সমস্যাটা কি?
ফরহাদ ভাইয়া পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে।
সে কি?
আজ তার সেকেন্ড পেপার ছিল। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে দেখল। খুব সহজ প্রশ্ন। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর যে সে জানে তাই না–তার ঝাড়া মুখস্থ। এই আনন্দে তার মাথা ঘুরে গেল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। জ্ঞান হবার পর দেখে তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। সারা শরীর পানিতে ভেজা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তার পর আর হলে ঢোকেনি। তার জন্যে গরম দুধ আনা হয়েছিল। দুধ খেয়ে সে বাসায় চলে এসেছে।
বলিস কি?
মিলি এখনও হাসছে। আতাহার শক্তিকত বোধ করছে। ঘটনা যা ঘটেছে তাতে হাসোহাসি করা যায় না। বাবা ঘটনা শুনে কি করবেন তা ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
ফরহাদ এখন করছে কি?
ঘুমুচ্ছে।
ঘুমুচ্ছে মানে?
ঘুমুচ্ছে মানে ঘুমুচ্ছে। স্লিপিং। আরাম করে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে।
আতাহার বিড় বিড় করে বলল, ওহি মাই গড়! মিলি বলল, ওহি মাই গড় বলা ঠিক না ভাইয়া। গড় তো তোমার একা না। কাজেই আমাদের বলা উচিত–ওহ আওয়ার গড়!
মিলির ফাজলামি ধরনের কথা শুনতে ভাল লাগছে না। আতাহার চিন্তিত মুখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি মুষল ধারে পড়ছে। বৃষ্টি রাত একটা পর্যন্ত হল। আতাহারের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যৰ্থ করে দিয়ে রাত একটার সময়ই নোংরা। পানি বাড়িতে ঢুকে গেল।
সেই রাতে আতাহারের খুব ভাল ঘুম হল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল। সে জাপানে। কিমানো পরা এক জাপানি তরুণী তার সঙ্গে হেসে হেসে বাংলায় কথা বলছে। তরুণীর মুখটা কিছুটা নীতুর মত। আতাহার বলল, আপনি এত সুন্দর বাংলা কোথায় শিখেছেন? জাপানি তরুণী তাতে খুব মজা পেয়ে গেল। খিল খিল করে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বলল, আপনার কাছ থেকে শিখেছি। আপনি ছাড়া আর আমাকে কে শেখাবে? আতাহার কিছুতেই ভেবে পেল না কখন সে এই মেয়েকে বাংলা শিখিয়েছে। স্বপ্নের মধ্যেই তার খুব অস্থির লাগতে লাগল।
এবং হিমু – ২য় পরিচ্ছেদ
বদরুল সাহেব আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, কোথায় ছিলেন এতদিন?
তাঁর গলা মোটা, শরীর মোটা, বৃদ্ধিও মোটা। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রশস্ত মানুষের অন্তরও প্রশস্ত হয়। বদরুল সাহেবের অন্তর প্রশস্ত, মনে মায়াভাব প্রবল। আমি ছ’-সাত দিন ধরে মেসে আসছি না। কেউ হয়ত ব্যাপারটা লক্ষ্যই করেনি। তিনি ঠিকই লক্ষ্য করেছেন। আমাকে দেখে তিনি যে উল্লাসের ভঙ্গি করলেন সেই উল্লাসে কোন খাদ নেই।
‘কোথায় ছিলেন রে ভাই?’
আমি হাসলাম। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর আমি ইদানীং হেসে দেবার চেষ্টা করছি। একেক ধরনের প্রশ্নের উত্তরে একেক ধরনের হাসি। এখন যে হাসি হাসলাম তার অর্থ হচ্ছে—আশেপাশেই ছিলাম।
বদরুল সাহেব বললেন, গত বৃহস্পতিবার মেসে ফিস্ট হল। বিরাট খাওয়া-দাওয়া। পেলেও, খাসির রেজাল সালাদ। খাসির মাৎস আমি নিজে কিনে এনেছিলাম। একটা আস্তে খাসি দেখিয়ে বললাম, হাফ আমাকে দাও, নো হাংকি-পাংকি।
‘হাফ দিয়েছিল?’
‘দিবে না মানে? মাংস কেটে আমার সামনে পিস করতে চায়। আমি বললাম, খবর্দার, আগে ওজন করে তারপর পিস করবে।’
‘আগে পিস করলে অসুবিধা কি?’
‘আগে পিস করতে দিলে উপায় আছে? ফস করে বাজে গোসত মিক্স করে ফেলবে। কিছু বুঝতেই পারবেন না। ম্যাজিক দেখিয়ে দেবে। খাসির গোশত কিনে নিয়ে রান্না করার পর খেতে গিয়ে বুঝবনে পাঁটার গোশত। মিস্টার পাঁটা।’
বদরুল সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা মেসের সিঁড়িতে, তিনি বেরুাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে আমার পেছনে পেছনে ঘরে এসে ঢুকলেন। ফিস্টের ব্যাপারটা না বলে তিনি শান্তি পাবেন না। গোশত কেনা থেকে যে গল্প শুরু হয়েছে সেই গল্প শেষ হবে খাওয়া কিভাবে হল সেখানে। আমি ধৈর্ঘ নিয়ে গল্প শোনার প্রস্ততি নিচ্ছি। খাওয়া-দাওয়ার যে কোন গল্পে ভদ্রলোকের অসীম আগ্রহ। এত আনন্দের সঙ্গে তিনি খাওয়ার গল্প করেন যেন এই পৃথিবী সৃষ্টিই হয়েছে খাওয়ার জন্যে। খাওয়া ছাড়াও যে গল্প করার আরো বিষয় থাকতে পারে ভদ্রলোক তা জানেন না।
‘খু্ব চর্বি হয়েছিল। গোশতের ভাজে ভাজে চর্বি।’
‘বাহ, ভাল তো।’
‘চর্বিদার গোশত রান্না করা কিন্তু খুব ডিফিকাল্ট। বাবুর্চি করে কি—যেতেতু চর্বি বেশি, তেল দেয় কম। এটা খুব ভুল। চর্বিদার গোশত তেল লাগে বেশি।’
‘জানতাম না তো।’
‘অনেক ভাল ভাল বাবুর্চিই ব্যাপারটা জানে না। রান্না তো খুব সহজ ব্যাপার না। আমি নিজে বাবুর্চির পাশে বসে দেখিয়ে দিলাম।’
‘খেতে কেমন হয়েছিল?’
‘আমি নিজের মুখে কি বলব—আপনার জন্য রেখে দিয়ছি। চেখে দেখবেন।’
‘রেখে দিয়েছেন মানে? বৃহস্পতিবার ফিস্ট হয়েছে, আজ হল শনিবার।’
‘দুই বেলা গরম করেছি। নিজের হাতেই করেছি। অন্যের কাছে এইসব দিয়ে ভরসা পাওয়া যায় না। ঠিকমত জ্বাল দেবে না। বসুন, আমি নিয়ে আসছি।’
তিনি আনন্দিত মুখে গোশত আনতে গেলেন। আজ দিনটা মনে হয় ভালই যাবে। সকালে ভরপেট খেয়ে নিলে সারাদিন আর খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। বড় ফুপার বাসা থেকে ভোরবেলা বের হয়েছি। সবাই তখনো ঘুমে। কাজের মেয়েটা জেগে ছিল। সেই দরজা খুলে দিল। বেরিয়ে আসার সময় টুক করে এক কদমবুসি। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ব্যাপার কি?
সে নিচু স্বরে বলল, খাস দিলে আফনে এটু দোয়া করবেন ভাইজান। আমার মাইয়াটা বহুত দিন হইছে নিখোঁজ।
‘বল কি? কতদিন হয়েছে নিখোঁজ।’
‘তা ধরেন গিয়া দুই বচ্ছর হইছে। এক বাড়িত কাম করত। এরা মাইর-ধইর করতো—একদিন বাড়ি থাইক্যা পালাইয়া গেছে। আর কোন খুঁইজ নাই।’
সমাজে সর্বনিম্ন স্তরে যাদের বাস তাদের আবেগ-টাবেগ বোধহয় কম থাকে। দু’বছর ধরে মেয়ে নিখোঁজ এই সংবাদ সে দিচ্ছে সহজ গলায়। যেন তেমন কোন বড় ব্যাপার না।
‘নাম কি তোমার মেয়ের?’
‘লুৎফুন্নেসা। লুৎফা ডাকি।’
‘বয়স কত?’
‘ছোট মাইয়া, সাত-আট বছর। ভাইজান, আফনে এটু চেষ্টা নিলে মেয়েটার ফিরত পাই। মেয়ে ঢাকা শহরেই আছে।’
‘জান কি করে ঢাকা শহরে আছে?’
‘আয়না পড়া দিয়া জানছি। ধনখালির পীর সাব আয়না পড়া দিয়া পাইছে। অখন আফনে একটু চেষ্টা নিলে…’
‘আচ্ছা দেখি।’
সে আবার একটা কদমবুসি করে ফেলল।
সকালের শুরুটা হল কদমবুসির মাধ্যমে। শুরু হিসেবে মন্দ না। সাধু-সন্ন্যাসীর স্তরে পৌঁছে যাচ্ছি কি-না বুঝতে পারছি না। সাধু-সন্ন্যাসীরা পায়ের পবিত্র ধূলি বিতরণের মাধ্যমে সকাল শূরু করেন। তারপরের অংশে ভুরি ভোজন, ঘি, হালুয়্য, পারেট মাংস।