দেন। ক্ষমা যেনম মানবধর্ম, তেমনি ক্ষমা হচ্ছে ভূতধর্ম। উনি এক শর্তে ক্ষমা করতে রাজি হয়েছেন।’
‘শর্তটা কি?
‘শর্তটা হচ্ছে—তুমি তাঁর সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি দান-খয়রাত করবে। স্কুল-কলেজে দিবে, এতিমখানা করবে, তাঁর দরিদ্র সব আত্মীয়স্বজনদের সাহায্য করবে। তাহলেই তিনি আর তোমাকে বিরক্ত করবেন না।’
‘হিমু!’
‘জ্বি খালা।’
‘তুই অসম্ভব বুদ্ধিমান। তুই কিছুই দেখিসনি। কারো সঙ্গেই তোর কথা হয়নি। পুরোটা আমাকে বানিয়ে বানিয়ে বলছিস।অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলি—ঢিল লেগে গেছে। কথা দিয়ে তুই আমাকে প্যাঁচে ফেলেছিস। তোর ধারণা তোর কথা শুনে তার কোটি কোটি টাকা আমি দান-খয়রাত করে নষ্ট করব? রাতে ভূত হয়ে আমাকে ভয় দেখায়, তাকে কি হয়েছে? দেখাক যত ইচ্ছা। বদমায়েশের বদমায়েশ!’
‘চুপ থাক হারামজাদা!।’
‘বিশ্বাস করুন উনাকে দেখেছি, এবং আপনি যে উনাকে মেরে ফেলেছেন এটা উনি ইশারায় আমাকে বোঝালেন। উনি কোন কথা বলেননি। ভূতদের সম্ভবত কথা বলার ক্ষমতা থাকে না।’
‘চুপ হারামজাদা—শূওরের বাচ্চা। চুপ!’
রেশমা খালা ভয়ানক হৈ-চৈ শুরু করলেন। বাবুর্চি, দারোয়ান, মালী সবাই ছুটে এল। রেশমা খালা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, এই চোরটাকে লাথি মেরে বের করে দাও।
রেশমা খালার কর্মচারীরা ম্যাডামের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। শুধু লাথিটা দিল না। লাথির বদলে এমন গলাধাক্কা দিল যে রাস্তায় উল্টে পড়তে পড়তে কোনমতে রক্ষা পেলাম। খালার বাড়িতে আমার রেক্সিনের একটা ব্যাগ রয়ে গেল।ব্যাগের ভেতর আমার ইহজাগতিক যাবতীয় সম্পদ। দু’টা শার্ট, একটা খুব ভাল কাশ্মীর শাল। শালটা রুপা আমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল। আমি হতদরিদ্র মানুষ হলেও বুকে হাত দিয়ে একটা কথা বলতে পারি—ঢাকা শহরে এমন দামী শাল আর কারোরই নেই।
গলাধাক্কার ভেতরে যে দিন শুরু হয়েছে সেই দিনের শেষটা কেমন হবে ভাবতেই আতংক লাগে। বিকেলে বদরুল সাহেবকে নিয়ে ইয়াকুব নামক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের কাছে যাবার কথা। সেখানে কোন নাটক হবে কে জানে।
রুপার সঙ্গে আজ সকালের মধ্যেই আমার দেখা করা দরকার। একামত্র সেই পারে একদিনের নোটিশে বদরুল সাহেবের জন্যে চাকরির ব্যবস্থা করতে। টেলিফোনে রুপার সঙ্গে কথা বলব—না সরাসরি তার বাড়িতে উপস্থিত হব, বুঝতে পারছি না। বাদলদের বাড়িতেও একবার যাওয়া দরকার।বাদল এমন কি করছে যে ইরাকে বার বার আমার খোঁজ যেতে হচ্ছে? রুপাকে বাদলদের বাসা থেকেও টেলিফোন করা যায়।