রশীদ সাহেব অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, বৃষ্টির পানি কি রকম বাড়ছে দেখছিস না—কি রে?
আতাহার চমকে উঠল। এ রকম মিষ্টি-মধুর স্বরে বাবা কথা বলছেন–এর মানে কি? সামথিং ইজ ভেরী রং। আতাহার শঙ্কিত হৃদয়ে অপেক্ষা করছে। মধুর প্রস্তাবনার পরের অংশটা শোনা দরকার।
রশীদ সাহেব বললেন, তোর কি মনে হয় বৃষ্টি কমবে?
আতাহার অস্বস্তির সঙ্গে বলল, রাত দশটার আগে বৃষ্টি কমবে না।
তাহলে তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
আতাহার ভয়ে ভয়ে বলল, কি ব্যবস্থা?
বাবার চিন্তার গতি সে এখনো ধরতে পারছে না। রশীদ সাহেব বললেন, গতবারের মত এবারও ঘরে পানি ঢুকে যাবে। পানি আটকাতে হবে।
কি ভাবে?
কোদাল নিয়ে তুই নেমে পড়। একটা ড্রেনেজ সিস্টেমের ব্যবস্থা কর। জমা পানি যেন বেরিয়ে যেতে পারে।
আতাহার হতভম্ভ গলায় বলল, পুরো উঠান সিমেন্টের ঢালাই করা। কোদাল দিয়ে আমি তার কি করব?
একটা কিছু বুদ্ধি বের কর। রান্নাঘরের পাশের জায়গাটা তো সিমেন্টের না–সেখানে একটা খালের মত কেটে দে।
খাল কাটতে বলছ?
একটা কিছু বুদ্ধি বের করতে বলছি। কোন একটা কাজের কথা বললেই তুই এরকম করে তাকাস কেন? মানুষের জন্ম কি জন্যে হয়েছে? কাজ করার জন্যে হয়েছে, না বিছানায় গড়াগড়ি করার জন্যে হয়েছে?
আতাহার মনে মনে বলল, মানুষের জন্ম হয়েছে সৌন্দর্যের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যার জন্যে।
মনে মনে কথা বলার একটা ব্যবস্থা থাকায় জীবন যাপন কিছুটা সহনীয় হয়েছে। মনে মনে কথা বলার সিস্টেম না থাকলে অর্ধেক মানুষ মরে যেত বলে আতাহারের ধারণা। রশীদ সাহেব বললেন, কি রে, হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
কোদাল কোথায় পাব?
জোগাড় করবি। জোগাড় করতে না পারলে বিকলপ ব্যবস্থা দেখবি।
টিপ টপ করে যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে তাতে মনে হয় না ঘরে পানি ঢুকবে।
এখন টিপ টপ করে পড়ছে, দশ মিনিট পরে যে ঝুম ঝুম করে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কি? বৃষ্টি তো আর তুই কনট্রোল করছিস না।
আতাহার পানিতে নেমে পড়ল। রান্নাঘরের পাশের একফালি জায়গায় বটি দিয়ে কুপিয়ে নালার মত করতে করতেই ঝমবৃষ্টি নেমে গেল। রশীদ সাহেব বারান্দা থেকে আনন্দিত গলায় বললেন–দেখলি, কেমন ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টি শুরু হয়েছে? আজ আমাবশ্য, বৃষ্টি হবেই।
খাল কাটায় পানির কোন হেরফের হল না, তবে রশীদ সাহেব ঘোষণা করলেন–পানি দুই আঙ্গুলের মত নেমে গেছে। জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতি তিনি খানিকটা মমতাও বোধ করলেন। উদার গলায় বললেন, ভাল করে গরম পানি দিয়ে গোসল কর। সাবান ডলে গোসল। তারপর আগুন-গরম এক কাপ চা খা। আদা-চা। নয়তো ঠাণ্ডা-ফাগু লেগে যাবে।
আতাহার মনে মনে বলল, পুত্রের প্রতি আপনার এই গভীর মমতায় আমি অভিভূত হয়েছি। আপনাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ। আতাহার পুতি-গন্ধময় পানি থেকে বটি হাতে খোড়াতে খোড়াতে উঠে এল। সে বেকুবের মত খালি পায়ে নেমেছিল। ভাঙা কাচে বাম পা কেটে গেছে। আতাহারের ধারণা, তার শরীরের শ্বেতকণিকাদের মধ্যে সাজ সাজ রাব পড়ে গেছে। কারণ ক্ষতস্থান দিয়ে বহু বিচিত্র ধরনের জীবাণু একসঙ্গে শরীরে ঢুকে গেছে। এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মরাতেও আনন্দ। বাবাশ্বেতকণিকারা তাদের ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছে–এই যে দেখ, এটা হচ্ছে টিটেনাসের জীবাণু, আর ঐ পাশে দেখ, এরা জণ্ডিসের জীবাণু। বৈজ্ঞানিক নাম হেপাটাইটিস-এ। কিছু কলেরার জীবাণুও আছে। বল তো লক্ষ্মী সোনারা, কলেরার জীবাণু দেখতে কেমন?
কমার মত।
এই তো পেরেছ। এখন ছুরি-কাচি যা পাও হাতে নিয়ে চলে এসো—জীবাণুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।
বাবা, আমরা তো ছোট।
ছোট-বড় এখন আর ব্যাপার না। কোটি কোটি জীবাণু ঢুকে পড়েছে। লোকটাকে বাঁচাতে হলে আমাদের সবাইকে কাঁপিয়ে পড়তে হবে। সবাই এক সঙ্গে ঝাপিয়ে না। পড়লে বেচারা বাঁচবে না।
চাদর মুড়ি দিয়ে আতাহার তার বিছানায় বসে আছে। জ্বর আসছে বলে মনে হচ্ছে। সিগারেটের ধোয়ার কোন স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না, পানি তিতা লাগছে।
মিলি বড় মগভর্তি একমগ চা এনে আতাহারের সামনে রাখল। আতাহার বলল, চা খাব না। চা নর্দমায় নিয়ে ফেলে দে।
মিলি বলল, আমার উপর রাগ করছ কেন? আমি তো তোমাকে বৃষ্টিতে চুবাইনি।
কারো উপর রাগ করছি না। চা খেতে ইচ্ছা করছে না। জ্বর আসবে বলে মনে হচ্ছে।
প্যারাসিটামল খাবে?
খেতে পারি।
আগে দেখি ঘরে আছে কি-না। না থাকলে তোমকে গিয়েই আনতে হবে। সেলফ হেলপ।
মিলি হাসছে। আতাহারের মেজাজ খুবই খারাপ, তারপরও মিলির হাসি তার দেখতে ভাল লাগছে। মিলি বলল, তোমার কাছে একটা খোলা চিঠি এসেছে। চিঠির উপরে লেখা–আৰ্জেন্ট। যেহেতু খোলা চিঠি আমি পড়ে ফেলেছি।
ভাল করেছিস।
নীতু নামক জনৈক তরুণী কিংবা কিশোরী, কিংবা মহিলা লিখেছেন যে, তাঁর ভাইয়ের এখনো কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তুমি যেন দ্রুত কোন ব্যবস্থা কর।
আমি কি ব্যবস্থা করব? আমি কি আইবির লোক?
আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? ধমক দিতে হলে নীতুকে ধমক দাও।
নীতুটা কে ভাইয়া?
সাজ্জাদের ছোট বোন।
ও আচ্ছা, সাজ্জাদ ভাইয়ার ছোট বোন। তোমার মুখে তো কোন দিন তার নাম শুনিনি।
নাম শোনার কি আছে?
এই নাও নীতুর চিরকুট।
ফেলে দে। আমি ওটা নিয়ে করব কি? খবর যা জানার তা তো জানলামাই। এখন চিরকুট দিয়ে হবে কি? তাবিজ করে গলায় ঝুলাব?
মিলি আবারও হাসল। সেই হাসি দেখে আতাহারের মন দ্রবীভূত হল। সে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চা খেতে ভাল হয়েছে। মিলি হাসি মুখে বলল, ভাইয়া, দুই মিনিটের জন্য বসি? খুব জরুরি কথা আছে। ভয়াবহ একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাবাকে সেই সমস্যার কথা কিভাবে বলা হবে বুঝতে পারছি না। তোমার পরামর্শ দরকার।