ঘর থেকে বেরুবার জন্যে রাত বারোটা খুব ভাল সময়। জিরো-আওয়ার। কাউন্ট আপ শুরু হয় জিরো-আওয়ার থেকে—0,1,2,3,…ঠিক রাত বারোটায় কি বার হবে? শনিবার নয়, রবিবারও নয়। জিরো আওয়ারে বার থেমে থাকে।
দরজা তালাবন্ধ করে বেরুচ্ছি, দেখি বদরুল সাহেব। কলঘর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরছেন। মুখ ভেজা, কাঁধে গামছা। রাত বারোটায় আমার মন-টন খুব ভাল থাকে। কাজেই আমি উল্লাসের সঙ্গেই বললাম,কি খবর বদরুল সাহেব।
তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলেন।
‘কোথায় ছিলেন আজ সারাদিন?’
তিনি আবারো হাসলেন। আমি বললাম, গিয়েছিলেন নামি ইয়াকুব আলির কাছে?
‘জ্বি।’
‘দেখা হয়নি?’
‘দেখা হয়েছে। অতিরিক্ত ব্যস্ত।’
‘কথা হয়নি?’
‘হয়েছে। চাকরির ব্যাপারটা বললাম।’
‘আগেও তো বলেছিলেন। আবার কেন?’
‘ভুলে গিয়েছে। নানান কাজকর্ম নিয়ে থাকে তো। আজকে তার আবার একটা দুঘর্টনা ঘটল। তার মনটা ছিল খারাপ।’
‘কি দুঘর্টনা?’
‘একুশ লাখ টাকা দিয়ে নতুন গাড়ি কিনেছে। সেই গাড়ির হেডলাইট ভেঙ্গে ফেলেছে। কেয়ারলেস ড্রাইভার। ঐ নিয়ে নানান হৈ-চৈ, ধমকাধমকি চলছে, তার মধ্যে আমি গিয়ে পড়লাম।’
‘আপনি ধমক খেয়েছেন?’
‘জ্বি-না, আমি ধমক খাব কেন? আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড। গাড়ির হেডলাইট ভাঙার কারণে ইয়াকুবের মন খারাপ দেখে আমারো মন খারাপ হল।এর মধ্যে চাকরির কথাটা তুলে ভুল করেছি।’
‘ইয়াকুব সাহেব রেগে গেছেন?’
‘তা ঠিক না। বলল বায়োডাটা তার সেক্রেটারির কাছে দিয়ে যেতে। দু’টা পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ বায়োডার্টা, সে দেখবে।’
‘দেখবে তো বটেই। স্কুল-জীবনের বন্ধু, ফেলবে কি করে? বায়োডাটা নিয়েই সারাদিন ছোটাছুটি করলাম। একদিনের মধ্যে ছবি তুলে, বায়োডাটা টাইপ করে , পাঁচটা সময় একেবারে ইয়াকুবের হাতেই ধরিয়ে দিয়েছি।’
‘ইয়াকুব সাহেব আপনার কর্মতৎপরতা দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হলেন।’
বদরুল চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, খুশি হননি?
‘জ্বি-না। একটু মনে হয় বেজার হয়েছে; সেক্রেটারির হাতে দিতে বলেছে, আমি তা না করে তার হাতেই দিলাম—এতে সামান্য বিরক্ত। এত বড় একটা অর্গানাইজেশন চালায়। তার তো একটা সিস্টেম আছে। হুট করে হাতে কাগজ ধরিয়ে দিলে হবে না। ভুলটা আমার।’
‘বদরুল সাহেব, আপনার কি ধারণা ইয়াকুব আলি আপনাকে চাকরি দেবেন?’
‘অবশ্যই। আমার সামনেই সেক্রেটারিকে ডেকে বায়োডাটা দিয়ে দিল। বলল উপরে আর্জেন্ট লিখে ফাইল রাখতে।’
‘কবে নাগাদ চাকরি হবে বলে মনে করছেন?’
‘খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ। ইয়াকুব আমাকে এক সপ্তাহ পরে খোঁজ নিতে বলেছে। আগামী শনিবারের মধ্যে ইনশাআল্লাহ হয়ে যাবে। স্বপ্নেও তা-ই দেখলাম।’
‘এর মধ্যে স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন?’
‘জ্বি। ছোটাছুটি করে কাগজপত্র জোগাড় করে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, একটু রেস্ট নেই। ইয়াকুবের পি. এ. বলল, বসুন চা খান। চা খাওয়ার জন্যে বসেছি। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনির মত এস গেল। তখন স্বপ্নটা দেখেছি। দেখলাম কি—ইয়াকুব এসেছে। তার হাতে বিরাট এক মৃগেল মাছ। এইমাত্র ধরা হয়েছে। ছটফট করছে। ইয়াকুব বলল, নিজের পুকুরের মাছ। তোর জন্যে আনলাম। নিয়ে যা। মাছ স্বপ্নে দেখা খুবই ভাল। হিমু ভাই, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’
‘হাঁটতে যাচ্ছি।’
‘রাতদুপুরে কেউ হাঁটটে যায়? আশ্চর্য! দুপুর রাতে হাঁটার মধ্যে আছে কি?’
‘চলুন, আমার সঙ্গে হেঁটে দেখুন।’
‘যেতে বলছেন?’
‘এক রাতে একটু অনিয়ম করলে কিছু হবে না।’
‘খুবই টায়ার্ড লাগছে হিমু ভাই। ভাবছি ঘুমুব।’
‘ঘুম তো আপনার আসবে না। খিদে পেটে শুয়ে ছটফট করবেন। এরচে’ চলুন কোথাও নিয়ে গিয়ে আপনাকে খাইয়ে আনি। মনে হচ্ছে সারাদিন কিছুই খাননি।’
‘সারাদিন খাইনি কি করে বুঝলেন?’
‘বোঝা যায়। মানুষের সব খাবার তার চোখে লেখা থাকে। ইচ্ছে করলেই সেই লেখা পড়া যায়। কেউ ইচ্ছে করে না বলে পড়তে পারে না।’
‘আপনি পারেন?’
‘মাঝে মাঝে পারি। সব সময় পারি না। আপনি যে সারাদিন খাননি এটা আপনার চোখে পড়তে পারছি। এই সঙ্গে আরেকটা জিনিশ পড়া যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে, আজ দিনটা আপনার জন্যে খুব আনন্দের।’
বদরুল সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। হতভম্ব ভাব কাটার পর বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আজ আমার বিবাহ বার্ষিকী। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যার সময় হঠাৎ মনে হয়েছে—আরে আজ তো ২৫শে এপ্রিল।
‘চলুন, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিয়ের দিনের গল্প করবেন। অনেকদিন কারো বিয়ের গল্প শুনি না।’
বদরুল সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, বলার মত কোন গল্প না।
‘সব গল্পই বলার মত।’
রাস্তায় নেমেই বদরুল সাহেব বিস্মিত স্বরে বললেন, হাঁটতে তো ভালই লাগছে। রাস্তাগুলি অন্য রকম লাগছে। আশ্চয় তো! ব্যাপারটা কি?
আমি ব্যাপার ব্যাখ্যা করলাম না। রাতের বেলা রাস্তার চরিত্র বদলে যায় কেন সেই ব্যাখ্যা একেক জনের কাছে একেক রকম। আমার ব্যাখ্যা আমার কাছেই থাকুক।
বদরুল সাবেহ বললেন, হাঁটতে হাঁটতে আমার কোথায় যাব?
আমি বললাম, মাথায় কোন নিদিষ্ট জায়গা থাকলে হাঁটার কোন আরাম থাকে না। হাঁটতে হবে এলোমেলোভাবে। বলুন কি ভাবে আপনাদের বিয়ে হল।
‘মুন্সিগঞ্জে বেড়াতে গিয়াছিলা। খালার শৃশুরবাড়িতে। ওদের একান্নবর্তী পরিবার। লোকজন গিজ গিজ করছে। কে কখন খায় ঠিক নেই। খাওয়া-দাওয়ার ভেতরে কোন যন্ত নেই। খেলে খাও, না খেলে খেও না ওই রকম ভাব। মাঝে মাঝে কি হয় জানেন? ভাল একটা পদ হয়ত রান্না হচ্ছে, এদিকে বেশির ভাগ মানুষ খেয়ে উঠে গেছে। কেউ জানেই না—মুল পদ এখনো রান্না হয় নি…
বদরুল সাহেব তার বিয়ের পল্পের জায়গায় খাওয়ার গল্প ফেদেঁ বসেছেন। এই খাওয়া-দাওয়ার ভেতর থেকে বিয়ের গল্প হয়ত শুরু হবে, কখন হবে কে জানে। ভদ্রলোকের সম্ভবত খিদেও পেয়েছে। খিদের সময় শুধু খাবার কথাই মনে পড়ে। তাঁকে খাওয়াতে কি ব্যবস্থা করা যায় বুঝতে পারছি না। আবার পকেটবিহীন পাঞ্জাবি নিয়ে বের হয়েছি। এই পাঞ্জাবি মনে হয় আর ব্যবহার করা যাবে না। বদরুল সাহেব গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন—সেদিন কি হয়েছে শুনুন। পাবদা মাছ এসেছে। এক খলুই মাছ, প্রত্যেকটা দেড় বিষং সাইজ। এ বাড়িতে আবার অল্প কিছু আসে না। যা আসে ঝুড়ি ভর্তি আসে…আমরা ফুল রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকলাম। বদরুল সাহেবের গল্পে বাধা পড়ল। আমরা টহল পুলিশের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। খাকি পোশাকের কারণে সব পুলিশ একরকম মনে হলেও এটি যে গতকালেরই দল এতে আমার কোন সন্দেহ রইল না। আমি আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললাম, কি খবর?
টহল পুলিশের দল থমকে দাঁড়াল।
‘আজ আপনাদের পাহারা কেমন চলছে?’
এই প্রশ্নেরও জবাব নেই। বদরুল সাহেব হক চকিয়ে গেছেন। কথাবার্তার ধরন ঠিক বুঝতে পারছেন না।
কালকের ওস্তাদজি আজও প্রথম কথা বললেন, তবে তুই-তোকারি না, ভদ্র ভাষা।
‘আপনারা কোথায় যান?’
‘ভাত খেতে যাই। আজ অবশ্যি আমি খাব না। এই ভদ্রলোক খাবেন। উনার নাম বদরুল আলম। উনাকে থাপ্পড় দিতে চাইলে দিতে পারেন। উনিও কিছু বুঝতে পারছি ন। কি সমস্যা?
‘কোন সমস্যা না। জনগনের সেবক পুলিশ ভাইরা এখন আপনার রাতের খাবার ব্যবস্থা করবেন।’
পুলিশ দলের একজন বলল, কালকের ব্যাপারটা মনে রাখবেন না। নানা কিসিমের বদলোক রাস্তায় ঘুরে, নেশা করে। আমরা বুঝতে পারি নাই। একটা মিসটেক হয়েছে।
‘আমি কিছু মনে করিনি । মনের ভেতর অতি সামান্য খচখচকি আছে, সেটা দুর হযে যাবে—যদি আপনারা বদরুল সাহেবের রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।’
‘এত রাতে?’
‘আপনাদের কারবারই তো রাতে। আপনাদের একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দি—কোন একটা বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল টিপুন। বাড়িওয়ালা দরজা খুলে এতগুলি পুলিশ দেখে যাবে ভড়কে। তখন আপনাদের যে ওস্তাদ তিনি বিনীত ভঙ্গিতে বলবেন, স্যার, এত রাতে ডিসর্টাব করার জন্যে খুবই দুঃখিত। একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক সারাদিন না খেয়ে আছেন। যদি একটু খাওয়ার ব্যবস্থা করেন! দেখবেন তৎক্ষণাৎত খাবার ব্যবস্থা হবে। মধ্যরাতের পুলিশ ভয়াবহ জিনিশ।’
বদরুল সাহেবের হতভম্ব ভাব কাটছে না। তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণাও সম্ভবত মাথায় উঠে গেছে। পুলিশ দলের একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে একটু ‘প্রাইভেট টক’ আছে।
আমি ‘প্রাইভেট টক’ শোনার জন্যে ফুটপাত ছেড়ে নিচে নামলাম। সে কানের কাছে গুন গুন করে বলল, স্যার, বিরাট মিসটেক হয়েছে। রাস্তায় কত লোক হাঁটে, কে সাধু, কে শয়তান বুঝব কি ভাবে!
আমিও তার মতই নিচু গলায় বললাম, না বোঝারই কথা।
‘ওস্তাদজী একটা ভুল করেছে। চড় দিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে উনার হাত ফুলে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথার চোটে রাতে ঘুমাতে পারেননি।’
‘বেকায়দায় চড় দিয়েছে। রগে টান পড়েছে। কিংবা হাতের মাসলে কিছু হয়েছে।’
‘কি যে ব্যাপার সেটা স্যার আমরা বুঝে গেছি। এখন স্যার আমাদের ক্ষমা দিতে হবে। এটা স্যার আমাদের একটা আবদার।’
‘আচ্ছা যান, ক্ষমা দিলাম।’
‘ওস্তাদজী আজ ছুটি নিয়েছে। সারাদিন শুয়েছিল, রাতে বের হয়েছে শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
‘ভালই হয়েছে দেখা হয়ে গেল।’
‘আপনি স্যার আমাদের জন্যে একটু দোয়া রাখবেন।’
‘অবশ্যই রাখব।’
‘উনার খাবার ব্যাপারে স্যার কোন চিন্তা করবেন না।’
আমি বদরুল সাহেবকে বললাম, আপনি এদের সঙ্গে যান। খাওয়া-দাওয়া করুন। তারপর মেসে চলে যাবেন। আমি ভোরবেলা ফিরব।
তিনি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছেন। কিছুতেই যাবেন না। পুলিশরা বলতে গেলে তাকে গ্রেফতার করেই নিয়ে গেল। বেচারার হতাশ দৃষ্টি দেখে মায়া লাগছে। মায়া ভাল জিনিশ না। অনিত্য এই সংসারে মায়া বিসজর্ন দেয়া শিখতে হয়। আমি শেখার চেষ্টা করছি।
এবং হিমু – ৩য় পরিচ্ছেদ
বাদুর-স্বভাব আয়ত্ত করার চেষ্টা সফল হচ্ছে না। বাদুর-ভাব কয়েকদিন থাকে তারপর ভেতর থেকে মানুষ-ভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাতে ঘুমুতে ইচ্ছে করে। দিনে হাজার চেষ্টা করেও ঘুমুতে পারি না। এখন আমার মানুষ ফেজ চলছে। রাতে ঘুমুচ্ছি, দিনে জেগে আছি। রাস্তায় যাচ্ছি। হাঁটাহাঁটি করছি। দিনে হাঁটাহাঁটি করার মধ্যেও কিছু থ্রিল আছে। হঠাৎ হঠাৎ খুব বিপদজনক কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। যার সঙ্গে নিশি রাতে দেখা হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। রাত তিনটার সময় নিশ্চয়ই রেশমা খালার সঙ্গে নিউমার্কেটের কাছে দেখা হবে না।প্রায় দু’বছর পর রেশমা খালার সঙ্গে দেখা। পাজারো নামের অভদ্র গাড়ির ভেতর ড্রাইভারের পাশে বসবেন ভাবাই যায় না। তবে শুনেছি পাজেরো গাড়িগুলি এমন যে ড্রাইভারের সীটের পাশে বসা যায়। এতে সম্মানহানি হয় না।
রেশমা খালা হাত উঁচিয়ে ডাকলেন, এই হিমু, এই….। ড্রাইভার ক্রামগত হর্ন দিতে লাগল। আমার উচিত দ্রুত পালিয়ে যাওয়া। কোন গলিটলির ভেতর ঢুকে পড়া। গলি না থাকলে ম্যানহলের ঢাকনি খুলে তার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া। কিছু কিছু ট্রাকের পেছনে লেখা ১০০ গজ হাত দূরে থাকুন। রেশমা খালা সেই ট্রাকের চেয়েও ভয়াবহ। আশে পাশে গলি বা ম্যানহোল নেই। কাজেই আমি হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম। রাস্তা পার হবার আগেই খালা চেঁচিয়ে বললেন, হিমু, তুই নাকি গলার কাঁটা নামাতে পারিস?
রেশমা খালা আমার কেমন খালা জানি না। লতায়-পাতায় খালা। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশ পার হলেও এই মুহূর্তে খুকি সেজে আছেন। মাথা ভর্তি ঢেউ-খেলানো ঘন কাল চুল। এই চুল হংকং থেকে আনানো। ঠোট লাল টুক টুক করছে। জামদানী শাড়ি পরেছেন। গলায় মাটির মালা। কানে মাটির দুল। এটাই লেটেস্ট ফ্যাশান। শান্তিনিকেতন থেকে আমদানী হয়েছে।
আমি গাড়ির কাছে চলে এলাম। রেশমা খালা চোখ বড় বড় করে বললেন—বাদলের মা’র কাছে ঘটনা শুনলাম। বড় বড় সার্জন কাত হয়ে গেছে—তুই গিয়েই মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে কাঁটা নামিয়ে ফেললি। কি রে, সত্যি?
‘হ্যাঁ সত্যি। তোমার কাঁটা লাগলে খবর দিও, নামিয়ে দিয়ে যাব।’
‘তোকে খবর দেব কি ভাবে? তোর ঠিকানা কি? তোর কোন কার্ড আছে?’
‘ঠিকানাই নাই—আবার কার্ড।’
‘তুই এক কাজ কর না। আমার বাড়িতে চলে আয়। একতালাটা তো খালিই পড়ে থাকে। একটা ঘরে থাকবি। আমার সঙ্গে খাবি। ফ্রী থাকা-খাওয়া।’
‘দেখি, চলে আসতে পারি।’
‘আসতে পারি-টারি না। চলে আয়। তুই কাঁটা নামানো ছাড়া আর কি পারিস?’
‘আপাতত আর কিছু পারি না।’
‘কে যেন সেদিন বলল, তুই ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলতে পারিস। তো সিক্সথ সেন্স নাকি খুব ডেভেলপড।’
আমি হাসলাম। আমার সেই বিশেষ ধরনের হাসি। হাসি দেখে রেশমা খালা আরো অভিভূত হলেন।
‘এই হিমু, গাড়িতে উঠে আয়।’
‘যাচ্ছেন কোথায়?’
‘কোথাও যাচ্ছি না। খালি বাড়িতে থাকতে কতক্ষণ আর ভাল লাগে! এই জন্যেই গাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে বের হই।’
‘বাড়ি খালি না-কি?’
‘ও আল্লা, তুই কিছুই জানিস না? তোর খালুর ইন্তেকালের পর বাড়ি খালি না? এত বড় বাড়িতে একা থাকি, অবস্থাটা চিন্তা করতে পারিস।’
‘দারোয়ান, মালী, ড্রাইভার এরা তো আছে।’
‘খালি বাড়ি কি দারোয়ান, মালী, ড্রাইভার এইসবে ভরে? তুই চলে আয়! তোর কাঁটা নামানোর ক্ষমতার কথা শুনে দারুণ ইন্টারেস্টিং লাগছে। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গাড়িতে উঠ।’
‘আজ তো খালা যেতে পারব না। জরুরি কাজ।’
‘তোর আবার কিসের জরুরি কাজ? হাঁটা ছাড়া তোর আবার কাজ কি?’
‘আরেকজনের কাঁটা নামাতে হবে। চিতলমাছের কাঁটা গলায় বিঁধিয়ে বসে আছে। কোঁ কোঁ করছে।সেই কাঁটা তুলতে হবে।’
‘আমাকে নিয়ে চল। আমি দেখি ব্যাপারটা কি?’
‘আপনাকে নেয়া যাবে না খালা। মন্ত্র-তন্ত্রের ব্যাপার তো। মেয়েদের সামনে মন্ত্র কাজ করে না।’
‘মেয়েরা কি দোষ করেছে?’
‘মেয়েরা কোন দোষ করেনি।দোষ করেছে মন্ত্রে। এই মন্ত্র নারী বিদ্বেষী।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে না নিতে চাইলে না নিবি। গাড়িতে উঠ, তোকে কিছুদূর এগিয়ে দি। রোদের মধ্যে হাঁটছিস দেখে মায়া লাগছে।’
কেউ গাড়িতে উঠার জন্যে বেশি রকম পিড়াপিড়ি করলে ধরে নিতে হবে গাড়ি নতুন কেনা হয়েছে। আমি গাড়িতে উঠতে বললাম, গাড়ি নতুন কিনলে?
‘নতুন কোথায়, ছয় মাস হয়ে গেলো না।’
‘ছয় মাসে স্বামী পুরাতন হয়—গাড়ি হয় না। দারুণ গাড়ি।’
‘তোর পছন্দ হয়েছে?’
‘পছন্দ মানে! এরোপ্লেনের মত গাড়ি।’
‘এই গাড়ির সবচে বড় সুবিধা কি জানিস? সামনা-সামনি কলিশন হলে গাড়ির কিছু হবে না, কিন্তু অন্য গাড়ি ভোতা হয়ে যাবে’
‘বাহ দারুণ তো।’
তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগছে রে হিমু। চাকরি-বাকরি কিছু করছিস?’
‘আপনার হাতে চাকরি আছে?’
‘না।তোর খালুর মৃত্যুর পর মিল-টিল সব বিক্রি করে ক্যাশ টাকা করে ফেলেছি। ব্যাঙ্কে জমা করেছি। আমি একা মানুষ—মিল-টিল চালোনো তো সম্ভব না। সবাই লুটে-পটে খাবে। দরকার কি।’
‘কোন দরকার নেই।’
গাড়ি চলছে। কোন বিষেশ দিকে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ড্রাইভার তার ইচ্ছমত চালাচ্ছে। মীরপুর রোড ধরে চলতে চলতে ফট করে ধানমন্ডি চার নাম্বারে ঢুকে পড়ল। আবার কিছুক্ষণ পর মীরপুর রোডে চলে এল।
‘হিমু।’
‘জ্বি খালা।’
‘তোর খালুর স্মৃতি রক্ষার্থে একটা কিছু করতে চাই। কর্মাযোগী পুরুষ ছিল। পথের ফকির থেকে কলকারখানা, গার্মেন্টস, করেনি এমন জিনিস নেই।স্ত্রী হিসেবে তার স্মৃতি রক্ষার জন্যে আমার তো কিছু করা দরকার।’ু
‘করলে ভাল। না করলেও চলে।’
‘না না করা দরকার। ভাল কিছু করা দরকার। উনার নামে একটা আর্ট মিউজিয়াম করলে কেমন হয়।’
‘ভাল হয়। তবে খালু সাহেবের নামে করা যাবে না। মানাবে না।’
‘মানাবে না কেন?’
“গনি মিয়া মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট” শুনতে ভাল লাগছে না। খালু সাহেবের নামটা গনি মিয়া না হয়ে আরেকটা সফেসর্টিকেটেড হলে মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট দেয়া যেত। তোমার নিজের নামে দাও না কেন?“রেশমা মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট” শুনতে তো খারাপ লাগছে না।’
গাড়ি মীরপুর রোড থেকে আবার ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ঢুকে পড়েছে। আবারো মনে হয় মীরপুর আসবে। ভাল যন্ত্রণায় পড়া গেল!
‘খালা, আমার তো এখন যাওয়া দরকার। চিতল মাছের কাঁটা নামানো খুব সহজ না।’
আহা বোস না। তোর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। কথা বলার মানুষ পাই না। কেউ আমার বাড়িতে আসে না। এটা একটা আশ্চয় কাণ্ড। তোর খালুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কার্ড ছাপিয়ে পাঁচশ লোককে দাওয়াত দিয়েছি। তিনটা দৈনিক পত্রিকায় কোয়াটার পেইজ বিজ্ঞাপন দিলাম। লোক কত হয়েছে বল তো?’
‘একশ?’
‘আরে না—আঠারো জন। এর মধ্যে আমার নিজের লোকই সাতজন। ড্রাইভার, মালী, দারোয়ান, কাজের দুটো মেয়ে।’
‘আমাকে খবর দিলে চলে আসতাম।’
তোর কোন স্থায়ী ঠিকানা আছে? ঠিকানা নেই। রাস্তায় যে ফকির গুলি আছে তাদেরও ঠিকান আছে। রাতে তারা একটা নিদিষ্ট জায়গায় ঘুমায়। আজীজ মার্কেটের বারান্দায় যে ঘুমুরে সে সেখানেই ঘুমাবে। সে কমলাপুর রেল স্টেশনে ঘুবুবে না। আর তুই তো আজ এই মেসে, কাল ঐ মেসে। হিমু, তুই চলে আয় তো আমার কাছে। গুলশানের বাড়ি নতুন করে রিনোভেট করেছি। টাকাপয়সা করচ করে হুলস্থুল করেছি। তোর ভাল লাগবে। আসবি?’
‘ভেবে দেখি।’
‘ভাবতে হবে না। তুই চলে আয়। থাকা-খাওয়া খরচার হাত থেকে তো বেঁচে গেলি। মাসে মাসে না হয় কিছু হাতখরছও নিবি।’
‘কত দেবে হাতখরচ?’
‘বিড়ি-সিগারেটের খরচ—আর কি। কি, থাকবি? তুই থাকলে একটা ভরসা হয়। দিনকালেন যে অবস্থা চাকর-দারোয়ান এরাহ বর্টি দিয়ে কুপিয়ে কোনদিন না মেরে ফেলে। এমন ভয়ে ভয়ে থাকি। চলে আয় হিমু। আজই চলে আয়। বাড়ি তো চিনিসই। চিনিস না?’
‘হু।’
‘তোকে দেখে আরেকটা কথা ভাবছি—বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা আছে প্যারা নরমাল পাওয়ার যাদের, এদের বাড়িতে নিয়ে রাখলেন কেমন হয়? এসট্টলজার, পামিস্ট, বুঝতে পারছিস কি বলছি?’
‘পারছি—ইন্সটিটউট অব সাইকিক রিসার্চ টাইপ।’
‘ঠিক বলেছিস। বাংলাদেশে তো এরকম আগে হয় নি। না-কি হয়েছে?’
‘না হয়নি। করতে পার। নাম কি দেবে।“গনি মিয়া ইন্সটিটউট অব সাইকিক রিসার্চ”।’
‘নামটা কেমন শুনাচ্ছে?’
‘মিয়াটা বাদ দিলে খারাপ লাগবে না—গনি ইন্সটিটউট অব সাইকিক রিসার্চ। খালা, এইখানে আমি নামব। ড্রাইভার, গাড়ি থামাও। গাড়ি না থামালে আমি জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়ব।’
ড্রাইভার গাড়ি থামালো। রেশমা খালা বলল, কি ঠিক হল? তুই আসছিস?
‘হুঁ। আমার এ মাসের হাতখরচের টাকা দিয়ে দাও।’
‘থাকাই শুরু করলি না—হাতখরচ কি?’
‘আমি তো খালা চাকরি করছি না যে মাসের শেষে বেতন। এটা হল হাত খরচ।’
‘তুই আগে বিছানা-বালিশ নিয়ে উঠে আয়, তারপর দেখা যাবে।’
‘আচ্ছা।’
আমি লম্বা লম্বা পা ফেলা শুরু করলাম। উদ্ধার পাওয়া গেছে, এখন চেষ্টা করা উচিত যত দূরে সরে পড়া যায়। সম্ভাবনা খুব বেশি যে খালা তার গাড়ি নিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসবে। আমার উচিত ছোট কোন গলিতে ঢুকে পড়া, যেখানে পাজেরো টাইপ গাড়ি ঢুকতে পারে না।
‘এই হিমু, এই, এক সেকেন্ড শুনে যা। এই, এই।’
বধির হয়ে যাবার ভান করে আমি গলি খুঁজছি। গাড়ির ড্রাইভার ক্রামগত হর্ন দিচ্ছে। না ফিরলে চারদিকে লোক জমে যাবে। বাধ্য হয়ে ফিরলাম।
‘নে, হাতখরচ নে। না দিলে আবার হাত খরচ দেয়া হয় নি এই অজুহাতে আসবি না।’
রেশমা খালা একটা চকচকে পাঁচশ টাকা নোট জানালা দিয়ে বাড়িয়ে ধরল।
‘তুই সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসিস। সন্ধ্যার পর থেকে আমি বাসায় থাকি। নানান সমস্যা আছে, বুঝলি? ভয়ংকর ব্যাপার ঘটেছে। কাউকে বলা দরকার। রাতে এক ফোঁটা ঘুমুতে পারি না।’
‘চলে আসব।’
‘টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পকেটে রাখ। হারিয়ে ফেলবি তো।’
‘খালা, আমার পকেট নেই। যাবতীয় টাকাপয়সা আমাকে হাতে নিয়ে ঘুরতে হয়।’
‘বলিস কি!’
‘খালা যাই?’
‘যাই বলে দেরী করলাম না, প্রায় দৌড়ে এক গলিতে ঢুকে পড়লাম।