আমাদের ম্যানাজারের নাম হায়দার আলি খাঁ। নামের সঙ্গে তার চেহারার কোন সঙ্গিত নেই। রোগা, বেঁটে একজন মানুষ। বেঁটেরা সচবাচর কুঁজো হয় না। তিনি খানিকটা কুঁজো। ব্যক্তিবিশেষের সামনে তার কুজোভাব প্রবল হয়। আমি সেই ব্যক্তিবিশেষের একজন। তিনি কোন কারণ ছাড়াই আমাকে ভয় পান।
হায়দার আলি খাঁ চেয়ারে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। পিরিচে করে চা খাচ্ছে। ঐ লোককে আমি কখনো চায়ের কাপে করে চা খেতে দেখিনি। আমি কাছে এসে হাসিমুখে বললাম, ভাই সাহেব, খবর কি?
ভদ্রলোক যে ভাবে চমকালেন তাতে মনে হল, সাত রেক্টার স্কেলের একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে। পিরিচের সব চা তার জামায় পড়ে গেল। আমি বললাম, করেছেন কি?
‘চা খাচ্ছি স্যার।’
‘খুব ভাল। বেশি বেশি করে চা খান। রিসার্চ করে নতুন বের করেছে—দৈনিক যে সাত কাপ চা খায় তার হার্টারি কখনো ব্লক হয় না।’
‘থ্যাংক য়্যু, স্যার।’
যেভাবে তিনি থ্যাংক য়্যু বললেন তাতে ধরণা হতে পারে হার্টের আর্টারি সংক্রান্ত রিসাচটা আমার করা। আমি অবসর সময়ে মেসের ঘরের দরজা বন্ধ করে রিসার্চ করেছি।
‘বদরুল সাহেবকে নাকি নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন—কথা কি সত্যি?
‘জ্বি। তিন মাসের রেন্ট বাকি। আর নানান যন্ত্রণা করে। বোডাররা নালিশ করেছে।’
‘কি যন্ত্রাণা করেছে?’
‘রান্নার সময় বাবুর্চির পাশে বসে থাকে। ফিস্ট হয়েছে—ত্রিশ’ টাকা করে চাঁদা। একটা পয়সা দেয় নাই—ফিস্ট খেয়ে বসে আছে।’
‘চাঁদা না দিলেও খাটাখাটনি তো করেছে। গোশত কিরে আনা, খাসির গোশত যে-কেউ কিনতে পারে না। খুবই জটিল ব্যাপার। খাসি ভেবে কিনে এনে রান্নার পর প্রকাশ পায় পাঁটা।’
হায়দার আলি খাঁ তাকাচ্ছেন। আমার কথাবাতার ধরন বুঝতে পারছেন না। কি বলবেন তাও গূছিয়ে উঠতে পারছে না।
‘ম্যানেজার সাহেব।’
‘জ্বি স্যার।’
‘বদরুল সাহেবকে আর কিছু বলবেন না।’
‘তিন মাসের রেন্ট বাকি পড়ে গেছে। অন্য পাটিকে কথা দিয়ে ফেলেছি। মানুষের কথার একটা দাম আছে। ঠিক না স্যার?’
‘ঠিক তো বটেই। কথার দাম আগে যা ছিল মুদ্রাস্ফীতির কারণে সেই দাম আরো বেড়েছে। তবু একটা ব্যবস্থা করুন। এক মাসের মধ্যে সব পেমেন্ট ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
‘কিভাবে হবে? শূনেছি উনি ছাঁটাই হয়ে গেছেন । অফিসের পাওনা টাকাপয়সাও দিচ্ছে না। টাকাপয়সার কি না-কি গন্ডগোল আছে।’
‘গন্ডগোল তো থাকবেই। পৃথিবীতে বাস করবেন আর গন্ডগোলে পড়বেন না, তা তো হয় না। এই গন্ডগোল নিয়েই বাস করতে হবে। উপায় কি? মনে থাকবে তো কি বললাম?’
‘জ্বি স্যার।’
আমি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শূয়ে পড়লাম। ম্যানেজার অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জ্বি স্যার বলেছে বলেই ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। বিনয়ের বাড়াবাড়িটাই সন্দেহজনক। আমার নিজের ধারণা বিনয় ব্যাপারটা পৃথিবী থেকে পুরোপুরি উঠে গেলে পৃথিবীতে বাস করা সহজ হত। বিনয়ের কারণে সত্য-মিথ্যা প্রভেদ করা সমস্যা হয়। মিথ্যার সঙ্গে বিনয় মিমিয়ে দিলেই সেই মিথ্যা ধরার কারো সাধ্য থাকে না।
ঘুমের চেষ্টা করছি। ঘুম আসছে না। বেশ কয়েকদিন থেকে নিদ্রা এবং জাগরণের সাইকেলটা বদলাবার চেষ্টা করছি। রাত ঘুমের জন্যে এবং দিন জেগে থাকার জন্যে, এই নিয়ম ভাঙা দরকার। মানুষ ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সৃর্য নিয়ন্ত্রণ করবে না। সৃর্য হচ্ছে জ্বলন্ত অগ্নিগোলক। মানুষের মত অসাধারণ মেধার প্রাণীগোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রণ করার তার কোন অধিকার নেই।
টানা ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায় সন্ধ্যায়। এই সময় মেসটা ফাঁকা ফাঁকা থাকে। বেশির ভাগিই চা-নাশতা খেতে বাইরে যায়। মেসে শূধু একবেলা খাবার ব্যবস্থা, রাতে। এক কাপ চা খেতে হলেও রাস্তা পার হয়ে স্টল যেতে হবে। ইদানীং অবশ্যি নতুন, এক চাওয়ালা শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। এরা বিশাল ফ্লাস্কে করে চা ফেরি করে। চায়ের দাম ফক্সড—এক টাকা কাপ। চিনি বা দুধের দাম বাড়ালে কাপের সাইজ ছোট হয় কিন্তু চায়ের দামের হের-ফের হয় না। আমাদের এখানে যে ছেলে চা বিক্রি করে তার নাম মতি। দেখতে রাজপুত্রের মত, আসলে ভিখিরিপুত্র। বারান্দায় এসে মতিকে খুঁজলাম। মতি এখনো আসেনি, তবে অপরিচিতি এক ভদ্রলোক এসেছেন। শুকানো মুখ টুলে বসে আছেন। ভদ্রলোক অপরিচিত হলেও দেখামাত্র চিনলাম—কারণ তাঁর চশমার একটা ডাঁটা ভাঙা সুতা দিয়ে কানের সঙ্গে বাঁধা। ভদ্রলোক সন্দেহজনক দুষ্টিতে আমাকে দেখছেলন। আমি বললাম, কি ভাই, ভাল আছেন?
তিনি হকচকিয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়ালেন।
‘বদরুল সাহেবের কাছে এসেছেন, তাই তো?’
‘জ্বি স্যার?’
‘টাকা ধারের জন্যে?’
ভদ্রলোক খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন। চট করে কিছু বলতে পারছেন না। আবার খুব চেষ্টা করছেন কিছু বলতে।
আমি বললাম, বদরুল সাহেব আমাকে আপনার কথা বলেছেন। খুবই প্রশংসা করছিলেন। প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় একটা এক্সটা না-কি ভুল হয়েছিল। তাড়াহুড়া করেছিলেন নিশ্চয়ই। অনেক সময় ওভার কনফিডেন্সেও সমস্যা হয়। যাই হোক, কেমন আছেন বলুন।
‘জ্বি ভাল। বদরুল কখন আসবে?’
‘উনি আসবেন কোথেকে?’
‘এখানে থাকেন না?’
‘আগে থাকতেন। মেসে অনেক বাকি পড়ে গেছে। চারদিকে ধার-দেনাঅ পালিয়ে গেছেন।’
‘নিচের ম্যানেজার সাহেব আমাকে বললেন, মেসেই থাকে।’
‘ম্যানেজার তাই বলেছেন? সে রকমই বলার কথা। সেও জানে না। জানলে জিনিসপত্র ক্রোক করে রেখে দিত। চুপি চুপি পালিয়েছে। শুধু আমি জানি। আপনাকে বললাম, কারণ আপনি তার ক্লোজ ফ্রেন্ড। ছাত্র জীবনের বন্দু। অংকে সব সময় হাই মার্ক পেয়েছেন।’
‘বদরুল থাকে কোথায়?’
‘সেটাও বলা নিষেধ। যাই হোক, আপনাকে বলছি। দয়া করে খবরটা গোপন রাখবেন। উনি টেকনাফের দিকে চলে গেছেন।’
‘কোন দিকে গেছে বললেন?’
‘টেকনাফের দিকে । চিটাগাং হিল ট্রেক্ট।তাঁর দুর সম্পর্কের এক মামা আছেন, বন বিভাগে চাকরি করেন, তাঁর কাছে গেছেন। কিছু মনে করবেন না, আপনার নামটা যেন কি?’
খোঁজে আসাও অর্থহীন। চলে যান।’
‘চলে যাব?’
‘আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারি, শুধু চা খাবেন?’
আবদুল রশীদ হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। মুখ দেখে যাচ্ছে সে পুরোপুরি আশাহত। আমি ভদ্রলোককে চা খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। চা খাওয়ালাম, সিঙ্গাড়া খাওয়ালাম। এইখানেই শেষ করলাম না, রাস্তার পাশে ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে চশমার ডাঁট লাগিয়ে দিলাম। আমার সর্বমোট ১৩ টাকা খরচ হল।
ভদ্রলোক বললেন, ভাই সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করেন। আপন ভেবে বলছি।
‘বলুন, কিছু মনে করব না।’
‘কথাটা বলতে খু্বই লজ্জা পাচ্ছি। আপনি অতি মহৎপ্রাণ এক ব্যক্তি। আপনাকে বিব্রত করতেও লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে…’
‘মাথা কাটা যাওয়ার কিছু নেই, আপনি বলুন।’
‘দারুণ এক সংকটে পড়েছি ভাই সাহেব। আত্মহত্যা ছাড়া এখন আর পথ দেখছি না।’
‘ছেলে অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না?’
‘ধরেছেন ঠিকই। তবে ছেলে না, মেয়ে। কনিষ্ঠা কন্যা। সকাল থেকে হাঁপনির মত হচ্ছে। ডাক্তার ইনজেকশন, সেই সঙ্গে কি ট্যাবলেট যেন দিয়েছে। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, চিকিৎসা করার টাকা কোথায়? তুমি বরং গলা টিপে মেরে ফেল।’
‘উনি গলা টিপে মারতে রাজি হচ্ছেন না।
আবদুর রশীদ আমার এই কথায় অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আমি বললাম, এইসব কঠিন কাজ স্ত্রীকে দিয়ে হবে না। এইসব হল পুরুষের কাজ। গলা টেপে মারতে হলে আপনাকেই মারতে হবে।
‘ভাই সাহেব, ঠাট্টা করছেন?’
‘না, ঠাট্টা করছি না। মৃত্যু কোন ঠাট্টা-তামাশার বিষয় না। আমি আপনাকে একশ’ টাকা দেব।’
‘দিবেন? সত্যি দিবেন?’
‘অবশ্যই দেব।স্কুল-জীবনে আপনি অংকে খুব ভাল ছিলনে, তাই না? কেমন ভাল ছিলেন প্রমাণ দিন দেখি। সহজ একটা অংক জিজ্ঞেস করব। কারেক্ট উত্তর দেবেন—একশ’ টাকা নিয়ে চলে যাবেন।’
আবদুর রশীদ ক্ষীণ স্বরে বলল, কি অংক?
‘একটা বাড়িতে চারটা হারিকেন জ্বলছিল। গভীর রাতে কথা নেই বার্তা নেই শুরু হল ঝড়। একটা হারিকেন নিভে গেল। এখন আপনি বলুন ঐ বাড়িতে হারিকেন এখন কয়টা?’
‘তিনটা!’
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, হয়নি। একটা হারিকেন নিভে গেছে ঠিকই। হারিকেনের সংখ্যা তো কমেনি। হারিকেন চারটাই আছে। আপনি তো ভাই অংক শিখতে পারেননি। টাকাটা দিতে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না।
আবদুর রশীদ দাঁড়িয়ে আছে—আমি হাঁটা ধরেছি। মেসে ফিরে যাব। সারাদিন কিছু না খাওয়াতে খিদেয় নাড়িভুড়ি পাক দিচ্ছে। মেসে রান্না হয়েছে কি-না খোঁজ নিতে হবে। মেসের ভাত সকাল সকাল নেমে যায়। ভাত নেমে গেলে একটা ডিম ভেজে দিতে বলব। আগুন-গরম ভাত ডিমভাজা দিয়ে খেতে অতি উপাদেয়। তবে খেতে হয় চুলা থেকে ভাত নামার সঙ্গে সঙ্গে, দেরি করা যায় না।