বদরুল সাহেব তাঁর বিখ্যাত খাসির গোশতের বাটি নিয়ে এসেছেন। গোশত বলে সেখানে কিছু নেই। জ্বালের চোটে সব গোশত গলে কালো রঙের ঘন স্যুপের মত একটা বস্ত তৈরি হয়েছে। চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলা যায়। তবে বদরুল সাহেবের বিবেচনা আছে। তিনি সঙ্গে চায়ের চামচ এনেছেন। আমি সেই চামচে তরল খাসির মাংস এক চুমুক মুখে দিয়ে বললাম, অসাধারণ! রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কাছাকাছি।
বদরুল সাহেব উজ্জ্বল মুখ করে বললেন, বাসি হওয়ার টেন্ট আরো খুলেছে, তাই না? গোছতের ঐ মজা যত বাসি তত মজা। টেস্টে খুলছে না?
‘খুলছে বললে কম বলা হয়।এক্কেবারে ডানা মেলে দিয়েছে।’
‘গরম গরম পরোটা দিয়ে খেলে আরো আরাম পেতেন! আপনি একটু ওয়েট করুন, আমি দৌড় দিয়ে দু’টা পরোটা নিয়ে আসি। সাড়ে ছ’টা বাজে, মোবারকের স্টলে পরোটা ভাজা শুরু করেছে।’
‘পরোটা আনার দরকার নেই। আপনি আরাম করে বসুন তো। বরং এক কাজ করুন, আরেকটা চামচ নিয়ে আসুন, দু’জনে মিলে মজা করে খাই।’
‘না না, অল্পই আছে।’
‘নিয়ে আসুন তো চামচ। ভাল জিনিস একা খেয়ে আরাম নেই।’
‘এটা একটা সত্য কথা বলেছেন।’
বদরুল সাহেব চামচ আনতে গেলেন। ভদ্রলোকের জন্যে আমার মায়া লাগছে। গত দু’মাস ধরে তাঁর কোন চাকরি নেই। ইনসুরেুন্স কোম্পানীতে ভাল চাকরি করতেন। ইন্সপেক্টর জাতীয় কিছু। কোম্পানী তারা তাকে ছাঁটাই করে দিয়েছে। এই বয়সের একজন মানুষের চাকরি চলে গেলে আবার চাকরি জোগাড় করা কঠিন। ভদ্রলোক কিছু জোগাড় করতে পারছেন না। মেসের ভাড়া তিন মাস বাকি পড়েছে। যতদূর জানি, মেসের খাওয়াও তাঁর বন্ধ। ফিস্টে তার নাম থাকার কথা না, বাজার-টাজার করে দিয়েছেন, রান্নার সময় কাছে থেকেছেন এই বিশেষ কারণে হয়ত তাঁর খাবার ব্যবস্থা হয়েছে।
চামচ নিয়ে এসে বদরুল সাহেব আরাম করে খাচ্ছেন। তাঁকে দেখে এই মুহূর্তে মনে করার কোন কারণ নেই যে, পৃথিবীতে নানান ধরনের দুঃখ-কষ্ট আছে। যুদ্ধ চলছে বসিনিয়ায়। রুয়ান্ডায় অকারণে, একজন আরেকজনকে মারছে। তাঁর নিজের সমস্যাও নিশ্চয়ই অনেক। দু’মাস বাড়িতে মনিঅর্ডার যায়নি। বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই আতংকে অস্থির হচ্ছে। ভদ্রলোক নির্বিকার।
‘হিমু সাহেব।’
‘জ্বি।’
‘হাড়গুলি চুষে যে খান, মজা পাবেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘Nearer the bone, sweeter is the meat.’
আমি একটা হাড় মুখে ফেলে চুষতে লাগলাম।
তিনিও একটা মুখে নিলেন। আনন্দে তাঁর চোখে প্রায় বন্ধ।
‘বদরুল সাহেব!’
‘জ্বি।’
‘চাকরি-বাকরির কিছু হল?’
‘এখনো হয়নি, তবে ইনশাআল্লাহ্ হবে। আমার অনেক লোকের সঙ্গে জানাশোনা। এদের বলেছি—এরা আশা দিয়েছে।’
‘শুধু আশার উপর ভরসা করাটা কি ঠিক হচ্ছে?’
‘আমার খুব ক্লোজ একজনকে বলেছি। ইস্টার্ন গার্মেন্টস-এর মালিক। ইস্কুলে এক সঙ্গে পড়েছি। এখন রমরমা অবস্থা। গাড়ি-টাড়ি কিনে হুলস্থুল। বাড়ি করেছে গুলশানে।’
‘তিনি কি আশা দিয়েছেন?’
‘পরে যোগাযোগ করতে বলেছে। সেদিনই সে হংকং যাচ্ছিল। দারুণ ব্যস্ত। কথা বলার সময় নেই। এর মধ্যেই সে পেস্ট্রি কোক খাইয়েছে। পূর্বাণীর পেস্ট্রি, স্বাদই অন্য রকম। মাখনের মত মোলায়েম। মুখের মধ্যেই গলে যায়। চাবাতে হয় না।’
‘আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু?’
‘বললাম না স্কুল-জীবনের বন্ধু। নাম হল গিয়ে আপনার ইয়াকুব। স্কুলে সবাই ডাকত—বেয়াকুব।’
‘আসলেই বেকুব?’
‘তখন তো বেকুবের মতই ছিল। তবে স্কুল-জীবনের স্বভাব-চরিত্র দেখে কিছু বোঝা যায় না। আমাদের ফার্স্ট বয় ছিল রশিদ। আরে সর্বনাশ, কি ছাত্র। অংকে কোন দিন ১০০-র নিচে পায় নাই। প্রিটেস্ট পরীক্ষায় এক্সটা ভুল করেছে। সাত নাম্বার কাটা গেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। সেই রশিদের সঙ্গে একুশ বছর পর দেখা। গাল-টাল ভেঙ্গে, চুল পেকে কি অবস্থা। চশমার একটা ডাণ্ডা ভাঙ্গা, সুতা দিয়ে কানের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। দেখে মনটা খারাপ হল।’
‘অংকে একশ পাওয়া ছেলের এই অবস্থা, মন খারাপ হবারই কথা। অংকে টেনে—টুনে পাশ করলে কানে সূতা বেঁধে চশমা পরতে হত না।’
‘কারেক্ট বলেছেন। একুশ বছর পর দেখা—কোথায় কুশল জিজ্ঞেস করবে, ছেলেমেয়ে কতবড় এইসব জিজ্ঞেস করবে—তা না, ফট করে একশ’টাকা ধরে চাইল।’
‘ধার দিয়েছেন?’
‘কুড়ি টাকা পকেটে ছিল, তা-ই দিলাম। খুশি হয়ে নিয়েছে।’
‘মেসের ঠিকানা দেননি তো? মেসের ঠিকানা দিয়ে থাকলে মহা বিপদে পড়বেন। দু’দিন পরে পরে টাকার জন্যে বসে থাকবে। আপনার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে।’
বদরুল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, স্কুল-জীবনের বন্ধু তো—দুরবস্থা দেখে মনটা এত খারাপ হয়েছে, আমার নিজের চোখে পানি প্রায় এসে গিয়েছিল। সুতা দিয়ে কানের সাথে চশমা বাঁধা—
বদরুল সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর ভবিষ্যতের চেয়ে বন্ধুর ভবিষ্যতের চিন্তায় তাঁকে বেশি কাতর বলে মনে হল।
‘হিমু ভাই।’
‘জ্বি।’
‘ভাল একটা নাশতা হয়ে গেল, কি বলেন?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে। আপনি যে কষ্ট করে আমার অংশটা জমা করে রেখেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।’
‘আরে ছিঃ ছিঃ! এটা একটা ধন্যবাদের বিষয় হল? এতদিন পরে ফিস্ট হচ্ছে আপনি বাদ পড়বেন এটা কেমন কথা? তাছাড়া আপনি যেদিন মেসে খান না সেদিনের খাওয়াটা আমি খেয়ে ফেলি।’
‘ভাল করেন। অবশ্যেই খেয়ে ফেলবেন। দেশে টাকা পাঠিয়েছেন?’
‘গত মাসে পাঠিয়েছি। এই মাস বাদ পড়ে গেল। তবে সমস্যা হবে না, আমার স্ত্রী খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা—সে ব্যবস্থা করে ফেলবে।’
‘আপনার চাকরি যে নেই সেই খবর স্ত্রীকে জানিয়েছেন?’
‘জ্বি-না। আপনার ভাবী মনটা খারাপ করবে। কি দরকার! চাকরি তো পাচ্ছিই, মাঝখানে কিছুদিনের জন্যে টেনশানে ফেলে লাভ কি? আজই ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করব। সংস্কৃতে একটা কথা আছে না—“শুভস্য শীঘ্রম”। চা খাবেন হিমু ভাই?’
‘জ্বি-না। দরজা-টরজা বন্ধ করে লম্বা ঘুম দেব। আমার স্বভাব হয়ে গেছে বাদুরের মত। দিনে ঘুমাই রাতে জেগে থাকি।’
‘কাজটা ঠিক হচ্ছে না ভাই সাহেব। শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শরীর নষ্ট হলে—মন নষ্ট হয়। আমার শরীরটা ঠিক আছে বলেই এত বিপদে-আপদেও মনটা ঠিক আছে। শরীরটা ঠিক রাখবেন।’
‘আমার আবার উল্টা নিয়ম। মনটাকে ঠিক রাখে যাতে শরীর ঠিক থাকে।’
বদরুল সাহেব বাটি এবং চামচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ছোট্ট একটা কাজ করে দিবেন হিমু ভাই!
‘জ্বি, বলুন।’
‘মেসের মালিক আমাকে বলেছে সোমবারে মধ্যে মেস ছেড়ে দিতে। আজেবাজে সব কথা। গালাগালি। আপনি যদি একটু বলে দেন! ও আপনাকে মানে।’
‘আমি এক্ষুনি বলে দিচ্ছি।’
‘তাকে বললাম যে চাকরি হয়ে যাচ্ছে। ইয়াকুবকে বলেছি। এত বড় গার্মেন্টস-এর মালিক। চাকরি তার কাছে কিছুই না। সে একটা নিঃশ্বাস ফেললে দশটা লোকের এমপ্লয়ম্নেট হয়ে যায়। বিশ্বাস করে না। আপনি বললে বিশ্বাস করবে।’