বিস্ময়কর ব্যাপার হল—ফুপার বাড়ির প্রতিটি বাতি জ্বলছে। কোন একটা সমস্যা নিশ্চয়ই হয়েছে।আমি সেই সমস্যায় উপস্থিথ হয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলব—‘ভাত খাব’। সেই বলাটাও সমস্যা। আজ বোধহয় কপালে ভাত নেই। পুলিশের থাপ্পড় খেয়েই রাত পার করতে হবে। আমি কলিংবেলে হাত রাখলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজা খুলে গেল। বড় ফুপা তাঁর ফর্সা ছোটখাট মুখ বের করে ভীত চোখে আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, আরে তুই? হিমু? আয় আয়, ভেতরে আয়। এই শোন, হিমু এসেছে, হিমু।
সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সবাই এক সঙ্গে নেমে আসছে। কিছুক্ষণ আগে পুলিশকে ভড়কে দিয়ে এখন নিজেই ভড়কে যাচ্ছি।
গ্রীলের দরজা খুলতে খুলতে বড় ফুপা বললেন, কেমন আছিস রে হিমু?
‘ভাল আছি।’
বাড়ির অন্যরাও চলে এসেছে। আঠারো-উনিশ বছরের একজন তরুণীকে দেখা যাচ্ছে। তরুণী এমনভাবে আমাকে দেখছে যেন আমি আসলে আগ্রার তাজমহল। হেঁটে মালিবাগে চলে এসেছি। ফুপা বললেন, হেন জায়গা নেই তোকা খোঁজা হয়নি। কোথায় ছিলি?
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলাম। নির্বিকার ভঙ্গি ঠিক ফুটল না। আমার জন্যে এই পরিবারটি প্রবল আগ্র্রহের আসল কারণটা না জানলে সহজ হওয়া যাচ্ছে না। সামথিং ইজ রং, ভেরি রং। বাদল আবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। ওর কোন খোঁজ না পেয়ে আমাকে খোঁজা হচ্ছে, যদি আমি কোন সন্ধান বের করে দিই—এই হবে। এ ছাড়া আমার জন্যে এত ব্যস্ততার দ্বিতীয় কোন কারণ হতে পারে না। আমি এ বাড়ির নিষিদ্ধজন। শুধু আমি নিষিদ্ধ নই, আমার ছায়াও নিষিদ্ধ।
আমি ফুপুর দিকে তাকিয়ে বললাম, বাদল কোথায়? বাদলকে তো দেখছি না। শুয়ে পড়েছে?
ফুপা-ফুপ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। ফুপা বললেন, ও ঘরেই আছে।
‘অসুক-বিসুক?’
‘না। হিমু তুই বোস, তোর সঙ্গে কথা আছে। চা খাবি?’
‘চা অবশ্যই খাব, তবে ভাত-টাত খেয়ে তারপর খাব। ফুপু, রাতে রান্না কি করেছেন? লেফট ওভার নিশ্চয় ডীপ ফ্রীজে রেখে দিয়েছেন?’
ফুপু গম্ভীর গলায় বললেন, আর রান্না-বান্না! দুদিন ধরে ঘরে হাড়ি চড়ছে না।
‘ব্যাপারটা কি?’
ফুপা গলা পরিষ্কার করছেন। যেন অস্বস্তির কোন কথা বলতে যাচ্ছেন। ব্যাটারী চার্জ করে নিতে হচ্ছে।
‘বুঝলি হিমু, আমাদের উপর দিয়ে বিরাট একটা বিপদ যাচ্ছে। হয়েছে কি, বাদল তার বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়েছিল। ঐ বিয়ে খেতে গিয়েই কাল হয়েছে—গলায় কাঁটা ফুটেছে।’
‘খাসির রেজালা খেয়ে কাঁটা ফুটবে কি? গলায় হাড় ফুটতে পারে।’
‘কাঁটাই ফুটেছে। বেশি কায়দা করতে গিয়ে ওরা বাঙালী বিয়ের আয়োজন করেছে—মাছ, ভাত, ডাল দৈ…ফাজিল আর কি, বেশি বেশি বাঙালী।’
‘বাদলের গলার সেই কাঁটা এখন আর বেরুচ্ছে না?’
‘না।’
‘ডাক্তার দেখাননি?’
‘ডাক্তার দেখাব না। বলিস কি? হেন ডাক্তার নেই যাকে দেখানো হয়নি। আজ সকালেও একজন ই এন টি স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম—হা করিয়ে, চিমটা ঢুকিয়ে নানা কসরত করেছে। কাঁটা অনেক নিচে, চিমটা দিয়ে ধরতে পারছে না। দু’দিন ধরে বাদল খাচ্ছে না, ঘুমুচ্ছে না। কি যে বিপদে পড়েছি!’
‘বিপদ তো বটেই।’
‘কাঁটা তোলার একটা দোয়া আছে ‘নিয়ামুল কোরানে’ ঐ দোয়াও তোর ফুপু এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার পড়েছে। কিছুই বাদ নেই।’
‘বিড়ালের পায়ে ধরানো হয়েছে?’
তরুণী মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠল। পরক্ষণেই শাড়ির আচঁল মুখে চেপে হাসি থামানোর চেষ্টা করল। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হাসবে না। গ্রাম বাংলার মানুষ গত পাচঁশ বছর ধরে কাঁটা ফুটলেই বিড়ালের পায়ে ধরছে। কাজেই এর একটা গূরুত্ব আছেই। কাঁটা হচ্ছে বিড়ালের খাদ্য। আমরা সেই খাদ্য খেয়ে বিড়ালের প্রতি একটা অবিচার করছি, সেই জন্যে বিড়ালের পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা।
ফুপা থমথমে গলায় বললেন, বিড়ালের পায়েও ধরানো হয়েছে। সেও এক কেলেংকারি। বিড়াল খামচি দিয়ে রক্ত –টক্ত বের করে বিশ্রী কাণ্ড করেছে। এটিএস দিতে হয়েছে। এখন একটা ব্যবস্থা করে দে।
‘আমি?’
‘হু। বাদলের ধরণা একমাত্র তুই-ই পারবি, আর কেই পারবে না। তোর ফুপা ওকে কোলকাতায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ও তার সঙ্গে দেখা করে যাবে না। হেন জায়গা নেই যে তোর খোঁজ করা হয়নি। তোকে হঠাৎ আসতে দেখে বুকে পানি এসেছে। দুটা দিন গেছে—ছেলে একটা-কিছু মুখে দেয়নি। আরো কয়েকদিন এরকম গেলে তো—মরে যাবে।’
ফুপুর কথা শেষ হবার আগেই বাদল ঘরে ঢুকল। চুল উসকু-খুসকু, চোখ বসে গেছে। ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছে না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, খবর কি রে?
বাদল ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল। সাহিত্যের ভাষায় এই হাসির নাম—‘করুণ হাস্য’।
‘আমি বললাম, কিরে, শেষ পর্যন্ত মাছের হাতে পরাজিত?’
বাদল তার মুখ আরো করুণ করে ফেলল। আমি বললাম, বসে থাক, ব্যবস্থা করছি। গোসল-টোসল করে খাওয়া-দাওয়া করে নেই, তারপর তোর প্রবলেম ট্যাকল করছি।
বাদলের মুখ মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে গেলো। তরুণী মেয়েটির ঠোঁটের কোনায় ব্যঙ্গের হাসির আভাস। তবে সে কিছু বলল না। এ বাড়ির পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ আমার অনুকুলে। এ রকম অনুকুল আবহাওয়ার সুযোগ গ্রহণ না করা নিতান্তই অন্যায় হবে। আমি ফুপুর দিকে তাকিয়ে বললাম, গোসল করব। ফুপু, আপনার বাথরুমে হট ওয়াটারের ব্যবস্থা আছে না?
‘গীজার নষ্ট হয়ে গেছে। যাই হোক, পানি গরম করে দিচ্ছি। গোসল করে ফেল। গোসল করে ভাত খাবি তো?’
‘হুঁ।’
‘তাহলে ভাত-টাত যা আছে গরম করতে দেই।’
‘ঘরে কি পোলাওয়ের চাল আছে?’
‘আছে।’
‘তাহলে চট করে পোলাওয়ের কিছু চাল চড়িয়ে দিন। আলু ভাজা করুন। কুচি কুচি করে আলু কেটে ডুবা-তেলে কড়া করে ভাজা। গরম ভাত, আলু ভাজার সঙ্গে এক চামচ গাওয়া ঘি—খেতে একসেলেন্ট হবে। গাওয়া ঘি আছে তো?’
‘ঘি নেই।’
‘মাখন আছে?’
‘হুঁ।’
‘অল্প করে আঁচে মাখন ফুটাতে থাকেন। যেটা বের হবে ফেলে দেবেন—এক্কেবারে এক নম্বর পাতে খাওয়া ঘি তৈরি হবে। কয়েকটা শুকনা মরিচ ভাজবেন—ঘিয়ের মধ্যেই ভাজবেন।’
‘বাদলের কাঁটাটার কিছু করা যায় কি-না দেখ।’
‘দেখব। সে দু’দিন যখন অপেক্ষা করেছে আরো ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করতে পারবে। পারবি না বাদল?’
বাদল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মনে হচ্ছে কথা বলার মত অবস্থাও তার না।
আমি আরেকবার শিষ দিয়ে বাজালাম—হায় আপনা দিল…। তরুণী মেয়েটি আমার দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টিটা কেমন? ভাল না। সেই দৃষ্টিতে কৌতূহল আছে। শুদ্ধ কৌতুহল না, অশুদ্ধ কৌতুহল। মেয়েটি একটা দৃশ্য দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে—সে দৃশ্য হচ্ছে অতি চালাক একজন মানুষের গলায় দড়ি পড়ার মজাদার দৃশ্য। পুলিশের মত এই মেয়েটাকেও ভড়কে দিতে পারলে ভাল লাগত, পারছি না। মেয়েরা পুলিশের মত এত সহজে ভড়কে না। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার নাম কি?
‘ইরা।’
‘শোন ইরা, তোমার যদি কোন কাঁটার ব্যাপার থাকে, গলায় কাঁটা বা হৃদয়ে কাঁটা তাহলে আমাকে বল, তোমার কাঁটার একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব।’
ইরা কঠিন গলায় বলল, আমার জন্যে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি গোসল করতে যান, আপনাকে গরম পানি দেয়া হয়েছে।
‘মেনি থ্যাংকস।’